11 April 2011

'বিদ্যুতের বেড়া দিয়ে ওরা মানুষ মারার কল বসাইছে': আবাসন প্রকল্পে জঙ্গি কার্যক্রম

নিজস্ব প্রতিবেদক

চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া। আনুমানিক ৫০ গজ পর পর ছোট সাইনবোর্ড। লাল কালিতে লেখা 'বিপজ্জনক, বিদ্যুতায়িত তারের বেড়া'। জ্যানোভ্যালি পিংক সিটি কর্তৃপক্ষ এভাবেই নিরাপত্তার নামে ত্রাসব্যবস্থা গড়ে তুলেছে রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায়। এ আতঙ্কে আরো যোগ হয়েছে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, খিলক্ষেতের ডুমনি এলাকায় গজারিগাছের খুঁটির বেড়া দিয়ে তাতে বেআইনিভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ
দিয়েছে পিংক সিটি কর্তৃপক্ষ। ফলে যেকোনো মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে প্রাণহানির মতো বড় ধরনের ঘটনা। পিংক সিটির চারপাশে বিদ্যুতায়িত কাঁটাতারের বেড়ার পাশাপাশি আছে ক্লোজ সার্কিট।

গতকাল সোমবার দুপুর। ডুমনির পাতড়া এলাকা থেকে মাছ ধরতে পিংক সিটির দক্ষিণ পাশে এসেছেন রহিম উদ্দিন, জয়নাল ও আবদুল্লাহ। জাল দিয়ে মাছ ধরে একটু বিশ্রাম নিতে তাঁরা যেখানে বসেন, এর পাশ ঘেঁষেই চলে গেছে পিংক সিটির বিদ্যুতায়িত বেড়া। বিষয়টি না জেনে জয়নাল হোসেন তারের বেড়া ধরতেই প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে পড়ে যান মাটিতে। অন্যরা শরীর ম্যাসেজ করে জয়নালকে কিছুটা স্বাভাবিক করে বাড়িতে নেওয়ার প্রস্তুতি নেন। এ সময় রহিম উদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে কালের কণ্ঠের কাছে পিংক সিটিকে অভিযুক্ত করে বলেন, 'বিদ্যুতের বেড়া দিয়ে ওরা মানুষ মারার কল বসাইছে, ধরলেই মরতে হইব। আর একটুর লাইগ্যা জয়নাল জানে বাঁইচ্যা গেছে।' আবদুল্লাহ বলেন, 'কারেন্টের শট (শক) খাইয়া আমাগো এলাকার আরো একজন মরার দশা হইছিল। আগে অনেকেই গরুর ঘাস কাটতে এখানে আসলেও এখন এই কারেন্টের ভয়ে কেউ আসতে চায় না।' তারের বেড়ার পাশ ঘেঁষেই ধানক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করছেন ষাটোর্ধ্ব আলী আজগর। তিনি বলেন, 'তারের বেড়ায় কারেন্ট লাগানোর পর থেকে দুই মাইল ঘুরে ধানক্ষেতে আসতে হয়। পিংক সিটির ভেতরে কাউকে যাইতে দেয় না। হুনছি এইডার ভিতরে জঙ্গিদের নাকি আস্তানা বানাইছে।' ডুমনি এলাকার লোকজন অভিযোগ করে, পিংক সিটির চারপাশে সীমানাপ্রাচীরের বাইরে আলাদা যে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়েছে, তাতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। ফলে এলাকাবাসীর মধ্যে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক।
জঙ্গিদের ঘাঁটি : 'বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে জোর করে মানুষের জমি দখল করে পিংক সিটি বানাইছে। এটার ভেতরে কোনো মানুষজন যাইতে দেয় না। সেখানে অপরিচিত লোকজনের আনাগোনা বেশি দেখা যায়। এলাকার অনেকেই কইয়া বেড়ায়, পিংক সিটির ভেতরে নাকি জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।' ডুমনি গ্রামের বাসিন্দা আজগর আলী এ কথা বলেন কালের কণ্ঠের প্রতিবেদককে।

