Showing posts with label পুলিশ. Show all posts
Showing posts with label পুলিশ. Show all posts

13 February 2010

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ঃ রহস্যঘেরা সেই এক ঘণ্টার জবাব কী?




মলয় ভৌমিক | তারিখ: ১৪-০২-২০১০


সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গনের স্বপ্ন-পর্দায় ভুসি-কালো রং ছিটিয়ে এবার চলে গেলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের ছাত্র ফারুক হোসেন। ফারুকের মা-বাবা জয়পুরহাটের গ্রামে বসে তাঁর মেধাবী সন্তানকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখছিলেন, তার ওপরও ছাই রং চাপিয়ে দিল শিবিরের বর্বর বাহিনী। আগে থেকেই পথে বসা এই পরিবারকে ফারুকের লাশের মতোই যেন এবার সেপটিক ট্যাংকের আঁধারে ঠেলে ফেলে দেওয়া হলো। অথচ আমরা আগের মতো এবারও নির্বিকার; মিনমিন করে সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গনের চিত্কার করে যাচ্ছি, অন্যদিকে প্রতিনিয়ত একেকটি পরিবারের স্বপ্ন হচ্ছে বিবর্ণ।

শিক্ষাঙ্গনে শিবির কী করছে, তাদের নৃশংস কৌশলের গতিপ্রকৃতি কী, তা তো সবার জানা। কিন্তু প্রতিকারের ব্যবস্থাতেই কেবল ফাঁকা বুলি। ফারুকের বেলায় যা ঘটল, তাকে কী বলা যাবে? সে কি কেবল ফ্যাসিস্ট শিবিরের বর্বর জিঘাংসারই শিকার, নাকি এর আড়ালে আমাদের রাজনীতির ভেতরের কদর্য চেহারারও দায় আছে কিছুটা?

১০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবনে পুলিশের আইজির উপস্থিতিতে ঘটনার আড়ালের ঘটনার যে বর্ণনা মেলে, তাতে তো বলা যায় ফারুককে হত্যাকারীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। হল প্রাধ্যক্ষ, হাউস টিউটর, প্রক্টর, সহকারী প্রক্টরসহ প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষকেরা ঘটনার যে বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তাতে গোটা ব্যাপারটি যেমন রহস্যময় হয়ে ওঠে, তেমনি সেই রহস্যের গিঁটগুলো কিছুটা আলগাও হয়ে পড়ে।

৮ ফেব্রুয়ারি রাত পৌনে আটটায় বঙ্গবন্ধু হলে শিবিরের ছাত্ররা ছাত্রলীগের দুজন কর্মীর ওপর চড়াও হলো। হলের সিট দখলকে কেন্দ্র করে এই ঘটনা। সিটের বিষয়টি ছুতোমাত্র, যা পরে বোঝা যায়। বঙ্গবন্ধু হলে ছাত্রলীগের দুজন কর্মী আহত হলে পুলিশ ছাত্রশিবিরের কয়েকজনকে আটক করে। এতে অন্যান্য হলে ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা। প্রশাসনের লোকজন হলে হলে যান। অতিরিক্ত পুলিশ, র্যাবও মোতায়েন করা হয়। হল প্রাধ্যক্ষ ও প্রক্টর, সহকারী প্রক্টররা জানাচ্ছেন, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বিনোদপুর, বুধপাড়ার কাছে গণকবর এবং স্টেশন এলাকায় ছাত্রশিবির ও তাদের বহিরাগত ক্যাডাররা অস্ত্রসস্ত্রসহ সমবেত হতে থাকে। ক্যাম্পাসে উপস্থিত রাজশাহীর পুলিশ কমিশনারকে তখনই প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই তথ্য লিখিতভাবে জানানো হয়। কিন্তু পুলিশ কমিশনার সবকিছু তাঁদের নিয়ন্ত্রণে আছে বলে সবাইকে আশ্বস্ত করেন। তাঁর আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে রাত ১২টার দিকে হল প্রশাসনের লোকজন চলে যান বাসায়। এর আগে এস এম হলের প্রাধ্যক্ষ ও কয়েকজন সহকারী প্রক্টর ওই হলে পাহারারত পুলিশ সদস্যদের কাছে নিহত ফারুকসহ ছাত্রলীগের ১১ জন কর্মীকে রেখে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলেছিলেন। পুলিশও তাঁদের আশ্বস্ত করে জানিয়েছিল, যেকোনো মূল্যে ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।

‘সবকিছু নিয়ন্ত্রণে’, ‘যেকোনো মূল্যে ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে’—পুলিশের এমন বক্তব্যের পর সেই রাতে যা ঘটতে থাকে তা রহস্যে ঢাকা। পুলিশ কমিশনার ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাওয়ার কিছু সময় পরেই অর্থাত্ রাত একটার পরপর বাইরে থেকে সশস্ত্র শিবিরকর্মীরা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে। তারা বিনা বাধায় হলে হলে ঢুকে তাণ্ডব চালায়। প্রায় সব হলের প্রাধ্যক্ষ একই সুরে অভিযোগ করেছেন, হলগেটের তালাগুলো শিবিরের ক্যাডারদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল এবং প্রায় একই সঙ্গে সবগুলো হলের পাহারারত পুলিশও হল ছেড়ে অনত্র চলে গিয়েছিল। ফারুক হোসেনকে যে হলে হত্যা করা হয়েছে, সেই এস এম হল ছাত্রলীগের ১১ জন কর্মী অভিযোগ করেছে, পুলিশ চলে যাওয়ার সময় তাদের পা জড়িয়ে ধরে চলে না যাওয়ার জন্য আকুতি জানিয়েছিল অনেকেই। কিন্তু পুলিশ তাতে কর্ণপাত করেনি।

এস এম হল, লতিফ হল ও আমির আলী হল তিনটির সম্মুখ ফটক একই চত্বরের তিন দিকে। ঘটনার মাত্র কয়েক মিনিট আগে ওই চত্বরে পুলিশ ও র্যাবের বিপুলসংখ্যক সদস্য টহল দিচ্ছিলেন বলে সহকারী প্রক্টররা জানিয়েছেন। এই তিন হলেই তাণ্ডব চলে সব থেকে বেশি। কোন কারণে এই তিন হল এলাকা থেকে টহলরত বিপুলসংখ্যক পুলিশ একটি নির্দিষ্ট সময়ে উধাও হয়ে গেল, সেটিও একটি প্রশ্ন বটে। একাধিক হলপ্রাধ্যক্ষ এ অভিযোগও করেছেন যে ঘটনার শেষে হলে পাহারারত পুলিশ সদস্যদের কাছ থেকে তাঁরা জানতে পেরেছেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশের কারণেই তাঁরা হল ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন এবং হলের গেট খুলে দিয়েছিলেন। এই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কে বা কারা, তার হদিস কিন্তু এখন পর্যন্ত মেলেনি। প্রায় সব হল-প্রাধ্যক্ষের বক্তব্য থেকে আরও একটি অদ্ভুত তথ্য মেলে। প্রায় সব হলেই একটি নির্দিষ্ট সময় পর হল ছেড়ে চলে যাওয়া পুলিশ আবার একই সাথে ফিরে আসে।

