Showing posts with label বগুড়া. Show all posts
Showing posts with label বগুড়া. Show all posts

17 March 2011

উল্লাপাড়া জামায়াতের আমিরসহ নয় নেতা গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিবেদক, সিরাজগঞ্জ ও উল্লাপাড়া প্রতিনিধি | তারিখ: ১৮-০৩-২০১১

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া পৌর শহরের আবু হুরাইরা এতিমখানা থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার উপজেলা জামায়াতের আমিরসহ নয় নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

উল্লাপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. তাজুল ইসলাম জানান, গতকাল বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের জন্মদিনের উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং আজ শুক্রবার উল্লাপাড়ার মার্চেন্টস পাইলট স্কুল ও কলেজের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠান ভণ্ডুল করতে গোপন বৈঠক হচ্ছিল। সংবাদের ভিত্তিতে গতকাল বেলা ১১টার দিকে আবু হুরাইয়া এতিমখানায় অভিযান চালিয়ে নয় জামায়াত নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাঁদের কাছ থেকে পাঁচটি জেহাদি বই উদ্ধার করা হয়।

গ্রেপ্তার হওয়া জামায়াত নেতারা হলেন উল্লাপাড়া উপজেলা জামায়াতের আমির মো. শাহজাহান আলী, পৌর জামায়াতের আমির মো. খায়রুল ইসলাম, সেক্রেটারি মো. সরোয়ার হোসেন, বড়হর ইউনিয়ন জামায়াতের আমির আবদুল লতিফ, পূর্ণিমাগাতী ইউনিয়ন জামায়াতের আমির আবদুল খালেক, উপজেলা জামায়াতের কার্যকরী সদস্য গোলাম মোস্তফা, শাহজাদপুর উপজেলার নরিনা দাখিল মাদ্রাসার সহকারী সুপার মো. আবুল বাশার, আমিনুল ইসলাম এবং জামায়াতের রুকন সদস্য মো. শাহাদৎ হোসেন।

ওসি তাজুল জানান, গ্রেপ্তারের পর সবাইকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি তদন্তের পর অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

উল্লাপাড়া থানাহাজতে জামায়াত নেতা শাহজাহান আলী তাঁদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আত্মশুদ্ধির জন্য নিয়মিত বৈঠক হিসেবে তাঁরা মিলিত হয়েছিলেন।

16 March 2011

বগুড়ায় জামায়াতের ১৮ নেতার পদত্যাগ

বগুড়া অফিস

বগুড়ার শেরপুরে জামায়াতে ইসলামীর অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। দলীয় কোন্দলের কারণে সেখানে একযোগে ১৮ জন রুকন (ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষমতাসম্পন্ন সদস্য) দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে পদত্যাগের ঘোষণা দিতে গিয়ে তাঁরা জামায়াতের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা এবং দলের গঠনতন্ত্রবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগ আনেন।

অবশ্য পদত্যাগী নেতাদের বক্তব্য ষড়যন্ত্র ও বিভ্রান্তমূলক দাবি করেছেন উপজেলা জামায়াতের আমির। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও গঠনতন্ত্রবিরোধী কাজের সঙ্গে জড়িত থাকায় তিনজনকে বহিষ্কার এবং ওই ইউনিয়ন কমিটি বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে গাড়ীদহ ইউনিয়ন জামায়াতের সদস্য (রুকন) নজরুল ইসলাম বলেন, আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে প্রার্থী হিসেবে প্রায় দুই বছর আগে ইউনিয়ন জামায়াতের সদস্যদের মতামত নিয়ে আনিছুর রহমানের নাম ঘোষণা করা হয়। কিন্তু বগুড়া ও শেরপুর উপজেলা জামায়াতের নেতারা তড়িঘড়ি করে ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান আবদুস সাত্তারকে আবারও দলীয়ভাবে চেয়ারম্যান প্রার্থী ঘোষণা করে। একই সঙ্গে ওই নেতারা তাঁদের অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইউনিয়ন জামায়াতের আমির তবিবুর রহমান, সেক্রেটারি মাহমুদুল হাসান ও দলের সদস্য চেয়ারম্যান প্রার্থী আনিছুর রহমানকে সদস্যপদ থেকে বহিষ্কার করেন, যা দলের গঠনতন্ত্রবিরোধী ও অগণতান্ত্রিক। এসব কারণেই দলের ১৮ জন রুকন পদত্যাগ করছেন বলে সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করা হয়।

8 November 2010

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রেস ব্রিফিং: পাবনায় নিজামীসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত প্রমাণ মিলেছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

পাবনায় টানা তিন দিন তথ্যানুসন্ধান শেষে ঢাকায় ফিরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটররা প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন, জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, মাওলানা আবদুস সুবাহান, মাওলানা ইসহাক, মাওলানা ইদ্রিসসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে একাত্তরে সংঘটিত নানা অপরাধের প্রমাণ মিলেছে। তাঁদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে প্রস্তুত সে সময়ে নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা।

গতকাল সোমবার ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটরের কক্ষে এ প্রেস ব্রিফিং হয়। এতে প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী জানান, তদন্তের অংশ হিসেবে গত ৪ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের চারজন আইনজীবীসহ সাত সদস্যের দল পাবনা এলাকায় যান। সেখানে তাঁরা ঈশ্বরদী, পাকশী, সাঁথিয়া, আতাইকুলাসহ আশপাশের এলাকায় অবস্থিত বধ্যভূমি পরিদর্শন করেন। তদন্ত দলকে এলাকাবাসী স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধীদের আস্তানা, টর্চার সেল ও ক্যাম্পগুলো ঘুরে-ফিরে দেখান। এ এলাকা থেকে ৫৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। সাক্ষীরা জানিয়েছেন, একাত্তরে এসব জায়গায় ৯৭৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে। নানা কায়দায় নির্যাতন ও হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হতো। সে সময় ৪০ জন নারীকেও ধর্ষণ করা হয়।

তদন্তকারী দলে ছিলেন প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর আলী, আলতাফ উদ্দিন আহমেদ, আবদুর রহমান হাওলাদার, সৈয়দ হায়দার আলী, তদন্ত কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক, আলতাফুর রহমান ও ইদ্রিস আলী। প্রেস ব্রিফিংয়ে চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুসহ অন্য আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে হায়দার আলী জানান, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে সঠিক সময়েই প্রতিবেদন দেওয়া হবে। অন্যদের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'চূড়ান্ত তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেলেই তাঁদের গ্রেপ্তারের জন্য আবেদন করা হবে।'

6 November 2010

তদন্তদলের কাছে সাক্ষ্য: নিজামীর নির্দেশে সাঁথিয়ায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চলে

পাবনা ও আঞ্চলিক প্রতিনিধি

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় গণহত্যা, লুট, ধর্ষণ, অগি্নসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তদন্তদল। এ ছাড়া জামায়াত নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য মাওলানা আবদুস সুবাহান, রফিক উন-নবী বাবলু, মাওলানা ইসাহাক আলীসহ আরো কয়েকজনের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ট্রাইব্যুনালের তদন্তদল গতকাল শনিবার নিজামীর নিজ এলাকা সাঁথিয়ার বিভিন্ন বধ্যভূমি ও গণকবর পরিদর্শনের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের সাক্ষ্য গ্রহণের পর স্থানীয় ডাকবাংলোয় প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান। এর আগে তদন্তদল সাঁথিয়ার ডেমরা বাউসগাড়ি, ধুলাউড়ি, করমজা, শহীদনগর গ্রামে গণকবর ও বধ্যভূমি, রাজাকার-আলবদর ক্যাম্প পরিদর্শন এবং মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের স্বজনদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। তদন্তদলের কাছে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিজামী-সাত্তার গং সাঁথিয়ার অনেক মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করে। পাশাপাশি অর্থের লোভ দেখিয়ে অনেককে তাদের দলে ভেড়ায়।
গণকবর পরিদর্শনকালে তদন্ত কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক বলেন, স্থানীয় প্রবীণ ও জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষ্য থেকে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ১৪ মে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসর আসাদ রাজাকারের নেতৃত্বে ডেমরার বাউসগাড়ি গ্রামে এক রাতেই প্রায় ৯০০ মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করা হয়। ঘাতকরা হিন্দু ও মুসলমানদের পৃথক লাইনে দাঁড়
করিয়ে ব্রাশফায়ার করে। পৃথক গর্ত করে তাদের মাটিচাপা দেওয়া হয়। একইভাবে ধুলাউড়ি ও করমজা গ্রামেও প্রায় ২০০ মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনাসহ এ অঞ্চলের সব গণহত্যার সঙ্গে মতিউর রহমান নিজামীর সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা এসব ঘটনায় নিজামীর সহচর হিসেবে মাওলানা আবদুস সুবাহান, মাওলানা ইসাহাক আলী, মোহম্মদ রফিক উন নবী, আবদুস সাত্তারসহ আরো অনেকের নাম প্রকাশ করে।
তদন্তদল সাঁথিয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার জামালউদ্দিনসহ ২০ শহীদ পরিবারের সদস্যদের সাক্ষ্য গ্রহণ করে। তাঁরা জানান, কেবল সাঁথিয়া নয়, পাবনা জেলার সব গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিজামী দায়ী।

'ওদের খতম করো'-দাঁড়িয়ে থেকে নিজামীর নির্দেশ

আহমেদ উল হক রানা, পাবনা

বাঙালি হয়েও উর্দুতে সাত্তার রাজাকার চেঁচিয়ে বলল, 'ইয়ে সালা জিন্দা হ্যায়, সালেকো কুরবানি করো।' পাশে দাঁড়িয়ে পৈশাচিক এই গণহত্যা তদারক করছিলেন মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী। তাঁর নির্দেশেই পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার ধুলাউড়ির বধ্যভূমিতে রাজাকাররা একে একে হত্যা করে পদ্মবিলার খবির উদ্দিন, দ্বারা মিয়া, রঘুনাথপুরের চাঁদ আলী বিশ্বাস, সুজানগরের শাহজাহান আলী, মহসিন উদ্দিন, আকতার আলম, মোকছেদ মিয়াসহ আট মুক্তিযোদ্ধাকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকাররা গলায় ছুরি চালালেও ভাগ্যক্রমে বেঁঁচে যাওয়া বনগ্রামের শাহজাহান আলী (৬৫) গতকাল শনিবার দুপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের কাছে এভাবে সেদিনের নৃশংস ঘটনা তুলে ধরেন।
শাহজাহান আলী জানান, ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে তিনিসহ ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা আটক হন। সেনা সদস্যরা তাঁদের ধরে রাজাকারদের হাতে তুলে দেয়। রাজাকাররা তাঁদের নিয়ে আসে ধুলাউড়ি বধ্যভূমিতে। সেখানে তখন দাঁড়িয়ে ছিলেন জামায়াত নেতা (তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা) মতিউর রহমান নিজামী। নিজামী একপর্যায়ে সাত্তারসহ অন্য রাজাকারদের নির্দেশ দেন 'ওদের খতম করো'। শাহজাহান আলী আরো জানান, মুক্তিযোদ্ধাদের কাউকে গুলি করে, কাউকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে রাজাকাররা। নিজের বেঁচে যাওয়ার বর্ণনা দিয়ে শাহজাহান আলী বলেন, 'প্রথমে আমার বুকে বেয়নেট চার্জ করা হয়। এরপর মাটিতে ফেলে নিজামীর নির্দেশে গলায় ছুরি চালানো হয়। রাজাকাররা আমাকে মৃত ভেবে ওই স্থান ত্যাগ করে। এদিকে খবর পেয়ে সালাম ও আফতাবের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা ঘটনাস্থল থেকে আমাকে উদ্ধার করে। প্রথমে স্থানীয়ভাবে ও পরে পালিয়ে পাবনা সদর হাসপাতালে আমার চিকিৎসা করানো হয়।' এই ঘটনার পর বেঁচে যাওয়া শাহজাহান আলী স্থানীয়ভাবে পরিচিত হন 'গলাকাটা শাহজাহান' নামে। শাহাজাহান জানান, তাঁর মতো মুক্তিযোদ্ধা মাজেদ ও মোসলেমও সেদিন বেঁচে গিয়েছিলেন।
সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি আজো তাড়া করে বেড়ায় মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান আলীকে। ৩৯ বছরে তাঁর সঙ্গে যোগ হয়েছে তীব্র ঘৃণা। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কোনো একদিন নির্বাচনী প্রচারকালে নিজামী মুখোমুখি হন এই বীর মুক্তিযোদ্ধার। নিজামী তাঁর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে তীব্র ঘৃণায় গালি দিয়ে তিনি হাত ফিরিয়ে দেন। ট্রাইব্যুনালের কাছে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় নিজামীসহ সব মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীর বিচার দাবি করেন শাহজাহান আলী।

5 November 2010

ঈশ্বরদী ও পাকশীতে তদন্তদল: নিজামী-সুবহানের অপকর্মের অনেক প্রমাণ

পাবনা ও ঈশ্বরদী প্রতিনিধি

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাবনার ঈশ্বরদী ও পাকশীর বিভিন্ন জায়গায় গণহত্যা, লুট, ধর্ষণ, অগি্নসংযোগের অনেক ঘটনার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আলবদর-রাজাকারদের নেতৃত্বদানকারী জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও মাওলানা আবদুস সুবহান এবং মাওলানা ইসহাক আলী, খোদা বঙ্ খান প্রমুখ এসব অপকর্মের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। তাঁদের নির্দেশে মসজিদ থেকে পবিত্র কোরআন শরিফ পড়ার সময় ডেকে নিয়েও মানুষকে খুন করা হয়। এর যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তদল গতকাল শুক্রবার ঈশ্বরদীর বিভিন্ন বধ্যভূমি ও গণকবর পরিদর্শন এবং মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের সাক্ষ্য গ্রহণ করে। পরে পাবনা সার্কিট হাউসে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তদন্তদলের সদস্য অ্যাডভোকেট সৈয়দ হায়দার আলী এসব কথা জানান।