খিলেক্ষেত এলাকায় আরো অনেকে বলে, জঙ্গি এবং সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি পিংক সিটি। তাদের ভাষ্য, হাউজিং ব্যবসার নামে পিংক সিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সাবেক শিবির ক্যাডার সালাহউদ্দিন ডুমনি এলাকায় জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বানিয়েছেন। এলাকাবাসীর আশঙ্কা, সালাহউদ্দিন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে মৌলবাদীদের নিয়ে বড় ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন এবং তাদের মাধ্যমে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালনার বিষয়টিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিভিন্ন সূত্র মতে, সালাহউদ্দিনের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের অনেক পলাতক আসামি ও সন্ত্রাসীকে পিংক সিটিতে ক্যাডার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাদের ডুমনি এলাকার জমি দখলকাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে এলাকাবাসীও মুখ খোলার সাহস পায় না। স্থানীয় লোকজন জানায়, জঙ্গি ও সন্ত্রাসী লালন ছাড়াও ফ্ল্যাট বিক্রির নামে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে এই সালাহউদ্দিন প্রতারণার ফাঁদে ফেলছেন অনেক নিরীহ মানুষকে। ফ্ল্যাট কেনার পর দখল চাইতে গিয়ে সালাহউদ্দিনের সন্ত্রাসী বাহিনীর হামলার শিকার হচ্ছেন অনেক ক্রেতা।
জমি দখল করেই যাচ্ছে : পিংক সিটির মালিক সন্ত্রাসীদের গডফাদার সালাহউদ্দিন ও তাঁর প্রকল্প ম্যানেজার, কর্মকর্তা-কর্মচারী, সন্ত্রাসী লোকজনসহ আমিন মোহাম্মদের তফসিল বর্ণিত জমিতে জোরপূর্বক বালি দিয়ে ভরাটের চেষ্টা চালায়। দায়িত্বরত লোকজন বাধা দিলে তারা প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে জমি ছেড়ে চলে যেতে বলে। জিডিতে বলা হয়েছে, পিংক সিটি কর্তৃপক্ষ দাঙ্গাবাজ ও ভয়ানক সন্ত্রাসী। তাদের কাজই হচ্ছে অন্যের জমি জোর করে দখল ও আত্মসাৎ করা।

আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশনের অভিযোগ, পিংক সিটির পাশে তাদের ২৬৮ শতাংশ জমি রয়েছে। এটি দখল করতে সালাহউদ্দিন আহমেদ সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা জমির নিচু অংশে বালি ফেলে ভরাট করে নিজেদের আওতায় নিতে চাচ্ছেন। এ বিষয়ে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর একটি আবেদন করা হয়েছে এবং মন্ত্রী পুলিশকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সেই নির্দেশনা যথাযথভাবে পালন করা হচ্ছে না বলে জানায় আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ।

সালাহউদ্দিন আহমেদ নর্থ-সাউথ সোসাইটির আবাসন প্রকল্পের জমি অবৈধ দখলে নেওয়ার জন্যও মরিয়া হয়ে উঠেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। নর্থ-সাউথ সোসাইটি কর্তৃপক্ষ কালের কণ্ঠকে বলেছে, তাদের প্রায় ৬৫ বিঘা জমি রয়েছে পিংক সিটির আবাসন প্রকল্পের পাশে। এ জমি দখল করতে সালাহউদ্দিন ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন। সোসাইটির মালিকপক্ষ আরো বলছে, রাস্তার পাশে ১০ কাঠার অধিক এবং সোসাইটির ভেতরে নিচু জায়গায় বালু ফেলে পিংক সিটি দখলে নিয়েছে। প্রকল্পের ভেতরে ১০ শতক জমিতে ভবনও নির্মাণ করেছেন পিংক সিটির দখলবাজ মালিক।
গুঁড়িয়ে দেয় আনসার ক্যাম্প : এলাকাবাসীসহ বিভিন্ন সূত্র মতে, পিংক সিটির তিন শতাধিক সদস্যের একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী আছে, যারা নিয়মিত মহড়া দেয়। তাদের অধিকাংশের মুখে দাড়ি। বাঁশিতে ফুঁ পড়লেই অস্ত্রসহ পিংক সিটি থেকে তারা বেরিয়ে আসে। সম্প্রতি কমপক্ষে দুই শতাধিক সশস্ত্র ক্যাডার আনসার ক্যাম্পে হামলা চালায়। তারা বুলডোজারসহ রাতের আঁধারে হামলা চালিয়ে আনসার ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দিয়ে পাঁচ বিঘার বেশি জমি দখল করে নেয়। হামলায় আনসার সদস্য দেলোয়ার হোসেন ও আবদুল মালেক গুরুতর আহত হন। এ ঘটনায় মামলা হলে পুলিশ পিংক সিটির তিন সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠায়। পিংক সিটিতে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটেই যাচ্ছে। গত ২৭ জানুয়ারি পিংক সিটির ভেতরে এক অজ্ঞাতপরিচয় যুবক খুন হন। খিলক্ষেত থানার পুলিশ খবর পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে যুবকের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে। ওই ঘটনায় থানায় একটি মামলা হলেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেনি।

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন