16 March 2011

ইসলামী ব্যাংকের বিজ্ঞাপন প্রতারণা: বিশ্বকাপের শোভাবর্ধন

অমিতোষ পাল

রাজধানীর পাঁচতারা হোটেল সোনারগাঁওয়ের পাশে সন্ধ্যায় দাঁড়ালেই দেখা যায় বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলক্ষে সৌন্দর্যবর্ধনের বাহারি আয়োজন। আলোর ঝলকানি। একদিকে রিকশা, আরেকদিকে গ্রামবাংলার মনোরম দৃশ্যসংবলিত বিশাল বিলবোর্ড, বৈদ্যুতিক খুঁটিতে লাল-নীল আলোকসজ্জা, এসবের সঙ্গে বল, হাতপাখা ইত্যাদির প্রদর্শন। আর এর সব কিছুতেই শোভা পাচ্ছে ইসলামী ব্যাংকের প্রচারণাসংবলিত বিজ্ঞাপন।

কেবল সোনারগাঁও হোটেল এলাকায়ই নয়, রাজধানীজুড়েই সৌন্দর্যবর্ধনের এমন দৃশ্য বিরাজমান। এ কাজটি করেছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। মাত্র ৭৫টি স্থানের অনুমতি নিয়ে পুরো নগরীই বিজ্ঞাপনে ঢেকে ফেলেছে তারা। বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলক্ষে অন্তত ৬৫৪টি স্থানে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাদের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করছে। সে হিসাবে ৫৭৯টি বিজ্ঞাপনই করা হয়েছে অবৈধভাবে। পাশাপাশি ১০০টি বাসের গায়েও তারা লাগিয়েছে নিজেদের বিজ্ঞাপন। এ ধরনের বিজ্ঞাপন প্রদর্শনে ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) অনুমোদন ও নির্ধারিত কর (ট্যাঙ্) পরিশোধের নিয়ম থাকলেও তারা সেটা করেনি। এগুলো উচ্ছেদ করতে গেলে বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রভাবশালী নেতাদের মাধ্যমে ডিসিসিকে উল্টো চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক রাষ্ট্রপতির কাছে কর মওকুফের আবেদন করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে বলে জানা গেছে।

ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে তারা কর মওকুফ করিয়ে নিতে পারলে ভিন্ন ব্যাপার। কিন্তু এখানে ডিসিসির ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। নিয়মানুযায়ী ট্যাঙ্ দিতেই হবে। এ ব্যাপারে ডিসিসির বিউটিফিকেশন সেলের সদস্যসচিব ক্যাপ্টেন বিপন কুমার সাহার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।

ক্যাপ্টেন বিপন কুমার সাহা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ইসলামী ব্যাংক অবৈধভাবে অনেক বেশি বিজ্ঞাপন প্রচার করেছে। আমরা সরেজমিনে পরিদর্শন করে তাদের কয়েক দফা চিঠি দিয়েছি। বৈঠকও হয়েছে। এখন তারা বলছে, রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে ট্যাঙ্ মওকুফ করিয়ে নেবে। আমি বলেছি, আপনারা আগে ট্যাঙ্ জমা দেন। পরে রাষ্ট্রপতির মওকুফপত্র দেখালে আমরা ট্যাঙ্রে টাকা ফেরত দিয়ে দেব। এটা বলার পরও তারা সময় নিচ্ছে।'

ইসলামী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল ইসলাম অনুমোদন ছাড়াই বেশি বিজ্ঞাপন ব্যবহারের অভিযোগ স্বীকার করে বলেন, 'আমরা কিছু টাকা দিয়েছি। কিন্তু যেহেতু এটা বিশেষ আয়োজন উপলক্ষে করা, এ জন্য চেষ্টা করছি রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতাবলে ট্যাঙ্ মওকুফ করিয়ে নিতে। বিসিবিও আমাদের আশ্বাস দিয়েছে।' আর বাসে বিজ্ঞাপন ব্যবহারের ব্যাপারে তিনি বলেন, ১০০ বাসে নয়, ৩০টিতে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় থাকলেও বিসিবি সভাপতি আ হ ম মোস্তফা কামালের কারসাজিতে সৌন্দর্যবর্ধনের সুযোগ পেয়ে যায় ইসলামী ব্যাংক। এ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যাপক সমালোচনাও হয়েছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু বলেছেন, ইসলামী ব্যাংকের অর্থ এ দেশের জঙ্গি অর্থায়নের কাজে ব্যয় হয়। এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান কিভাবে বিশ্বকাপ ক্রিকেটকে পুঁজি করে নির্বিচারে নিজেদের বিজ্ঞাপন প্রচারের সুযোগ পেল, সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। একটি সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হারুন অর রশিদ এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বকাপ শেষে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন। এ ব্যাপারে বিসিবি সভাপতি মোস্তফা কামালের সঙ্গে মোবাইল ফোনে তিন দিন ধরে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁর কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

অসাধুতা : অবৈধভাবে বিজ্ঞাপন প্রচারের বিষয়টিকে অনেকেই ইসলামী ব্যাংকের চরম অসাধুতা হিসেবে দেখছে। তারা বলছে, জামায়াতে ইসলামীর মতোই অপকৌশলে লিপ্ত হয়েছে তাদের অর্থায়নকারী ব্যাংকটি। জানা গেছে, ইসলামী ব্যাংক সৌন্দর্যবর্ধনের অনুমতি পাওয়ার পর নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই নগরীর বিভিন্ন স্থানে বিলবোর্ড-ব্যানার-ফেস্টুন লাগানো শুরু করে। বিষয়টি নিয়ে ডিসিসি আপত্তি জানায়।

ডিসিসির ভাষ্য, ঢাকা মহানগরীতে বিজ্ঞাপনযুক্ত বিলবোর্ড-ব্যানার স্থাপন করতে হলে ডিসিসির অনুমোদন নিতে হয় এবং নিয়ম অনুযায়ী ট্যাঙ্ পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু ইসলামী ব্যাংক বিসিবির দোহাই দিয়ে করমুক্তি চায়। এ নিয়ে চিঠি চালাচালির একপর্যায়ে ইসলামী ব্যাংক ৭৫টি স্থানে বিলবোর্ড ও সৌন্দর্যবর্ধনকারী সামগ্রী সংযুক্ত করার জন্য ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করে। কিন্তু ডিসিসির বিউটিফিকেশন সেলের কর্মীরা সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখতে পান, বাস্তবে অন্তত ৬৫৪টি স্থানে ইসলামী ব্যাংকের বিজ্ঞাপন লাগানো হয়েছে। এর জন্য যে পরিমাণ জায়গা ইসলামী ব্যাংক ব্যবহার করেছে, তার ট্যাঙ্ হিসাব করলে দাঁড়ায় এক কোটি ৬০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু তারা ট্যাঙ্ পরিশোধ না করে টালবাহানা করছে। ইসলামী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল ইসলাম বিদেশে অবস্থানের অজুহাত দেখিয়ে কয়েক দফা সময় নেন। একপর্যায়ে বিজ্ঞাপনের সংখ্যা কমিয়ে ৩২১টি করে এক কোটি ২০ লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ টাকা ট্যাঙ্ দিতে সম্মত হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটাও তারা পরিশোধ করেনি। সংখ্যা কমানোর কথা বললেও আগের বিজ্ঞাপনগুলোই বহাল আছে। এ ধরনের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে প্রতি বর্গফুট জায়গা ব্যবহারের জন্য মাসে ১০০ টাকা করে ট্যাঙ্ দেওয়ার নিয়ম। সঠিকভাবে হিসাব করলে ডিসিসির অন্তত আড়াই কোটি টাকা এ খাত থেকে আয় হতো বলে জানান সংস্থার একজন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, 'অবৈধভাবে বিজ্ঞাপন প্রচার ছাড়াও ইসলামী ব্যাংক অনুমতি ছাড়াই আগারগাঁওয়ের ব-দ্বীপে বিশাল আকৃতির একটি ক্রিকেট বল নির্মাণ শুরু করে। ডিসিসি বাধা দিলে বিভিন্ন জায়গা থেকে তদবির আসতে থাকে। এ ঘটনায় বিসিবি সভাপতি মোস্তফা কামাল ঢাকার মেয়রকে ডেকে নিয়ে ইসলামী ব্যাংককে ছাড় দেওয়ার অনুরোধ জানান। পরে বিজয় সরণির বিমান চত্বরের পাশে এক মাসের জন্য দুই লাখ টাকা পরিশোধ সাপেক্ষে ক্রিকেট বল নির্মাণের অনুমতি দেয় ডিসিসি। ওই বলের গায়েও শোভা পাচ্ছে ইসলামী ব্যাংকের বিজ্ঞাপন।'

৭৫-এর জায়গায় ৬৫৪ : ইসলামী ব্যাংক ১৩টি স্থানে গেট, ১৯টি স্থানে বেলুন, ৪০টি স্থানে ক্যানভাস বোর্ড ও কাটআউট এবং তিনটি মোড়ে নিয়ন সাইনে তাদের বিজ্ঞাপন ব্যবহারের অনুমতি নিয়েছিল। বাস্তবে তারা ৬৫৪টি স্থানে বিজ্ঞাপন দিয়েছে, যা অনুমোদনের চেয়ে সাত-আট গুণ বেশি। ডিসিসির হিসাব অনুযায়ী, ইসলামী ব্যাংক ৭৩টি ক্যানভাস, ৭১টি মেগাসাইন, ১০টি নৌকা, ৩৭৫টি ফেস্টুন, চারটি টপগেট, তিনটি বক, ৮২টি বৈদ্যুতিক পোলের বেলসাইন, ১০টি রিকশা, ১২টি পাখাসংবলিত কাটআউট ও ১৪টি বলে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। এ ছাড়া সাভারের বিএনপি নেতা কফিল উদ্দিনের মালিকানাধীন হানিফ এন্টারপ্রাইজের হানিফ পরিবহনের ১০০টি বাসে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ইমেজ ব্যবহার করে ইসলামী ব্যাংকের বিজ্ঞাপন যুক্ত করা হয়েছে। ডিসিসির পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শকরা ক্যামেরায় এগুলোর ছবিও তুলে রেখেছেন।

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন