পাবনা ও ঈশ্বরদী প্রতিনিধি
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাবনার ঈশ্বরদী ও পাকশীর বিভিন্ন জায়গায় গণহত্যা, লুট, ধর্ষণ, অগি্নসংযোগের অনেক ঘটনার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আলবদর-রাজাকারদের নেতৃত্বদানকারী জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও মাওলানা আবদুস সুবহান এবং মাওলানা ইসহাক আলী, খোদা বঙ্ খান প্রমুখ এসব অপকর্মের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। তাঁদের নির্দেশে মসজিদ থেকে পবিত্র কোরআন শরিফ পড়ার সময় ডেকে নিয়েও মানুষকে খুন করা হয়। এর যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তদল গতকাল শুক্রবার ঈশ্বরদীর বিভিন্ন বধ্যভূমি ও গণকবর পরিদর্শন এবং মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের সাক্ষ্য গ্রহণ করে। পরে পাবনা সার্কিট হাউসে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তদন্তদলের সদস্য অ্যাডভোকেট সৈয়দ হায়দার আলী এসব কথা জানান।
এর আগে তদন্তদলের কাছে ঈশ্বরদী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সহকারী কমান্ডার (অর্থ) তহুরুল আলী মোল্লাসহ মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা জানান, ঈশ্বরদী স্টেশন রোডে বর্তমানে যেখানে বাটার শোরুমটি রয়েছে, সেটি ১৯৭১ সালে রাজাকারদের ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ঈশ্বরদীর বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষকে ওই ক্যাম্পে ধরে এনে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হতো। পরে প্রেসক্লাবের পেছনের নিচু জমিতে লাশগুলো পুঁতে রাখা হতো। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের নেতারা জানান, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও মওলানা আবদুস সুবহান সপ্তাহে কমপক্ষে দুদিন ওই ক্যাম্পে এসে অবস্থান করে রাজাকারদের দিকনির্দেশনা দিতেন। তাঁদের দুজনের নির্দেশেই ঈশ্বরদীতে ব্যাপক গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকার-আলবদররা।
মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৯৭১ সালের ৯ মাসে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদররা ঈশ্বরদীর রেলওয়ে কলোনির পাম্প হাউস এলাকার বধ্যভূমিতেই কমপক্ষে ৫০০ মানুষকে হত্যা করে। এ ছাড়া প্রেসক্লাবের পেছনের জায়গা, ভূতের গাড়ি বধ্যভূমি, পাকশী রেলওয়ে বধ্যভূমি, চন্দ্রপ্রভা স্কুলসংলগ্ন এলাকায়ও বহু মানুষকে হত্যা করা হয়।
তদন্তদলের সদস্যরা দুপুরে ঈশ্বরদীর বিভিন্ন বধ্যভূমি ও গণকবর পরিদর্শন শেষে পাকশীতে যান। পাকশী রেলওয়ে বধ্যভূমি এলাকায় তাঁরা এক পরিবারের পাঁচ শহীদের কবর পরিদর্শন করেন। বিকেলে তদন্তদলের সদস্যরা মাছদিয়া ও মাছুপাড়া গণকবর পরিদর্শন এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। এর আগে ঈশ্বরদী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল কার্যালয়ে ঈশ্বরদীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। তদন্তদল ঈশ্বরদী ও পাকশীর মোট ২০ শহীদ পরিবারের সদস্যদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন।
প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর রহমান, অ্যাডভোকেট সৈয়দ হায়দার আলী, আবদুর রহমান হাওলাদার ও আলতাফ উদ্দিন এবং তদন্ত কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক খান, জে এম আলতাফুর রহমান, এস এম ইদ্রিস আলী ও দলনেতার একান্ত কর্মকর্তা কাশেমসহ তদন্তদল গতকাল সকালে ঈশ্বরদী মুক্তিযোদ্ধা সংসদে আসে। এ সময় সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা শামসুর রহমান শরিফ তাঁদের স্বাগত জানান। তদন্তদল গতকাল ঈশ্বরদী শহর ও পাকশী ইউনিয়নের সাতটি বধ্যভূমি পরিদর্শন করে।
তদন্তদলের সদস্যরা আজ শনিবার সকালে সাঁথিয়া ও ডেমরার আলবদর-রাজাকার ক্যাম্প চিহ্নিতকরণ, পরিদর্শন ও স্থানীয় লোকজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন। দুপুরে তাঁরা ধুলাউড়ি ও করমজার বধ্যভূমি, গণকবর, আলবদর-রাজাকার ক্যাম্প চিহ্নিতকরণ, পরিদর্শন ও সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন।
সাক্ষীদের নিরাপত্তা
সাক্ষীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন_এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক খান সাংবাদিকদের জানান, সুনির্দিষ্টভাবে তাঁদের কাছে এ ধরনের কোনো অভিযোগ নেই। তা ছাড়া জেলা পুলিশ সুপারসহ প্রতিটি থানার ওসিকে সাক্ষীদের নিরাপত্তা বিধানের নির্দেশ দেওয়া আছে। এ ছাড়া সরকার সাক্ষীদের নিরাপত্তা-সংক্রান্ত একটি আইন করার কথা ভাবছে।
রাজাকার-আলবদরদের সংখ্যা জানা নেই
পাবনায় রাজাকার-আলবদরের সংখ্যা কত এর কোনো পরিসংখ্যান দিতে পারেনি পাবনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড বা অন্য কেউ। জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, পাবনা জেলায় হাতে গোনা কয়েকজন রাজাকার ছিল। আর আলবদর ছিল প্রায় ৫০ জনের মতো। তাদের অনেকেই মারা গেছে। বর্তমানে জীবিত আছে সাত থেকে আটজনের মতো। তবে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক খান কালের কণ্ঠকে বলেন, পাবনায় রাজাকার-আলবদরের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। যতই দিন যাচ্ছে, তালিকা ততই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।