এর আগে তদন্তদলের কাছে ঈশ্বরদী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সহকারী কমান্ডার (অর্থ) তহুরুল আলী মোল্লাসহ মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা জানান, ঈশ্বরদী স্টেশন রোডে বর্তমানে যেখানে বাটার শোরুমটি রয়েছে, সেটি ১৯৭১ সালে রাজাকারদের ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ঈশ্বরদীর বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষকে ওই ক্যাম্পে ধরে এনে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হতো। পরে প্রেসক্লাবের পেছনের নিচু জমিতে লাশগুলো পুঁতে রাখা হতো। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের নেতারা জানান, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও মওলানা আবদুস সুবহান সপ্তাহে কমপক্ষে দুদিন ওই ক্যাম্পে এসে অবস্থান করে রাজাকারদের দিকনির্দেশনা দিতেন। তাঁদের দুজনের নির্দেশেই ঈশ্বরদীতে ব্যাপক গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকার-আলবদররা।

মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৯৭১ সালের ৯ মাসে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদররা ঈশ্বরদীর রেলওয়ে কলোনির পাম্প হাউস এলাকার বধ্যভূমিতেই কমপক্ষে ৫০০ মানুষকে হত্যা করে। এ ছাড়া প্রেসক্লাবের পেছনের জায়গা, ভূতের গাড়ি বধ্যভূমি, পাকশী রেলওয়ে বধ্যভূমি, চন্দ্রপ্রভা স্কুলসংলগ্ন এলাকায়ও বহু মানুষকে হত্যা করা হয়।

তদন্তদলের সদস্যরা দুপুরে ঈশ্বরদীর বিভিন্ন বধ্যভূমি ও গণকবর পরিদর্শন শেষে পাকশীতে যান। পাকশী রেলওয়ে বধ্যভূমি এলাকায় তাঁরা এক পরিবারের পাঁচ শহীদের কবর পরিদর্শন করেন। বিকেলে তদন্তদলের সদস্যরা মাছদিয়া ও মাছুপাড়া গণকবর পরিদর্শন এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। এর আগে ঈশ্বরদী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল কার্যালয়ে ঈশ্বরদীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। তদন্তদল ঈশ্বরদী ও পাকশীর মোট ২০ শহীদ পরিবারের সদস্যদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন।

প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর রহমান, অ্যাডভোকেট সৈয়দ হায়দার আলী, আবদুর রহমান হাওলাদার ও আলতাফ উদ্দিন এবং তদন্ত কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক খান, জে এম আলতাফুর রহমান, এস এম ইদ্রিস আলী ও দলনেতার একান্ত কর্মকর্তা কাশেমসহ তদন্তদল গতকাল সকালে ঈশ্বরদী মুক্তিযোদ্ধা সংসদে আসে। এ সময় সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা শামসুর রহমান শরিফ তাঁদের স্বাগত জানান। তদন্তদল গতকাল ঈশ্বরদী শহর ও পাকশী ইউনিয়নের সাতটি বধ্যভূমি পরিদর্শন করে।

তদন্তদলের সদস্যরা আজ শনিবার সকালে সাঁথিয়া ও ডেমরার আলবদর-রাজাকার ক্যাম্প চিহ্নিতকরণ, পরিদর্শন ও স্থানীয় লোকজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন। দুপুরে তাঁরা ধুলাউড়ি ও করমজার বধ্যভূমি, গণকবর, আলবদর-রাজাকার ক্যাম্প চিহ্নিতকরণ, পরিদর্শন ও সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন।

সাক্ষীদের নিরাপত্তা
সাক্ষীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন_এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক খান সাংবাদিকদের জানান, সুনির্দিষ্টভাবে তাঁদের কাছে এ ধরনের কোনো অভিযোগ নেই। তা ছাড়া জেলা পুলিশ সুপারসহ প্রতিটি থানার ওসিকে সাক্ষীদের নিরাপত্তা বিধানের নির্দেশ দেওয়া আছে। এ ছাড়া সরকার সাক্ষীদের নিরাপত্তা-সংক্রান্ত একটি আইন করার কথা ভাবছে।