বিভিন্ন তথ্য থেকে দেখা যায়, পুলিশের হল ছেড়ে চলে যাওয়া এবং পুনরায় হলে প্রবেশ করার এই সময়টা মোটামুটি রাত দেড়টা থেকে আড়াইটা। অর্থাত্ এক ঘণ্টা বা তার কিছু বেশি। এই এক ঘণ্টা বা সোয়া ঘণ্টায় আরও কটি ঘটনা ঘটে। উপাচার্য ও প্রক্টর জানাচ্ছেন, এই সময়ে অনেকবার টেলিফোনে যোগাযোগ করেও পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে তাঁরা কোনো কথা বলতে পারেননি। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এই একই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো কৌশলগত পয়েন্ট ছিল অরক্ষিত। আবার শহীদ শামসুজ্জোহা হল, সোহরাওয়ার্দী হল ও জিয়া হলের প্রাধ্যক্ষরা জানাচ্ছেন, তাঁদের হলগুলোতে প্রহরারত পুলিশের সাহসী ভূমিকার কারণে অনেক চেষ্টা করেও শিবিরের ক্যাডাররা এই সময়ে ভেতরে ঢুকতে পারেনি। আরও একটি ঘটনার কথাও জানা যায়। শহর থেকে গাড়ি পাঠিয়ে এই সময়ে কোনো কোনো হল থেকে আক্রান্ত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব হয়েছে।

এখন গোটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেকগুলো গুরুতর প্রশ্ন উঠে আসছে। প্রথমত, শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডাররা ক্যাম্পাসের নানা পয়েন্টে সমবেত হয়েছে—এ তথ্য জানার পরও ‘সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আছে’ বলে পুলিশ কী করে সবাইকে আশ্বস্ত করল? দ্বিতীয়ত, কী কারণে একটি নির্দিষ্ট সময়ে অধিকাংশ হল থেকে পুলিশ গেট খুলে রেখে বেরিয়ে গেল এবং নির্দিষ্ট সময় পরে ফিরে এল? তৃতীয়ত, পুলিশ কনস্টেবলদের হল ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশদাতা কে বা কারা? চতুর্থত, কেন ওই নির্দিষ্ট সময়ে উপাচার্য বারবার চেষ্টা করেও পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা বলতে পারলেন না? পঞ্চমত, কয়েকটি হলে পুলিশ সাহসী ভূমিকা পালন করলেও অন্য হল থেকে পুলিশের চলে যাওয়ার রহস্যই বা কী? ষষ্ঠত, কোনো কোনো হল থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের উদ্ধার করা গেলেও, সব হল থেকে তাদের উদ্ধার করা গেল না কেন? এসব প্রশ্ন যেমন গুরুতর, তেমনি এর উত্তর পাওয়াটাও জরুরি।

প্রশ্ন আছে আরও। আইজিপি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ঘটনাটি ছিল পরিকল্পিত। কিন্তু এই পরিকল্পনা তো এক দিনে বসে হয়নি। জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের মেসগুলোকে প্রায় এক মাস আগে থেকেই শিবিরের কর্মীরা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল। প্রশ্ন হলো, গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন কি এই খবর রাখতেন না? উপাচর্যের বাসভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে রাজশাহীর পুলিশ কমিশনার আইজিপিকে জানান, শিবিরের ক্যাডারদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন ছিল। টিয়ার গ্যাস ছাড়াও তাঁরা শর্টগান থেকে অসংখ্য গুলি ছুড়েছেন। এ সময় আইজিপি পুলিশ কমিশনারকে প্রশ্ন করেন, তাহলে শিবিরের কেউ আহত হলো না কেন? কেন গভীর রাতের ওই ঘটনার সময় শিবিরের কাউকেই গ্রেপ্তার করা গেল না? (অবশ্য ঘটনার পরদিন দুপুরে পুলিশ সংস্কৃতিকর্মীসহ অনেক সাধারণ ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে, যাদের অনেককেই এখনো ছেড়ে দেওয়া হয়নি।)

অন্যান্য প্রশ্নের মতো আইজিপির এই তাত্পর্যপূর্ণ প্রশ্নের জবাব খোঁজাও খুবই জরুরি।

সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনায় বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া তথা দেশে যখন সামপ্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের রায় যখন কার্যকর হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর ব্যাপারটি যখন প্রক্রিয়াধীন, তখন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি মরিয়া হয়ে মাঠে নামবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই শক্তিকে মোকাবিলার ক্ষেত্রে যদি কোনো রহস্যময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যদি থাকে ভেতরের কোনো গলদ অথবা এসব ঘটনাকে কেউ যদি ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করে, তাহলে লক্ষ্যে পৌঁছা যাবে না কখনোই।

বলার অপেক্ষা রাখে না, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়ে মানুষকে ভয় দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। চেষ্টা হয়েছে ক্ষমতাসীন সরকারকে নিজেদের শক্তি সম্পর্কে জানান দেওয়ার। কিন্তু এতে তারা লাভবান হয়েছে বলে মনে হয় না, বরং মানুষ ওই অপশক্তির বিরুদ্ধে আজ অনেক বেশি সোচ্চার হয়েছে। এখন প্রয়োজন মানুষের এই সাহস ও শক্তি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার, প্রয়োজন ঐক্যের। আর ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ যেন এই ঐক্যকে বিনষ্ট করতে না পারে, তার জন্যই দরকার ভেতরে কোনো গলদ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা। সরকার এ ক্ষেত্রে বিচক্ষণতার পরিচয় দেবে, এটাই প্রত্যাশা।

মলয় ভৌমিক: শিক্ষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নাট্যকার।


খবরের লিংক

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সহিংসতাঃ অস্ত্র উদ্ধার, ২ শিবির কর্মী আটক, ৯ ছাত্রলীগ কর্মী বহিষ্কৃত



রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি | তারিখ: ১৩-০২-২০১০


পুলিশ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক হল থেকে আজ শনিবার দুপুর ১২টায় দুটি চাপাতি ও অবিস্ফোরিত দুটি ককটেল উদ্ধার করেছে। একই সময় শহীদুল্লাহ কলা ভবনের সামনে থেকে পুলিশ দুজন সন্দেহভাজন ইসলামী ছাত্রশিবির কর্মীকে আটক করে। তাঁরা হচ্ছেন ইংরেজি বিভাগের স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র ফয়সাল ও শাকিল।

এদিকে গত বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত নয়জন ছাত্রলীগ কর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ছাত্রলীগের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আওয়াল কবির ওরফে জয় স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় দল থেকে জুয়েল, রকি, রনি, মিন্নাত, দেলোয়ার হোসেন, বিল, মাসুদ, নয়ন ও মনির নামের নয়জন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

আজ বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবনের লাউঞ্জে এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে উপাচার্য আবদুস সোবহান ৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহিংস ঘটনার জন্য দায়িত্ব পালনে পুলিশের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন। ছাত্রদের রক্ষা করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট আন্তরিক ছিল বলে তিনি দাবি করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি এখন শান্ত। আজ থেকে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা থাকলেও, অধিকাংশ বিভাগেই আজ ক্লাস হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও আবাসিক হলগুলো ফাঁকা ছিল। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই বাড়ি চলে গেছে। ক্যাম্পাসে এখনো পুলিশ মোতায়েন আছে।

উল্লেখ্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের হামলায় নিহত এক ছাত্রলীগ কর্মীর লাশ ৯ ফেব্রুয়ারি ভোরে উদ্ধার করা হয়। তাঁর নাম ফারুক হোসেন। ৮ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে পরের দিন ভোর পর্যন্ত দফায় দফায় চলা সংঘর্ষে আহত হয় পুলিশসহ ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের প্রায় অর্ধশত নেতা-কর্মী। হামলার সময় শিবির ক্যাডাররা ছাত্রলীগ কর্মী বাদশা, রুহুল আমিন ও ফিরোজের হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়।


খবরের লিংক

10 February 2010

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের ভূমিকায় ক্ষোভঃ পুলিশ কমিশনার ঘুমাচ্ছিলেন!

আনু মোস্তফা, রাজশাহী

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকায় জামায়াত শিবিরের বহিরাগত সশস্ত্র ক্যাডাররা জড়ো হচ্ছে এবং তারা ক্যাম্পাসে ঢোকার চেষ্টা করবে, এ আশঙ্কার আভাস আগেই পেয়ে তা পুলিশকে জানিয়েছিলেন উপাচার্য ড. এম সোবহান। রাজশাহীর পুলিশ কমিশনার মো. নওশের আলীও উপাচার্যকে আশ্বস্ত করেছিলেন এই বলে যে, 'পুলিশ ক্যাম্পাসের প্রতিটি পয়েন্টে সক্রিয় অবস্থানে আছে। আপনার আশঙ্কার কোনো কারণ নেই। শিবির বহিরাগতদের নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারবে না।' এই বলে পুলিশ কমিশনার বাসায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। এর পর পরই শিবিরের ক্যাডাররা ক্যাম্পাসে ঢুকে তাণ্ডব ও হত্যাকাণ্ড চালায়।

সোমবার গভীর রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশের দায়িত্বশীলতা নিয়ে গতকাল বুধবার দুপুরে সাংবাদিকদের এভাবেই বর্ণনা দিচ্ছিলেন উপাচার্যসহ প্রক্টর ও প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা। সবার একটাই কথা, 'আমরা তো ঘটনা আঁচ করতে পেরে আগেই পুলিশকে সতর্ক করেছিলাম। কিন্তু পুলিশ করলোটা কী?'

এ প্রশ্ন এখন অনেকের। উপাচার্য ড. এম সোবহান বলেন, 'সোমবার রাত ৮টার দিকে বঙ্গবন্ধু হলে ছাত্রলীগ কর্মী আসাদ ও কাওসার শিবির ক্যাডারদের হামলায় গুরুতর আহত হওয়ার পর পরই আমি পুলিশ কমিশনারসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ক্যাম্পাস পরিস্থিতি সবিস্তারে অবহিত করি। পুলিশ কমিশনার ফোর্সসহ ভিসি লাউঞ্জে আসেন। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্টে ও আবাসিক হলগুলোর সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। রাত সাড়ে ৯টার দিকে বঙ্গবন্ধু হলে পুলিশ আংশিক তল্লাশি করে। প্রতিটি হলের প্রভোস্ট ও হাউস টিউটরদের নিজ নিজ হলে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়। সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল।'

উপাচার্যসহ রাবি প্রশাসনের কর্মকর্তারা আরো জানান, কিন্তু রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী বিনোদপুর, কুখণ্ডি, কাটাখালী, মেহেরচণ্ডি প্রভৃতি এলাকায় বসবাসকারী শিক্ষক ও কর্মচারীরা ফোন করে জানান, বহিরাগত শিবির ক্যাডাররা এসব এলাকায় জড়ো হচ্ছে। তারা সুযোগ বুঝে বিভিন্ন গেট দিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকে তাণ্ডব চালাতে পারে। বহিরাগতদের সংগঠিত করছে বিভিন্ন হলের শিবির ক্যাডাররা_এ খবরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আসতে থাকে।

রাবি প্রশাসনের সূত্রগুলো আরো জানায়, সোমবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে তাদের কাছে খবর আসে শিবিরের জাফর বাবু, সালেকীন ও হামিমের নেতৃত্বে শতাধিক ক্যাডার বিনোদপুরে খোরশেদ নামের এক জামায়াত নেতার বাড়ির সামনে জড়ো হচ্ছে। বিনোদপুর এলাকায় ছাত্রাবাসে বসবাসকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রও ফোন করে সহকারী প্রক্টরদের এ তথ্য জানান। এ ছাড়া শিবির ক্যাডার শাহীনের নেতৃত্বে শতাধিক বহিরাগত বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনের কাছে এবং মেহেরচণ্ডি ও বুথপাড়ায় আরো ক্যাডার জড়ো হচ্ছে_এসব খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক উপাচার্যকে অবহিত করেন প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা।

উপাচার্য বলেন, ''এসব খবর আমি সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ কমিশনারকে জানিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে অভিযান পরিচালনার অনুরোধ করি। পুলিশ কমিশনার এ সময় ক্যাম্পাসে বঙ্গবন্ধু হলের সামনে অবস্থান করছিলেন। তিনি শুধু 'দেখছি' বলে আমাকে আশ্বস্ত করেন।''

