আবুল কাশেম
বহুল আলোচিত যুব কর্মসংস্থান সোসাইটির (যুবক) প্রতারিত গ্রাহকদের ২১০০ কোটি টাকা ফেরত দিতে কমিশন গঠন করছে সরকার। যুবকের প্রতারিত দুই লাখ ৬৭ হাজার ৩৩০ জন গ্রাহকের পাওনা ২১৪৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা আগামী দুই বছরের মধ্যে পরিশোধে কাজ করবে এ কমিশন। তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী, যুবক ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি দখলে নিয়ে প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে তা বিক্রি করে পাওয়া অর্থ থেকে গ্রাহকদের টাকা পরিশোধের উদ্যোগ নেবে কমিশন।
জানা গেছে, দুই সদস্যের এ কমিশনের চেয়ারম্যান হচ্ছেন বিসিএস ১৯৭৭ ব্যাচের সদস্য অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব রফিকুল ইসলাম। আর সদস্য পদে যোগ দেবেন প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের সদস্য মজনুন হাসান। আজ অর্থ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি করবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী এ কমিশন গঠন করা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় শক্তি প্রয়োগ করে প্রতারিত গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার ক্ষমতাও দেওয়া হবে কমিশনকে। কমিশন দুই বছরের মধ্যে প্রতারিত গ্রাহকদের ২২০০ টাকা ফেরত দেওয়ার কাজ শেষ করবে। বৃহস্পতিবার এ কমিশন গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি হবে। কমিশনের চেয়ারম্যান পদে অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব রফিকুল ইসলামকে স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। আর সদস্য পদে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের সদস্য মজনুন হাসানকে।'
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কমিশন গঠন সম্পর্কে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'একটি দীর্ঘমেয়াদি (তিন বছর) পূর্ণকালীন এক অথবা তিন সদস্যের একটি কার্যকর কমিশন অবিলম্বে গঠন করা প্রয়োজন।' প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, দ্রুত গতিতে এবং উপযুক্ত ক্ষমতায়নের মাধ্যমে গঠিত নতুন কমিশনের প্রথম কাজ হতে পারে আইনসিদ্ধ বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে যুবক ও যুবকসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তরের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা এবং এর তালিকাভুক্ত অন্যান্য সম্পত্তির ওপর কমিশন নিয়োজিত ব্যক্তিদের দখল ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। দীর্ঘমেয়াদি পূর্ণকালীন কমিশনকে একটি উপযুক্ত কাঠামোর মাধ্যমে জনবল, আর্থিক সংস্থান, অফিস ও অন্যান্য সুবিধা প্রদান করে বিজ্ঞপ্তি প্রচারের পর প্রথম কর্তব্য হিসেবে কমিশন চেয়ারম্যান যুবক ও যুবকসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারেন। নবগঠিত কমিশনের চেয়ারম্যানকে হাইকোর্টের একজন বিচারপতি অথবা সরকারের সচিবের পদমর্যাদায় বেতন, ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাসহ নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। কমিশন তদন্ত কমিটির সুপারিশ আমলে নিয়ে কাজ করবে। এ ছাড়া কমিশন প্রয়োজনে অধিকতর তদন্তও করতে পারে। এ জন্য কমিশনকে পর্যাপ্ত ক্ষমতা দেওয়া হবে।
ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি সংবাদমাধ্যমে যুবকের গ্রাহকদের তথ্য প্রদানের অনুরোধ জানিয়ে গণবিজ্ঞপ্তি দিলে যুবক হাউজিং অ্যান্ড রিয়েল এস্টেট ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড ও যুবকসংশ্লিষ্ট অন্য চারটি প্রতিষ্ঠানের দুই লাখ ৬৭ হাজার ৩৩০ জন গ্রাহক দালিলিক প্রমাণসহ মোট ২১৪৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা পাওনা দাবি করে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ রয়েছে। অবশ্য ২০০৬ সালে অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রমের দায়ে যুবকের কর্মকাণ্ড বাতিল করার সময় বেসরকারি এই সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়েছিল, ২০০৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই লাখ ৬৭ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে তারা ৩৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকা জমা নিয়েছে।
১৯৯৪ সালে সদস্যদের মধ্যে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণের মধ্য দিয়ে যুবক এর কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৯৭ সালে জয়েন্ট স্টক কম্পানিজে নিবন্ধন পাওয়ার পর যুবক প্রায় ২০ ধরনের ব্যবসা শুরু করে। ২০০৬ সাল নাগাদ সংস্থাটি টেলিকমিউনিকেশন, হাউজিং অ্যান্ড রিয়েল এস্টেট ডেভেলপমেন্ট, পর্যটন, স্বাস্থ্য, সিরামিকস, সামুদ্রিক খাদ্য, আইটি, নার্সারি, এগ্রো-বায়োটেক ইন্ডাস্ট্রি ও ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের ব্যবসা শুরু করে। ২০০৬ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের আলাদা তদন্তে যুবকের গ্রাহকদের প্রতারিত হওয়ার ঘটনা বেরিয়ে আসে। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ ও তাদের ঋণ দেওয়া কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে এক সপ্তাহের সময় দিয়ে ২০০৬ সালের মে মাসে যুবককে নোটিশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০০৬ সালের জুলাই মাসে আমানতকারীসহ অন্যদের সব অর্থ ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে ওই সময়সীমা ২০০৭ সালের মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক যুবকের অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনেও নথি পাঠায়। তবে কমিশন বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলে নথি ফেরত দেয়। পরে যুবকের গ্রাহকদের জমা করা অর্থ পরিশোধ ও হয়রানি বন্ধ, সম্পত্তি হস্তান্তরে স্থগিতাদেশ এবং প্রশাসক নিয়োগ করে স্থায়ী সমাধানের জন্য ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তদন্ত কমিশন গঠন করে অর্থ মন্ত্রণালয়। ওই বছরের ডিসেম্বরে তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দেয় অর্থমন্ত্রীর কাছে।