রাজাকার-আলবদরদের সংখ্যা জানা নেই
পাবনায় রাজাকার-আলবদরের সংখ্যা কত এর কোনো পরিসংখ্যান দিতে পারেনি পাবনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড বা অন্য কেউ। জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, পাবনা জেলায় হাতে গোনা কয়েকজন রাজাকার ছিল। আর আলবদর ছিল প্রায় ৫০ জনের মতো। তাদের অনেকেই মারা গেছে। বর্তমানে জীবিত আছে সাত থেকে আটজনের মতো। তবে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক খান কালের কণ্ঠকে বলেন, পাবনায় রাজাকার-আলবদরের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। যতই দিন যাচ্ছে, তালিকা ততই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।

6 October 2010

নিজামীর বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হচ্ছেন লুৎফর রাজাকার

নিজস্ব প্রতিবেদক ও বেড়া (পাবনা) প্রতিনিধি

জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হচ্ছেন পাবনার লুৎফর রাজাকার (লুৎফর রহমান)। একাত্তরে নিজামীর দোসর ও পাবনা এলাকার রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন লুৎফর রাজাকার। তবে তিনি নিজামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার পর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তিনি বলেছেন, বিষয়টি টের পেয়ে তাঁকে হত্যার হুমকি দিয়েছে পাবনা জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা।

গত বুধবার পাবনার বেড়া উপজেলার নিজের বাড়িতে বসে লুৎফর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, '১৯৭১ সালে আমি যে ভুল করেছি, তার প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে আমি যে পাপ করেছি, তা থেকে মুক্ত হতে চাই। আর এ জন্যই মতিউর রহমান নিজামীর অপকর্ম আদালতের কাছে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মতিউর রহমান নিজামী আমাদের দল রাজাকার বাহিনীর নেতা। আমি তাঁর দলের সদস্য হয়ে ১৯৭১ সালে নানা অপরাধ করার কারণে ১১ মাস জেল খেটেছি। সেই সব অপরাধের নেপথ্যে ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী।' লুৎফর রহমান ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, 'রাজাকার হওয়ায় আমার শাস্তি হলো, কিন্তু মতিউর রহমান নিজামীর শাস্তি হবে না, এটা তো হতে পারে না।'

নিজের বাড়িতে বসে কালের কণ্ঠের কাছে এ কথাগুলো বলার পর লুৎফর রহমান সেদিন আর কিছু বলতে রাজি হননি। নিজের নিরাপত্তা এবং একই সঙ্গে তদন্তকাজে সমস্যা হতে পারে_এ যুক্তি দিয়ে তিনি কোনো কথা বলেননি। কিন্তু পরের দিন এ প্রতিবেদকদের ডেকে নেন বেড়া উপজেলার জোড়গাঁথা বাজারে। সেখানে তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর কী কী ভূমিকা ছিল, কাদের প্ররোচনায় তিনি রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন_সব খুলে বলেন। তিনি উদ্বেগের সঙ্গে জানান, নিজামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা তাঁকে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে।

লুৎফর রাজাকার বলেন, '১৯৭১ সালে মতিউর রহমান নিজামীর প্রত্যক্ষ প্ররোচনায় রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেই। মাসে বেতন ছিল ১৩০ টাকা। তিন মাস ট্রেনিং নেই। এরপর নেমে পড়ি অভিযানে। পাবনার পথে-প্রান্তরে নানা অপরাধ করেছি। পরিকল্পনা করে নানা অভিযানে অংশ নিয়েছি। রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী যে ধরনের কাজ করেছে, আমিও সেসব করেছি। এসব কিছুর নেপথ্যে ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী।'

কেন রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন_এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'মতিউর রহমান নিজামীর প্ররোচনায় এবং বখে যাওয়া কিছু বন্ধু-বান্ধবের পরামর্শে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ১৮ বছর। বয়সেরও একটা দোষ ছিল। ভুল পথে গিয়ে ক্ষমতার দম্ভ দেখাতে চেয়েছি। আমার সমবয়সীরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে আর আমি রাজাকার হলাম, এর দায় আমি বয়সের দোষ দিয়ে অবশ্য এড়াতে পারি না। জীবনের তিন কাল পাড়ি দিয়ে শেষ কালে এসেছি। মৃত্যুর আগে নিজের কৃতকর্মের মাফ নিয়ে মরতে চাই।'

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আপনি কি কোনো হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন বা কাউকে ধর্ষণ করেছেন_এ প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে লুৎফর রাজাকার বলেন, 'রাজাকাররা যা করেছে, আমিও তা করেছি। তবে আমি নিজে এসবে অংশ নেইনি।' কখন তিনি ভুল বুঝতে পারেন জানতে চাইলে লুৎফর রাজাকার বলেন, '১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসেই আমি আমার ভুল উপলব্ধি করেছি। যুদ্ধের পর জেলে না গেলে আমি আজ বাঁচতে পারতাম না। পাবনা জেলখানাই আমাকে বাঁচার সুযোগ করে দিয়েছিল।'

নিজামীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ প্রমাণের জন্য কী কী তথ্য আপনাদের হাতে রয়েছে_জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'অকাট্য প্রমাণ রয়েছে, যা দিয়ে নিঃসন্দেহে তাঁর যুদ্ধাপরাধ প্রমাণ করা যাবে। আমি রাজাকার ছিলাম, আমি জানি নিজামী কতটা ভয়াবহ। তাঁর পক্ষে কী করা সম্ভব। আমার কাছে এমন তথ্য-প্রমাণ আছে, যা আর কারো কাছে নেই। সেই তথ্য-প্রমাণ রাষ্ট্র ব্যবহার করতে পারে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।' সেই তথ্য-প্রমাণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'যুদ্ধাপরাধ তদন্তদল আসছে। তাদের কাছেই সব বলব। এ মুহূর্তে সেসব প্রকাশ পেলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যে তদন্তদলের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তারা বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে নিষেধ করেছে।'

তবে লুৎফর রাজাকার নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন। তিনি বলেন, এরই মধ্যে ছাত্রশিবিরের নেতারা তাঁকে হুমকি দিয়েছে। প্রথমে তারা বোঝাতে চেয়েছে, নিজামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলে বিষয়টি ধর্মের বিরুদ্ধে যাবে। পরে তারা সরাসরি হুমকি দিয়েছে। লুৎফর রহমান বলেন, 'ইতিমধ্যে প্রায় ৭০ জন আমাকে হুমকি দিয়েছে। তাদের কেউ এসে সরাসরি, কেউ বা মোবাইল ফোনে হুমকি দিয়েছে। অনেকে পরিবারের সদস্যদের শাসিয়ে গেছে।' তিনি আরো বলেন, 'নিজের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগের মধ্যে রয়েছি। কারণ তারা কতটা নৃশংস হতে পারে, তা আমি কাছে থেকে দেখেছি। এর প্রমাণ দেশবাসীও ১৯৭১ সালে দেখেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তারা থেমে নেই। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রগকাটা রাজনীতি দেখেও কি তাদের রাজনীতি বুঝতে কারো কষ্ট হয়?' এ কথা বলে আবেগসিক্ত হয়ে পড়েন লুৎফর রাজাকার।

যুদ্ধাপরাধের সাক্ষীদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে

আশরাফুল হক রাজীব ও আবদুল্লাহ আল মামুন

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তদলের কাছে যুদ্ধাপরাধের সাক্ষ্য দিয়ে হুমকির মুখে পড়ছেন অনেক সাক্ষী। অনেকে সাক্ষ্য না দিয়েও সম্ভাব্য সাক্ষী হিসেবে 'মৃত্যু পরোয়ানা' পেয়েছেন। সাক্ষীদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য এক বছর আগে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও আজও সে কাজ শেষ হয়নি। তাঁদেরকে দ্রুত রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তদন্তদল সম্প্রতি খুলনা, শেরপুর, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামের বধ্যভূমি এবং গণহত্যা সংঘটিত এলাকা পরিদর্শনের সময় শতাধিক ব্যক্তির সাক্ষ্য নেয়।

আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ গত শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে যাঁরা সাক্ষ্য দেবেন তাঁদের রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা দেওয়া হবে। এ জন্য 'উইটনেস প্রটেকশন ল' প্রণয়নের কাজ চলছে। এই আইন প্রণয়নের আগেই সাক্ষীদের নিরাপত্তার প্রয়োজন হলে সরকার তা দেবে।

উদ্যোগ নেওয়ার পর এক বছরেও এই আইন প্রণয়ন করা হয়নি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইনটির সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত। বিদেশে এ ধরনের আইনের মাধ্যমে কাউকে সুরক্ষা দেওয়া হলে শুধু তাঁর দৈহিক নিরাপত্তাই দেওয়া হয় না, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অর্থনৈতিক নিরাপত্তাও দেখা হয়। এসব বিষয় বিবেচনায় আনতে গিয়ে আইন প্রণয়নের কাজে দেরি হচ্ছে।