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, ওই রাত সাড়ে ১০টার দিকে আমিসহ প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা হলগুলোর অবস্থা দেখার জন্য একযোগে বের হই। প্রথমে বঙ্গবন্ধু হল দিয়ে শুরু করে আমরা রাত সাড়ে ১১টার দিকে এসএম (শাহ মুখদুম) হলে গিয়ে পেঁৗছাই। হলের নিচতলায় টিভি রুমে ফারুক হোসেনসহ ১৫-১৬ জন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীকে দেখতে পাই। এ সময় তাদের খুব ভয়ার্ত দেখাচ্ছিল। তাদের আশপাশে ঘোরাঘুরি করছিল হলে অবস্থানকারী বেশ কয়েকজন শিবির ক্যাডার। প্রক্টর বলেন, 'ফারুক আমাকে বলেছিল, 'স্যার, আমাদের চলে যেতে দেন। পরিস্থিতি ভালো মনে হচ্ছে না। শিবির ক্যাডাররা হলের ভেতরেই অবস্থান করছে। পারলে হল রেইড করুন।' প্রক্টর আরো বলেন, 'এ অবস্থায় আমরা হলগেটে কর্তব্যরত পুলিশদের বলি, প্রয়োজন হলে এসব ছাত্রের নিরাপত্তা দিতে পারবেন? তাদের একজন আমাদের বলেন, আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারেন স্যার, আগে আমাদের জীবন যাবে, পরে ছাত্রদের গায়ে কেউ আঁচড় দিতে পারবে। কোনো চিন্তা করবেন না স্যার। আপনারা চলে যান।'

প্রক্টর জানান, 'এসএম হল পরিস্থিতি দেখে আমরা পাশাপাশি আমীর আলী ও সামনের লতিফ হল পরিদর্শন করি। এ তিনটি হলের মাঝখানে এ সময় রাজশাহী পুলিশের উপকমিশনার সরদার নুরুল আমীন, এসি হুমায়ুন কবির, জাহাঙ্গীর, এসি তারেক ও র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা ফোর্সসহ অবস্থান করছিলেন। ক্যাম্পাস পরিস্থিতি শান্ত দেখে আমরা সবাই রাত দেড়টার দিকে ভিসি লাউঞ্জে ফিরে যাই। সেখানে বিভিন্ন হলের প্রভোস্টরা অবস্থান করছিলেন।'

উপাচার্য ড. এম সোবহান আরো বলেন, 'রাত সাড়ে ১২টার দিকে ভিসি লাউঞ্জে বসে পুলিশ কমিশনারকে ক্যাম্পাসের আশপাশের এলাকায় শিবির ক্যাডারদের সমবেত হওয়ার কথাটি আমি আবারও অবহিত করি। তিনি আমাকে বারবারই আশ্বস্ত করে বলেন, ক্যাম্পাস পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে আছে। পুলিশও সজাগ আছে। কোথাও কিছু হবে না। পুলিশ কমিশনার ক্যাম্পাস থেকে বিদায় নেওয়ার সময় আমাকে আবারও আশ্বস্ত করে বলেন, রাতে কোনো কিছু ঘটার আশঙ্কা নেই।'

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পুলিশ কমিশনার ক্যাম্পাস ত্যাগ করার পর রাত আনুমানিক ১টার দিকে পুলিশের বেশকিছু গাড়ি কাজলা গেট দিয়ে বাইরে চলে যায়। অতিরিক্ত পুলিশ ক্যাম্পাস ছেড়ে যাচ্ছে, এটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কোনো পুলিশ কর্মকর্তাই আগে জানাননি। উপাচার্য বলেন, 'পুলিশ ক্যাম্পাস ছেড়ে যাচ্ছে জানলে আমি অবশ্যই নিষেধ করতাম।'

প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা জানান, অতিরিক্ত পুলিশ চলে যাওয়ার আধাঘণ্টা পর রাত আনুমানিক ১টা ৫০ মিনিটের দিকে বিনোদপুর, বধ্যভূমি, বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন, চারুকলাসহ বিভিন্ন গেট দিয়ে কয়েক শ সশস্ত্র শিবির ক্যাডার 'জয় বাংলা' স্লোগান দিতে দিতে ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়ে। তারা পাঁচটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ক্যাম্পাসে হত্যাকাণ্ডসহ ঘণ্টাব্যাপী তাণ্ডব চালায়। গুলি আর ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ ভিসি লাউঞ্জে বসেই শুনতে পান তাঁরা।

উপাচার্য বলেন, ''রাবি মেডিক্যাল সেন্টারের একজন কর্তব্যরত চিকিৎসক রাত ১টা ৫৫ মিনিটের দিকে আমাকে ফোন করে বলেন, স্যার, চারদিক দিয়ে বহিরাগত শিবির ক্যাডাররা দলে দলে ক্যাম্পাসে ঢুকছে। আমি এ খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক পুলিশ কমিশনারকে ফোন করি। কমিশনার সরাসরি ফোনটি ধরেননি। পুলিশের যে সদস্য প্রথমে ফোনটি ধরেছিলেন, তিনি আমাকে বলেন, কমিশনার স্যার ঘুমিয়ে পড়েছেন। এখন দেওয়া যাবে না। আমি তাকে 'ক্যাম্পাস পরিস্থিতি খুবই খারাপ, কমিশনারকে ফোন দেন' বললে তিনি কমিশনারকে ডেকে আনেন। পরে কমিশনারকে ক্যাম্পাসে গোলাগুলি ও শিবিরের হামলার কথা জানিয়ে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ করি।" কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুলিশ কোনো কিছুই করতে পারেনি উল্লেখ করে উপাচার্য আরো বলেন, 'রাত ৩টার দিকে আবার যখন অতিরিক্ত পুলিশ ক্যাম্পাসে আসে তখন আমরা ফারুককে হারিয়ে ফেলেছি।' উপাচার্য সোমবার রাতে পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে আবারও বলেন, 'ফারুককে হত্যার পর শিবির লাশ গুমের সময় পেল কীভাবে, এটা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। আমি এসব বিষয় সরকারকে অবহিত করেছি।'

প্রক্টর চৌধুরী জাকারিয়া ক্যাম্পাসে সোমবার রাতে পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কে বলেন, 'গোলাগুলি থেমে গেলে আমরা রাত ৪টার দিকে আবারও এসএম হলে যাই। সেখানে এসি জাহাঙ্গীরসহ কয়েকজন পুলিশকে গেটের কাছে দেখতে পাই। তাঁরা কোনো কথা বলছিলেন না। হলের দুজন গার্ডও ছিল না সেখানে। হলের টিভি রুমে গিয়ে দেখি, চাপ চাপ রক্তে মেঝে ভিজে আছে। আমরা আশঙ্কা করছিলাম, কয়েক ঘণ্টা আগে যেসব ছাত্রকে আমরা রেখে গেলাম, তাদের মধ্যে কেউ হয়তো নেই। ঘাতকরা তাদের কারো প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। সকালে তা সত্য প্রমাণ হলো।'

প্রক্টর বলেন, 'ছাত্রদের রক্ত দেখে আমরা ওই সময় এসি জাহাঙ্গীরসহ অন্য পুলিশদের বলি, আপনারা না কিছুক্ষণ আগেই আমাদের নিশ্চিত করেছিলেন, ছাত্রদের আগে আপনাদের মারতে হবে! এরা আপনাদের সন্তান, ভাই হলে কী করতেন? আপনারা কিছুই করেননি। এসি জাহাঙ্গীর কোনো কথা বলেননি।'

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রাতেই প্রক্টরসহ অন্য কর্মকর্তারা রক্তের দাগ অনুসরণ করে লাশ খোঁজার চেষ্টা করেন। ঘণ্টাখানেক কাটে এভাবেই। কোনো লাশ না পেয়ে অন্য হলগুলোর অবস্থা দেখে ভোর সাড়ে ৫টার সময় তারা ফেরেন ভিসি লাউঞ্জে। মঙ্গলবার সকালে ম্যানহোল থেকে ফারুকের লাশ উদ্ধার করা হয়। প্রক্টর বলেন, 'ভোরের দিকে আমরা চলে আসার সময় ডিসি নুরুল আমীনকে আবারও তিন হলের মাঝখানে নিশ্চুপ বসে থাকতে দেখি। আমরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনারা রাতভর কী দায়িত্ব পালন করলেন? জবাবে তিনি বলেন, তারা শিবিরের হামলা ঠেকাচ্ছিলেন।'

প্রক্টরিয়াল বডির কয়েকজন সদস্য ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, শিবিরের বহিরাগতরা প্রতিটি হলের গেট দিয়েই ভেতরে ঢুকেছে। গেটে পুলিশ থাকলে কীভাবে তা সম্ভব হয়? পুলিশ বাধা দিলে তাদের কেউ আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারত। সহকারী প্রক্টর জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, কোনো হলেই তালা ভেঙে শিবির ঢোকেনি। কারণ তালা অক্ষত পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, হলগেটে তালা কারা খুলে দিল, এটা এখন বড় প্রশ্ন। আর পুলিশই বা কী করছিল এ সময়?

রাবি প্রশাসনের কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, এসএম, সোহরাওয়ার্দী, লতিফ ও আমীর আলী হলে নিয়োজিত পুলিশদের কেউ কোনো দায়িত্ব পালন করেনি। এ চারটি হলেই শিবির তাণ্ডব চালিয়েছে ঘণ্টাব্যাপী। শুধু জিয়া হলে ঢোকার চেষ্টা করেও পুলিশের বাধার মুখে শিবির ক্যাডাররা ফিরে যেতে বাধ্য হয়। জিয়া হল গেটেও সমানসংখ্যক পুলিশ ছিল। কর্মকর্তাদের প্রশ্ন, ফারুককে হত্যার পর লাশ গুমের এতটা সময় ঘাতকরা পেল কেমন করে? তাহলে এ সময় পুলিশ কোথায় কী করছিল? সে জবাব এখন পুলিশের কাছে নেই।

উপাচার্য পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'ফারুক আমাদের ছাত্র। তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাউকে না জানিয়ে মর্গে নিয়ে গেছে। তারা আমাদের অনুমতি নেওয়ারও প্রয়োজন মনে করেনি। আমাদের জানায়নি কিছুই।'

জানা গেছে, ক্যাম্পাসে শিবির তাণ্ডব চালানোর সময় পুলিশের কমান্ড কর্মকর্তাদের গাফিলতি নিয়ে মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেক সদস্য। এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সরকারের কাছে তা জানানো হয়েছে। উপাচার্যও এর সত্যতা নিশ্চিত করেন।
এদিকে পুলিশ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি রাবি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যেও সমন্বয়ের অভাব ছিল বলে জানিয়েছেন অনেক শিক্ষক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাবি প্রশাসনের সাবেক এক শিক্ষক বলেন, শিবির আক্রমণ করবে_এ খবর পাওয়ার পরও হল প্রভোস্ট ও হাউস টিউটরদের রাতে হলে রাখা হয়নি। হল প্রশাসনের কর্মকর্তারা হলে থাকলে তাঁরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা নিতে পারতেন। রাবি প্রক্টর বলেন, 'আমি কোনো হলেই কোনো প্রভোস্টকে পাইনি, তাণ্ডবের পর হলগুলো আবার পরিদর্শনে যাই।'

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সোমবার রাতের ঘটনায় পুলিশের দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজশাহীর উপপুলিশ কমিশনার সরদার নুরুল আমীন (ডিসি সদর) বলেন, আসলে ওই সময় ক্যাম্পাসে জিয়া হলের সামনে পুলিশের সঙ্গে শিবির ক্যাডারদের সংঘর্ষ বাধে। শিবির ক্যাডাররা পুলিশের ওপর গুলিবর্ষণ ও প্রচুর ককটেল নিক্ষেপ করে। তাদের প্রতিরোধ করতে ক্যাম্পাসের অধিকাংশ পুলিশ সেখানে চলে যায়। আর এই সুযোগেই শিবির ক্যাডাররা এসএম হলে ঢুকে ফারুককে হত্যা ও অন্য কয়েকটি হলে তাণ্ডব চালায়। তবে তিনি বলেন, ওই রাতে এসএম হল গেটে দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগে ইতিমধ্যে আট পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। অন্য কোথাও পুলিশের দায়িত্ব পালনে অবহেলা প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঘুমিয়ে পড়ার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে রাজশাহীর পুলিশ কমিশনার নওশোর আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রশ্নই আসে না। ঘটনার রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ভিসি স্যারের সঙ্গেই ছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, আপনি মনে হয় ক্লান্ত। চলে যান। তারপর আমি চলে আসি। তবে আমি চলে আসার পরপরই ক্যাম্পাসে পুলিশের সংখ্যা কমে যাওয়ার অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।'

গতকাল ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো ঘুরে বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবির ক্যাডারদের সঙ্গে বিপুলসংখ্যক বহিরাগত সোমবার রাতের তাণ্ডবে অংশ নেয়। মেহেরচণ্ডি এলাকার এক মসজিদের ইমাম নাম প্রকাশ না করে বলেন, শিবির ক্যাডাররা ক্যাম্পাসে তাণ্ডব শেষে 'এই ক্যাম্পাস শিবিরের, আল্লাহর আইন চাই, সৎ লোকের শাসন চাই' ইত্যাদি স্লোগান দিতে দিতে ক্যাম্পাস থেকে বের হয়। তারা দলবদ্ধভাবে রাতের বাকি সময়টুকু কাটায় বিভিন্ন মসজিদে। আর ভোর হতেই ব্যাগ নিয়ে চলে যায় বিভিন্ন গন্তব্যে। ভোরের দিকে শিবিরের নিয়ন্ত্রিত মেসগুলো তল্লাশি করলে অনেক ক্যাডার আটক হতে পারত বলেও জানিয়েছেন বিনোদপুর এলাকায় বসবাসকারী এক ছাত্র।

পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল

আহত সহকর্মীদের দেখতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী ঢাকায় এসে কালের কণ্ঠকে বলেন, ওই রাতে পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। ব্যবস্থাপনা বিভাগের (এমবিএ) ছাত্র সোহাগ জানান, হলগুলোতে হামলা চালানো হলেও পুলিশ ছাত্রলীগ কর্মীদের বলেছে শান্ত থাকতে। তাঁদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখা হবে বলেও আশ্বাস দেয়। তবে জিয়া হল ছাড়া অন্য হলগুলোতে পর্যাপ্ত পুলিশ ছিল না।

ছাত্রলীগ কর্মী ডালিম, শামিম, লিয়ন, দ্বীপ, মিঠু, তৌহিদ ও মামুন জানান, প্রত্যেক হলে ১১ জন করে পুলিশ থাকার কথা থাকলেও হামলার সময় তাদের ভূমিকা দেখা যায়নি। শফিউল্লাহ নামের এক ছাত্রকে পুলিশের সামনেই পেটানো হয়েছে। হামলায় নিহত ফারুককে পুলিশের সামনেই টেনেহেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ছাত্রলীগ কর্মীরা জানান, জামায়াতের সম্মেলন উপলক্ষে রাজশাহীতে আসা বিভিন্ন এলাকার ক্যাডারদের নিয়ে ওই হামলা চালানো হয়েছে। হামলায় আহতদের মধ্যে ফিরোজ, বাদশা ছাড়াও রাজশাহীতে চিকিৎসাধীন চার-পাঁচজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ১৩ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে কাওসার, রুহুল আমিন, আসাদ, শফিউল্লাহ ও লুৎফরকে গতকাল পর্যন্ত ঢাকায় নিয়ে আসার কথাবার্তা চলছিল।


খবরের লিংক

রগ কেটে দেওয়া ফিরোজ ও সাইফুর মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন

নিজস্ব প্রতিবেদক | তারিখ: ১১-০২-২০১০

‘রগ কেটে দেওয়ার পর ফিরোজ রাস্তার পাশে পড়ে ছিল। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স আনতে পুলিশের সাহায্য চাই আমরা। পুলিশ আমাদের সাহায্য না করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এমন পুলিশ আমরা চাই না।’

গতকাল বুধবার রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) প্রথম আলোর কাছে পুলিশের বিরুদ্ধে এমন কথা বললেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মামুনুর রশিদ। তিনি ছাত্রশিবিরের হামলায় আহত ছাত্রলীগের কর্মী ফিরোজ মো. আরিফুজ্জামানের সতীর্থ। ছাত্রলীগের আহত দুই কর্মী ফিরোজ মো. আরিফুজ্জামান ও সাইফুর রহমানকে গতকাল পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গভীর রাতে তাঁদের রাজশাহী থেকে জরুরি ভিত্তিতে ঢাকায় আনা হয়। গত সোমবার গভীর রাতে ছাত্রশিবিরের কর্মীরা ফিরোজের দুই পা ও এক হাতের রগ এবং সাইফুরের দুই হাত ও এক পায়ের রগ কেটে দেন।

গতকাল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের দোতলায় কেবিন ব্লকে দুটি বিছানায় শুয়ে আছেন ফিরোজ ও সাইফুর। পাশে বসা ছিলেন তাঁদের স্বজন আর সহপাঠী ও রাজনৈতিক সহকর্মীরা। ফিরোজ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। বাংলা বিভাগে পড়ছেন একই বর্ষের সাইফুর রহমান।

ফিরোজের বাড়ি দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলায়। পল্লী চিকিত্সক বাবা হারুনুর রশীদ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। কান্নাজড়ানো গলায় প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমার একটাই ছেলে। মেয়েটার বয়স মাত্র পাঁচ। ওকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন।’ তিনি বলেন, তাঁর কারণেই ছেলের রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ। বলেন, ‘আমিও চেয়েছিলাম রাজনীতির মাধ্যমে যেন সে (ফিরোজ) নিঃস্বার্থভাবে সমাজের জন্য কাজ করে।’ ফিরোজের রগ যারা কেটেছে তিনি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।

মামুনুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছাত্রদের যেকোনো সমস্যায় ফিরোজ সবার আগে ছুটে যেত। স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে ফিরোজের অবস্থান ছিল স্পষ্ট। শিবিরের চোখে এটাই ছিল তার দোষ।’ সেই ছুটে যাওয়াটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি আরও জানান, সে রাতে শিবিরকর্মীরা কাজের কথা বলে তাকে ডাক দেয়। তখনো সে তাদের চিনতে পারেনি।

মামুনুর রশীদ জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ-ছাত্রশিবির সংঘর্ষের একপর্যায়ে আহতাবস্থায় ফিরোজকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেন বন্ধু আর সহপাঠীরা। ফিরোজকে উদ্ধার করার পর অ্যাম্বুলেন্সের জন্য পুলিশের সাহায্য চেয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু পুলিশ কোনো সাহায্যই করেনি।

