শেরপুর প্রতিনিধি
'আমি নয়আনী বাজার আলবদর টর্চার ক্যাম্পের পাহারাদার ছিলাম। আর কামারুজ্জামান ছিলেন আলবদরদের হর্তাকর্তা। তাঁর নির্দেশেই লোকজনকে আলবদররা এই ক্যাম্পে ধরে এনে নির্যাতন করত। নির্যাতন শেষে অনেককে শেরী ব্রিজে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হতো। শহীদ গোলাম মোস্তফাকেও কামারুজ্জামানের নির্দেশে আলবদররা হত্যা করে।'
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দলের কাছে এভাবেই গতকাল বুধবার সাক্ষ্য দেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে কামারুজ্জামানের সহচর, নয়আনী বাজার এলাকার টর্চার কেন্দ্রের পাহারাদার, আলবদর সদস্য মোহন মুন্সী।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ তদন্তে গতকাল শেরপুর অঞ্চলের বিভিন্ন বধ্যভূমি, টর্চার সেল ও গণহত্যার স্থান পরিদর্শন করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দলের সদস্যরা। এ সময় তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময় ভুক্তভোগী ও এলাকার প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন।
আলবদর সদস্য মোহন মুন্সী ছাড়াও সাক্ষ্য দেন বীরপ্রতীক জহুরুল হক মুন্সী, ইতিহাসবিদ পণ্ডিত ফসিহুর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা তালাপতুফ হুসেন মঞ্জু, শামসুন্নাহার বেগম, ভাষাসৈনিক আবদুর রশিদ, আবুল কাশেম, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম নেতা আক্তারুজ্জামান, আমজাদ হোসেন, ইউনুস কসাই, জিয়াউল হক বিএসসি প্রমুখ।
সাক্ষ্যদানকালে আলবদর সদস্য মোহন মুন্সী বলেন, 'আমি সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ডিউটি করতাম। দিনে যাদেরকে ধরে আনা হতো তাদেরকে চোখ, হাত-পা বেঁধে সিঁড়ির নিচে ফেলে রাখা হতো। দোতলায় কামারুজ্জামান সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে শলাপরামর্শের পর রাতে গাড়িতে করে তাদেরকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হতো। মাঝে-মধ্যে এই ক্যাম্পে পাকিস্তানি আর্মি কমান্ডার ক্যাপ্টেন রিয়াজ আসতেন। কামারুজ্জামান তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করতেন। এ ক্যাম্পে কামারুজ্জামানের সহযোগীদের মধ্যে ছিল_কামরান, নাসির, জয়নাল আবদীন, আবদুল্লা, মাহমুদসহ আরো অনেকে।' মোহন মুন্সী তাঁর অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করে ক্ষমা প্রার্থনা এবং কামারুজ্জামানসহ সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার দাবি করেন।
বীরপ্রতীক জহুরুল হক মুন্সী বলেন, 'একাত্তরের ৯ ডিসেম্বর আমি যখন জামালপুরের পিটিআইয়ের পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্পে সারেন্ডারপত্র নিয়ে যাই, তখন সেখানে কামারুজ্জামানকে দেখতে পাই। তিনি দোভাষীর কাজ করেছিলেন। তাঁর নির্দেশে তখন আমাকে হাত-পা বেঁধে উপুড় করে টানিয়ে, হাতে-পায়ে সুঁই ঢুকিয়ে, দাঁত ভেঙে নির্যাতন করা হয়েছিল। তাঁর নির্দেশেই শেরপুরে আলবদর, রাজাকার ও পাকিস্তানি আর্মি গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগি্নসংযোগ করেছিল।'
চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের পেশকার রাশেদুজ্জামান বলেন, 'একাত্তরে আমি সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। একদিন সকাল ১১টার দিকে দেখি আমাদের বাড়ির পাশে (সদর থানার সামনে) পাঁচ যুবককে চোখে-মুখে কালো কাপড়, হাত পিছমোড়া করে বেঁধে একটি জিপে করে আনা হয়েছে। পরে লিচুগাছের নিচে দাঁড় করিয়ে তাদেরকে গুলি করে হত্যা করে সেখানেই গর্ত করে মাটিচাপা দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধারা সেখান থেকে তাদের হাড়গোড় তুলে কবরস্থানে দাফন করেন।'
ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তারা গতকাল সকালে শেরপুর শহরের উপকণ্ঠে 'শেরী ব্রিজ' এলাকার বধ্যভূমি, শহরের রঘুনাথ বাজার এলাকায় শনি বিগ্রহ মন্দিরের পুরোহিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল, সদর থানার সম্মুখের বধ্যভূমি ও আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প নয়আনী বাজার এলাকায় সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাসা, সূর্যদি ও ঝাউগড়া, ঝিনাইগাতির আহম্মদ নগর এবং শ্রীবরদীর জগৎপুর গণহত্যাস্থল পরিদর্শন করে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেন। পরে বিকেলে তাঁরা শেরপুর সার্কিট হাউজে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তা এডিশনাল এসপি মতিউর রহমান বলেন, 'আমরা মুক্তিযুদ্ধকালে শেরপুর অঞ্চলে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অনেক অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের সত্যতা পেয়েছি। তবে তদন্তের স্বার্থে এখন কিছু বলা সম্ভব নয়।' জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেয়েছেন কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'তাঁর বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ এবং সাক্ষ্য-প্রমাণ এসেছে।'
গত মঙ্গলবার দুই দিনের সফরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দল শেরপুরে যায়। তদন্ত দলে রয়েছেন_প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট জেয়াদ-আল-মালুম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মতিউর রহমান, সহকারী পুলিশ সুপার মো. নুরুল ইসলাম, পুলিশ পরিদর্শক মো. আবদুর রেজ্জাক খান, প্রসিকিউটর প্রশাসনের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মো. হাবিবুর রহমান খান ও ক্যামেরাম্যান কনস্টেবল প্রবীর ভট্টাচার্য।