আশরাফুল হক রাজীব ও আবদুল্লাহ আল মামুন
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তদলের কাছে যুদ্ধাপরাধের সাক্ষ্য দিয়ে হুমকির মুখে পড়ছেন অনেক সাক্ষী। অনেকে সাক্ষ্য না দিয়েও সম্ভাব্য সাক্ষী হিসেবে 'মৃত্যু পরোয়ানা' পেয়েছেন। সাক্ষীদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য এক বছর আগে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও আজও সে কাজ শেষ হয়নি। তাঁদেরকে দ্রুত রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তদন্তদল সম্প্রতি খুলনা, শেরপুর, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামের বধ্যভূমি এবং গণহত্যা সংঘটিত এলাকা পরিদর্শনের সময় শতাধিক ব্যক্তির সাক্ষ্য নেয়।
আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ গত শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে যাঁরা সাক্ষ্য দেবেন তাঁদের রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা দেওয়া হবে। এ জন্য 'উইটনেস প্রটেকশন ল' প্রণয়নের কাজ চলছে। এই আইন প্রণয়নের আগেই সাক্ষীদের নিরাপত্তার প্রয়োজন হলে সরকার তা দেবে।
উদ্যোগ নেওয়ার পর এক বছরেও এই আইন প্রণয়ন করা হয়নি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইনটির সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত। বিদেশে এ ধরনের আইনের মাধ্যমে কাউকে সুরক্ষা দেওয়া হলে শুধু তাঁর দৈহিক নিরাপত্তাই দেওয়া হয় না, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অর্থনৈতিক নিরাপত্তাও দেখা হয়। এসব বিষয় বিবেচনায় আনতে গিয়ে আইন প্রণয়নের কাজে দেরি হচ্ছে।
জানা গেছে, জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর যুদ্ধাপরাধ প্রমাণের সব আয়োজন শেষ হয়েছে। যুদ্ধাপরাধ তদন্তদল পাবনার সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলায় গেলে তাদের হাতে নিজামী ও তাঁর দোসরদের অপরাধের প্রমাণপত্র তুলে দেওয়া হবে। শিগগিরই নিজামীর যুদ্ধাপরাধ তদন্তে পাবনা যাবে তদন্তদল। তদন্তদলের সামনে নিজামীর অপরাধ প্রমাণের জন্য সাক্ষ্য দেবেন পাঁচজন। তাঁদের মধ্যে একজন রাজাকার নিজামীর বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হবেন। নিজামীর একজন নিকটাত্মীয়ও সাক্ষ্য দেবেন। এসব সাক্ষীকে অপরাধ তদন্তদলের সামনে সাক্ষ্য না দেওয়ার জন্য জামায়াত নেতারা হুমকি দিচ্ছেন। সাক্ষীরা নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, শুধু নিজামীর সাক্ষীরাই নন, সারা দেশে যাঁরাই যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছেন, তাঁদেরকেই হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যেই খুলনা, ময়মনসিংহে এ ধরনের হুমকি দেওয়া হয়েছে। তাঁদের রক্ষা করতে না পারলে যুদ্ধাপরাধের বিচার ভণ্ডুল হতে পারে। তাঁর মতে, যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে যাঁরা সাক্ষ্য দিচ্ছেন, তাঁদেরকে শুধু দৈহিক নিরাপত্তা দিলেই হবে না, তাদের অর্থনৈতিক বিষয়টাও দেখতে হবে। যখনই তাঁদের সাক্ষী করা হচ্ছে, তখনই তাঁরা তাঁদের পেশা ঠিক রাখতে পারছেন না। ব্যবসা করতে পারছেন না। চাকরি-বাকরিতে সমস্যা সৃষ্টি করা হচ্ছে। তাঁদেরকে রক্ষা করতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধে পাবনা জেলার সাঁথিয়া থানা কমান্ডার এবং বর্তমানে সাঁথিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান নিজামউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, নিজামী রাজাকার বাহিনীর কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে '৭১ সালে সারা দেশেই অপরাধ করেছেন। তবে এই অঞ্চলের মানুষ হিসেবে তিনি পাবনার বিভিন্ন গণহত্যায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখেন। নিজামউদ্দিন বলেন, 'শিগগিরই নিজামীর বিভিন্ন অপরাধের আলামত সংগ্রহে তদন্তদল আসবে বলে আমাকে জানানো হয়েছে। আমরাও সব প্রস্তুতি শেষ করে রেখেছি। নিজামীর অপরাধ প্রমাণে সাক্ষ্য দেবেন পাঁচজন। এর মধ্যে একজন রাজাকার রয়েছেন। আছেন নিজামীর নিকটাত্মীয়ও। এই পাঁচজনের বাইরেও অনেক সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করা হবে। তদন্তদলের কাছে এসব প্রমাণ হস্তান্তর করার জন্য সিডিতে ধারণ করা হয়েছে। এই সিডিই তদন্তদলের হাতে তুলে দেওয়া হবে।'
জানা গেছে, নিজামীর যুদ্ধাপরাধের পাঁচ সাক্ষীর একজন হচ্ছেন সুমিত্রা বালা সাহা। ১৯৭১ সালের ২ আগস্ট মতিউর রহমান নিজামী তাঁর নিজ গ্রাম মনমথপুর যান। সেখানে খাঁ বাড়িতে স্থানীয় রাজাকার সাত্তারকে নিয়ে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে নিজামী মুক্তিযোদ্ধা এবং হিন্দুদের তালিকা করেন। তালিকা ধরে সুমিত্রা বালার স্বামী বটেশ্বর সাহাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর মতিউর রহমান নিজামীর নির্দেশে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয় তাঁকে। ১৯৭১ সালে বটেশ্বর সাহার বয়স ছিল ২৫ বছর। গ্রামের শক্ত সুঠাম দেহের যুবক বটেশ্বর ব্যবসা করতেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে এলাকায় মিছিল-মিটিং করতেন। সাঁথিয়া-বেড়া-বাঘাবাড়ী সর্বত্র তাঁর দরাজ স্লোগানে মুখরিত থাকত। বটেশ্বর সাহার হত্যাকাণ্ডে নিজামীর জড়িত থাকার ঘটনা তদন্তদলের সামনে তুলে ধরবেন সুমিত্রা বালা সাহা। নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন পাবনা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা।
নিজামীর প্ররোচনায় রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন লুৎফর রহমান (লুৎফর রাজাকার বলে পরিচিত)। নিজামীর নির্দেশে তিনি বিভিন্ন অভিযানে অংশ নেন। সেই লুৎফর রাজাকারও সাক্ষ্য দেবেন নিজামীর বিরুদ্ধে। রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর যেসব অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন সেই সব অভিযানের 'শিকারদের' হাজির করা হবে যুদ্ধাপরাধ তদন্তদলের সামনে। লুৎফর রাজাকার কালের কণ্ঠকে বলেন, বিষয়টি টের পেয়ে একটি মহল তাঁকে হত্যার হুমকি দিয়েছে এবং তিনি বিষয়টি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু কালের কণ্ঠকে বলেন, যাঁরা সাক্ষী দেবেন, তাঁদের দায়িত্ব পুলিশ নেবে। মুক্তিযোদ্ধা এবং আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক তথ্যমন্ত্রী আবু সাঈদ গত বৃহস্পতিবার তাঁর পাবনার বাড়িতে কালের কণ্ঠকে বলেন, নিজামীর অপরাধ প্রমাণের সব কাজই শেষ হয়েছে। তবে সমস্যা দেখা দিয়েছে সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিয়ে। সাক্ষীরা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। পাবনার প্রশাসন এখনো জামায়াতে ইসলামীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এ কারণে তাঁদের ভয় আরো বেশি।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত করার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তদল ইতিমধ্যেই চারটি স্থান পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষ্য নিয়েছে। অনেক জায়গায় তাঁদের সহায়তা করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনজীবী প্যানেল। ২০ মে খুলনার চুকনগরে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্তের মাধ্যমে অনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ২০ মে কয়েক ঘণ্টায় চুকনগরে ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। তদন্ত ও আইনজীবী দলের সামনে সেই হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী দিয়েছেন ২০ জন প্রত্যক্ষদর্শী। তদন্তদলের কাছে ডুমুরিয়া উপজেলার মাগুরখালী ইউনিয়নের আলাদীপুর গ্রামের সরস্বতী মণ্ডল যখন তাঁর স্বামী ও শ্বশুরের হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেন, তখন হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। হত্যাকাণ্ডের লোমহর্ষক বর্ণনা দেওয়ার জন্য সরস্বতী মণ্ডলকে ইতিমধ্যেই শাসানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তদল ১৫ সেপ্টেম্বর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জনের সাক্ষ্য নিতে শেরপুর যায়। কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী। সাক্ষ্য দিয়ে শেরপুরের টর্চার সেলের দারোয়ান মোহন মুন্সী সেদিন তদন্তদলকে বলেন, কামারুজ্জামান বদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন। শেরপুর থানায় তিনি যা বলতেন তা-ই হতো। সেই মোহন মুন্সীকেও হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। শেরপুর থেকে তদন্তদল যায় ময়মনসিংহে। সেখানে গিয়ে সাক্ষ্য নেওয়া হয় ৩০ জনের। তাঁদের মধ্যে অনেকেই ইসলামী ছাত্রশিবির নেতা-কর্মীদের হুমকি পেয়েছেন।
তদন্তদল ২৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের রাউজান সফরে গিয়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন গণহত্যায় বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে। তদন্তদলের সামনে সাক্ষ্য দিয়েছেন শহীদ অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্রের ছেলে প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ। এ ছাড়া জ্যোৎস্না প্রভা চৌধুরীসহ আরো অনেকে সাকা চৌধুরীর অপকর্ম তুলে ধরেন। তদন্তদল রাউজানে সাক্ষ্য নেওয়ার সময় ৫০-৬০ জনের একটি দল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে সাফাই গাইতে থাকে। তারা সাকা চৌধুরীর পক্ষে হৈচৈ করতে থাকলে পুলিশ তাদের তাড়িয়ে দেয়। পুলিশের তাড়া খেয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করার সময় তারা সাক্ষীদের হুমকি দিয়েছে বলে জানা গেছে।