শিবিরকর্মীরা সাইফুর রহমানের হাতের কব্জি প্রায় অর্ধেক কেটে ফেলেছেন। তাঁর দুই হাতই প্রায় কনুই পর্যন্ত ব্যান্ডেজ করা। রগ কেটে দেওয়ার পাশাপাশি ওর ঘাড়েও ছুরির আঘাত করেন শিবিরকর্মীরা। সাইফুরদের বাড়ি ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলায়। বড় ভাই স্কুলশিক্ষক রাজিউর রহমান চুপচাপ দাঁড়িয়ে লোকজনের আসা-যাওয়া দেখছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। চার ভাই-বোনের মধ্যে সাইফুর সবার ছোট। তিনি বলেন, ‘আমরা তিনজনই শিক্ষকতা করি। আমাদের স্বপ্ন ছিল ও বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে প্রশাসক হবে। এখন জানি না কী হবে।’ তিনিও শিবিরকর্মীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

শামীম ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেদিন রাতে হলের নিচে চিত্কার-চেঁচামেচি শুনে আমরা নিচে যাই। সাইফুরও দৌড়ে এগিয়ে যায়। আমি পেছনে পড়ে যাই। তখনো বুঝতে পারিনি ওই দৌড়ের পরই ওকে ভয়ংকর কিছু একটার মুখোমুখি হতে হবে।’ শামীম আরও বলেন, ‘পরিকল্পনা করে শিবিরের সন্ত্রাসীরা আমাদের ওপর হামলা করেছে। আমরা এর বিচার চাই।’

সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী দুজনকে দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে যান। তিনি সাংবাদিকদের জানান, দুজনের আঘাতই গুরুতর।


খবরের লিংক

9 February 2010

‘পুলিশের পায়ে পড়ে বলেছিলাম ভাই, বাঁচান’


নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী | তারিখ: ১০-০২-২০১০

‘দরজা ভেঙে বাইরে গিয়ে পুলিশের পায়ের ওপরে পড়ে বলেছিলাম, ভাই, বাঁচান। পুলিশ পা ঝাড়া দিয়ে ফেলে চলে যায়। তারপর শিবির ক্যাডাররা এসে আমার বাম ঊরু চায়নিজ কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে জখম করে।’ এভাবেই বলছিলেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন শফিউল্লাহ। তিনি ছাত্রশিবিরের হামলায় নিহত ফারুক হোসেনের রুমমেট। তাঁরা দুজনই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
শফিউল্লাহ হাসপাতালের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিত্সাধীন। তিনি গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, গত সোমবার রাত নয়টার দিকে তিনি ও ফারুক একসঙ্গে ভাত খেয়েছেন। এর কিছুক্ষণ পর শিবিরের ক্যাডাররা ফটক ভেঙে শাহ মখদুম হলের ভেতরে ঢুকে পুলিশের সহায়তায় ছাত্রদের পরিচয়পত্র দেখে। এই অবস্থা দেখে তিনি হলের প্রাধ্যক্ষ দুলালচন্দ্র রায়কে ফোন করেন।

শফিউল্লাহ বলেন, ‘স্যার সবাইকে নিজ নিজ কক্ষে যেতে বললে আমরা কক্ষে চলে যাই। কিন্তু শিবির ক্যাডাররা চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। এ অবস্থায় আমরা নিজদের কক্ষে থাকতে অনিরাপদ বোধ করছিলাম।’ তিনি জানান, রাত একটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা গোলাম সাব্বির সাত্তার, প্রক্টর চৌধুরী জাকারিয়া ও তারেক নূর স্যার এলে তাঁরা নিরাপত্তাহীনতার কথা জানান। তাঁদের মধ্যে শফিউল্লাহ, নিজাম, লুত্ফর, মুন্না, মশিউর, তৌফিক, রবিউল, বকুল, রব্বানী ও নিহত ফারুক নিরাপত্তার কারণে টিভি কক্ষে একসঙ্গে থাকতে চান। শফিউল্লাহ আরও জানান, এ সময় হলে কর্তব্যরত পুলিশকে প্রক্টর নির্দেশ দেন, তাঁদের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। পুলিশের হাতে অস্ত্র আছে। প্রয়োজনে ব্যবহার করারও নির্দেশ দেন প্রক্টর। তখন পুলিশ সদস্যরা তাঁদের এই বলে নিশ্চয়তা দেন, তাঁদের মেরে তারপর ছাত্রদের গায়ে আঘাত করতে হবে।

শফিউল্লাহ জানান, রাত একটা ৪০ মিনিটের সময় শিবিরের হল শাখার সাবেক সভাপতি আনিস, বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে শিবিরের ২০-২৫ জন ক্যাডার তাঁদের ওপর হামলা চালায়। শফিউল্লাহ আরও জানান, শিবিরের ক্যাডাররা তাঁর মাথায় চায়নিজ কুড়াল দিয়ে আঘাত করে। প্রাণ বাঁচাতে তিনি সজোরে লাথি দিলে দরজা খুলে যায়। তিনি বাইরে দৌড়ে গিয়ে একজন পুলিশের পায়ের ওপর উপুড় হয়ে পড়েন। পুলিশ পা ঝাড়া দিয়ে ফেলে যাওয়ার পর শিবির ক্যাডাররা এসে তাঁর ঊরুতে আঘাত করে।

সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর হলে শিক্ষার্থী আসাদকে কুপিয়ে জখম করার মাধ্যমে শিবিরের তাণ্ডব শুরু হয়। হাসপাতালের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিত্সাধীন আসাদ অভিযোগ করে বলেন, শিবিরের কর্মীরা তাঁকে মারধর করতে শুরু করলে তিনি হলের পুলিশ বক্সে ঢোকার চেষ্টা করেন। দুই পুলিশ সদস্যের সামনে থেকেই তাঁকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়।

গতকাল দুপুর দুইটার দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবদুস সোবহান ও প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা হাসপাতালে আসাদের শয্যাপাশে গেলে আসাদ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। উপাচার্যের উদ্দেশে আসাদ বলেন, ‘আমার ওপর হামলা করার ছয়-সাত ঘণ্টা পর অন্য হলে হামলা চালিয়ে ছাত্রলীগের ভাইকে হত্যা করা হলো। আপনারা কী করলেন?’ শিক্ষকদের একজন বললেন, ‘এ প্রশ্নের জবাব আমরাও খুঁজছি।’ আরেকজন বলেন, ‘পুলিশ রে বাবা।’ উপাচার্য কোনো কথা না বলে আসাদের ব্যান্ডেজ মোড়ানো মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। ছাত্র উপদেষ্টা গোলাম সাব্বির সাত্তার আসাদকে ধৈর্য ধারণ করতে বলেন।

অভিযোগ প্রসঙ্গে রাজশাহীর পুলিশ কমিশনার নওশের আলী গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি খোঁজখবর নিয়ে এ ব্যাপারে কথা বলবেন।


খবরের লিংক

25 January 2010

চট্টগ্রামে শিবিরের মেস থেকে অস্ত্র উদ্ধারঃ এজাহারে তথ্যের অসংগতি, মামলা দুর্বল হওয়ার শঙ্কা



একরামুল হক, চট্টগ্রাম | তারিখ: ২৬-০১-২০১০

চট্টগ্রামের মিস্ত্রিপাড়ার ছাত্রশিবিরের মেস থেকে উদ্ধার হওয়া অস্ত্র, গুলি ও জিহাদি বই উদ্ধারের ঘটনায় দায়ের করা মামলার এজাহারে বড় ধরনের গলদ ধরা পড়েছে। ফলে মামলার ভিত্তি দুর্বল হয়ে গেছে বলে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা মনে করছেন। মামলায় গলদের কারণে ‘সন্দেহের সুযোগ’ আসামিদের পক্ষে যাবে বলে একজন আইনজ্ঞ জানান। অবশ্য মামলার এক সপ্তাহ পর রোববার আদালতে একটি সংশোধনী প্রতিবেদন দাখিল করেন বাদী।

১৭ জানুয়ারি পুলিশ রাতভর শিবিরের মেসে অভিযান চালিয়ে চারটি রিভলবারসহ সাতটি অস্ত্র, ৩৭টি গুলি, বোমা তৈরির সরঞ্জাম, বিস্ফোরক ও জিহাদি বই উদ্ধার করে। এ ঘটনায় ডবলমুরিং থানার পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মাহবুব উল-আলম মোল্লা ১৮ জানুয়ারি একটি মামলা করেন। মামলার এজাহারে ভুল থাকায় রোববার আবার সংশোধনী প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।

এজাহারের প্রথম পৃষ্ঠার সূচনায় তিনটি এলজি ও চারটি রিভলবার উদ্ধারের কথা উল্লেখ করা হয়। কিন্তু মামলার বিস্তারিত বর্ণনায় বাদী তিনটি এলজি ও পাঁচটি রিভলবারের কথা উল্লেখ করেন। এটি মামলার বড় গলদ বলে আইন কর্মকর্তারা মনে করছেন। আবার সংশোধনী দাখিল হলে মামলা আরও দুর্বল হয়ে পড়বে, যার ফলে আসামিদের ‘সন্দেহের সুযোগ’ নেওয়ার পথ সৃষ্টি হবে।

চট্টগ্রাম মহানগর আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) কামালউদ্দিন আহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভুল তথ্য দিয়ে পুলিশ অস্ত্র মামলা করবে—এটা মেনে নেওয়া যায় না। ভুল তথ্যের ওপর সাত দিন ধরে এজাহারটি ছিল। সাতটি অস্ত্র গুনতে কী সাত দিন সময় লাগে? থানায় নথিভুক্ত হওয়ার আগেই এই ভুল কেন সংশোধন করা হয়নি?’ পিপি আরও বলেন, ‘এজাহারে ভুল তথ্য থাকলে আসামিরা তো সুবিধা নেবেই। আইনে আসামিরা সর্বোচ্চ সুবিধা পেয়ে থাকে।’

পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘হক ভিলায় অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় আমাদের কোনো কর্মকর্তা এ মামলায় ভুল তথ্য দিলে তাঁর বিরুদ্ধে গাফিলতি, অদক্ষতা ও কর্তব্য পালনে উদাসীনতার অভিযোগ আনা হবে। এর পরই আমরা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব।’

এজাহারে যা আছে: এজাহারের প্রথম পৃষ্ঠার ৩৮ থেকে ৪০তম লাইনে বলা হয়, ‘দ্বিতীয় তলার উত্তর পাশের পাকঘরের ভেতর তিনটি দেশীয় এলজি, তিনটি রিভলবার, যার দুটিতে পাকিস্তান ও একটিতে ইউএসএ লেখা আছে।’ প্রথম পৃষ্ঠার ৪২ ও ৪৩তম লাইনে বলা হয়, ‘চতুর্থতলা তল্লাশি করে উত্তর পাশের কক্ষে ওয়াশিং মেশিনের মধ্যে একটি রিভলবার পাওয়া যায়, যার গায়ে পাকিস্তান লেখা আছে।’

আবার এজাহারের দ্বিতীয় পৃষ্ঠার ১২ থেকে ১৭তম লাইনে বলা হয়, ‘উক্ত দ্বিতীয় তলার পশ্চিম পাশের ফ্ল্যাটে তল্লাশি করে রান্নাঘরের ওপরের তাকে পাকিস্তান লেখা রিভলবার পাওয়া যায়।... উক্ত ফ্ল্যাটের পশ্চিম পাশে আবদুল্যা আল মামুন, দেলোয়ার হোসেন, আবদুল জব্বার, কাদের, নুরনবী ও আবদুল হালিম থাকতেন। তাঁরা ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মী বলে জানা যায়। ১৭ জানুয়ারি রাত ১০টায় তাঁরা ঢাকা চলে যান বলে জানা যায়। ফলে তাঁরা উক্ত রিভলবার ও গুলি কক্ষে রেখেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।’
সংশোধনীতে যা আছে: এজাহারে ভুল তথ্য ছিল—এ কারণে ‘সংশোধন প্রসঙ্গে’ শিরোনামে রোববার একটি প্রতিবেদন মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে দাখিল করেন বাদী এসআই মাহবুব উল-আলম মোল্লা।
সংশোধনী প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মিস্ত্রিপাড়ার হক ভিলার দ্বিতীয় তলার উত্তর পাশের কক্ষ থেকে দেশে তৈরি তিনটি এলজি এবং দুটি রিভলবার উদ্ধার করা হয়। কিন্তু কম্পিউটারে টাইপ করা এজাহারের শেষের দিকে ভুলবশত বর্ণিত দুটি রিভলবারের পরিবর্তে তিনটি রিভলবার দেখানো হয়েছে এবং একটির পরিবর্তে দুটি পাকিস্তানি তৈরি লেখা উল্লেখ করা হয়। মূলত তিনটি রিভলবারের পরিবর্তে দুটি রিভলবার হবে, যার একটিতে পাকিস্তান ও অন্যটিতে ইউএসএ হবে।’

এ ব্যাপারে জানতে বাদী এসআই মাহবুবের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তিনি মুঠোফোনটি বন্ধ করে রেখেছেন।


খবরের লিংক