জানা গেছে, জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর যুদ্ধাপরাধ প্রমাণের সব আয়োজন শেষ হয়েছে। যুদ্ধাপরাধ তদন্তদল পাবনার সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলায় গেলে তাদের হাতে নিজামী ও তাঁর দোসরদের অপরাধের প্রমাণপত্র তুলে দেওয়া হবে। শিগগিরই নিজামীর যুদ্ধাপরাধ তদন্তে পাবনা যাবে তদন্তদল। তদন্তদলের সামনে নিজামীর অপরাধ প্রমাণের জন্য সাক্ষ্য দেবেন পাঁচজন। তাঁদের মধ্যে একজন রাজাকার নিজামীর বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হবেন। নিজামীর একজন নিকটাত্মীয়ও সাক্ষ্য দেবেন। এসব সাক্ষীকে অপরাধ তদন্তদলের সামনে সাক্ষ্য না দেওয়ার জন্য জামায়াত নেতারা হুমকি দিচ্ছেন। সাক্ষীরা নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, শুধু নিজামীর সাক্ষীরাই নন, সারা দেশে যাঁরাই যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছেন, তাঁদেরকেই হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যেই খুলনা, ময়মনসিংহে এ ধরনের হুমকি দেওয়া হয়েছে। তাঁদের রক্ষা করতে না পারলে যুদ্ধাপরাধের বিচার ভণ্ডুল হতে পারে। তাঁর মতে, যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে যাঁরা সাক্ষ্য দিচ্ছেন, তাঁদেরকে শুধু দৈহিক নিরাপত্তা দিলেই হবে না, তাদের অর্থনৈতিক বিষয়টাও দেখতে হবে। যখনই তাঁদের সাক্ষী করা হচ্ছে, তখনই তাঁরা তাঁদের পেশা ঠিক রাখতে পারছেন না। ব্যবসা করতে পারছেন না। চাকরি-বাকরিতে সমস্যা সৃষ্টি করা হচ্ছে। তাঁদেরকে রক্ষা করতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধে পাবনা জেলার সাঁথিয়া থানা কমান্ডার এবং বর্তমানে সাঁথিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান নিজামউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, নিজামী রাজাকার বাহিনীর কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে '৭১ সালে সারা দেশেই অপরাধ করেছেন। তবে এই অঞ্চলের মানুষ হিসেবে তিনি পাবনার বিভিন্ন গণহত্যায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখেন। নিজামউদ্দিন বলেন, 'শিগগিরই নিজামীর বিভিন্ন অপরাধের আলামত সংগ্রহে তদন্তদল আসবে বলে আমাকে জানানো হয়েছে। আমরাও সব প্রস্তুতি শেষ করে রেখেছি। নিজামীর অপরাধ প্রমাণে সাক্ষ্য দেবেন পাঁচজন। এর মধ্যে একজন রাজাকার রয়েছেন। আছেন নিজামীর নিকটাত্মীয়ও। এই পাঁচজনের বাইরেও অনেক সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করা হবে। তদন্তদলের কাছে এসব প্রমাণ হস্তান্তর করার জন্য সিডিতে ধারণ করা হয়েছে। এই সিডিই তদন্তদলের হাতে তুলে দেওয়া হবে।'

জানা গেছে, নিজামীর যুদ্ধাপরাধের পাঁচ সাক্ষীর একজন হচ্ছেন সুমিত্রা বালা সাহা। ১৯৭১ সালের ২ আগস্ট মতিউর রহমান নিজামী তাঁর নিজ গ্রাম মনমথপুর যান। সেখানে খাঁ বাড়িতে স্থানীয় রাজাকার সাত্তারকে নিয়ে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে নিজামী মুক্তিযোদ্ধা এবং হিন্দুদের তালিকা করেন। তালিকা ধরে সুমিত্রা বালার স্বামী বটেশ্বর সাহাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর মতিউর রহমান নিজামীর নির্দেশে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয় তাঁকে। ১৯৭১ সালে বটেশ্বর সাহার বয়স ছিল ২৫ বছর। গ্রামের শক্ত সুঠাম দেহের যুবক বটেশ্বর ব্যবসা করতেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে এলাকায় মিছিল-মিটিং করতেন। সাঁথিয়া-বেড়া-বাঘাবাড়ী সর্বত্র তাঁর দরাজ স্লোগানে মুখরিত থাকত। বটেশ্বর সাহার হত্যাকাণ্ডে নিজামীর জড়িত থাকার ঘটনা তদন্তদলের সামনে তুলে ধরবেন সুমিত্রা বালা সাহা। নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন পাবনা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা।

নিজামীর প্ররোচনায় রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন লুৎফর রহমান (লুৎফর রাজাকার বলে পরিচিত)। নিজামীর নির্দেশে তিনি বিভিন্ন অভিযানে অংশ নেন। সেই লুৎফর রাজাকারও সাক্ষ্য দেবেন নিজামীর বিরুদ্ধে। রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর যেসব অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন সেই সব অভিযানের 'শিকারদের' হাজির করা হবে যুদ্ধাপরাধ তদন্তদলের সামনে। লুৎফর রাজাকার কালের কণ্ঠকে বলেন, বিষয়টি টের পেয়ে একটি মহল তাঁকে হত্যার হুমকি দিয়েছে এবং তিনি বিষয়টি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে জানিয়েছেন।

এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু কালের কণ্ঠকে বলেন, যাঁরা সাক্ষী দেবেন, তাঁদের দায়িত্ব পুলিশ নেবে। মুক্তিযোদ্ধা এবং আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক তথ্যমন্ত্রী আবু সাঈদ গত বৃহস্পতিবার তাঁর পাবনার বাড়িতে কালের কণ্ঠকে বলেন, নিজামীর অপরাধ প্রমাণের সব কাজই শেষ হয়েছে। তবে সমস্যা দেখা দিয়েছে সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিয়ে। সাক্ষীরা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। পাবনার প্রশাসন এখনো জামায়াতে ইসলামীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এ কারণে তাঁদের ভয় আরো বেশি।

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত করার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তদল ইতিমধ্যেই চারটি স্থান পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষ্য নিয়েছে। অনেক জায়গায় তাঁদের সহায়তা করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনজীবী প্যানেল। ২০ মে খুলনার চুকনগরে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্তের মাধ্যমে অনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ২০ মে কয়েক ঘণ্টায় চুকনগরে ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। তদন্ত ও আইনজীবী দলের সামনে সেই হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী দিয়েছেন ২০ জন প্রত্যক্ষদর্শী। তদন্তদলের কাছে ডুমুরিয়া উপজেলার মাগুরখালী ইউনিয়নের আলাদীপুর গ্রামের সরস্বতী মণ্ডল যখন তাঁর স্বামী ও শ্বশুরের হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেন, তখন হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। হত্যাকাণ্ডের লোমহর্ষক বর্ণনা দেওয়ার জন্য সরস্বতী মণ্ডলকে ইতিমধ্যেই শাসানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তদল ১৫ সেপ্টেম্বর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জনের সাক্ষ্য নিতে শেরপুর যায়। কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী। সাক্ষ্য দিয়ে শেরপুরের টর্চার সেলের দারোয়ান মোহন মুন্সী সেদিন তদন্তদলকে বলেন, কামারুজ্জামান বদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন। শেরপুর থানায় তিনি যা বলতেন তা-ই হতো। সেই মোহন মুন্সীকেও হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। শেরপুর থেকে তদন্তদল যায় ময়মনসিংহে। সেখানে গিয়ে সাক্ষ্য নেওয়া হয় ৩০ জনের। তাঁদের মধ্যে অনেকেই ইসলামী ছাত্রশিবির নেতা-কর্মীদের হুমকি পেয়েছেন।

তদন্তদল ২৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের রাউজান সফরে গিয়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন গণহত্যায় বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে। তদন্তদলের সামনে সাক্ষ্য দিয়েছেন শহীদ অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্রের ছেলে প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ। এ ছাড়া জ্যোৎস্না প্রভা চৌধুরীসহ আরো অনেকে সাকা চৌধুরীর অপকর্ম তুলে ধরেন। তদন্তদল রাউজানে সাক্ষ্য নেওয়ার সময় ৫০-৬০ জনের একটি দল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে সাফাই গাইতে থাকে। তারা সাকা চৌধুরীর পক্ষে হৈচৈ করতে থাকলে পুলিশ তাদের তাড়িয়ে দেয়। পুলিশের তাড়া খেয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করার সময় তারা সাক্ষীদের হুমকি দিয়েছে বলে জানা গেছে।

30 July 2010

পাবনায় জামায়াত নেতা কলেজ পরিচালনা পরিষদ থেকে বাদ

পাবনা অফিস | তারিখ: ৩০-০৭-২০১০

যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে পাবনার ইমাম গাজ্জালী স্কুল অ্যান্ড কলেজ পরিচালনা পরিষদ থেকে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুস সোবাহানকে বাদ দিয়ে নতুন কমিটি ঘোষণা করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড রাজশাহী। পাবনা-৫ আসনের সাংসদ গোলাম ফারুক খোন্দকারের এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বোর্ড কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্ত নেয়।

গত ১৯ জুন সাংসদ তাঁর আবেদনে রাজশাহীর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডকে জানান, পাবনা-৫ নির্বাচনী এলাকায় অবস্থিত ইমাম গাজ্জালী স্কুল অ্যান্ড কলেজটি বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময় থেকে স্বাধীনতা বিরোধীদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। ওই সময় থেকে প্রতিষ্ঠানটির সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী ও জামায়াত নেতা মাওলানা আব্দুস সোবাহান। যাকে ধর্ষণ, লুটপাট, হত্যা ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে সরকার যুদ্ধাপরাধের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। কাজেই ওই প্রতিষ্ঠান থেকে এই জামায়াত নেতাকে বাদ দেওয়া উচিত।