28 March 2011

উইকিলিকসে বাংলাদেশ বিষয়ক নথি: বিডিআর বিদ্রোহে উদ্বিগ্ন ভারত শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়ায়

কালের কণ্ঠ ডেস্ক

পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল ভারত সরকার। ২০০৯ সালের সংকটজনক ওই পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার প্রতি দৃঢ় সমর্থন বজায় রাখে দেশটি। বিডিআর বিদ্রোহের পরপরই ভারতের পররাষ্ট্রসচিব শিবশঙ্কর মেনন দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স স্টিভেন হোয়াইটের সঙ্গে বৈঠক করেন। উইকিলিকসের ফাঁস করা নথি থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য হিন্দু গতকাল রবিবার এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। 'বাংলাদেশে ২০০৯ সালে বিদ্রোহের পর হাসিনাকে সমর্থন জুগিয়েছিল ভারত' শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের পাঠানো তিনটি গোপনীয় তারবার্তার প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়। পিলখানায় বিডিআর জওয়ানরা ২৫ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহ করে। দুদিন বাদে ২৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের পররাষ্ট্রসচিব শিবশঙ্কর মেনন নিজ কার্যালয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স স্টিভেন হোয়াইটকে ডেকে পাঠান।

আলোচনায় ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বাংলাদেশ রাইফেলসে বিদ্রোহের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি শেখ হাসিনার নবনির্বাচিত সরকারের ওপর এর প্রভাব নিয়ে শঙ্কা ব্যক্ত করেন। এ বিষয়ে স্টিভেন হোয়াইট ২ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে একটি তারবার্তা (১৯৪৬৬১ : গোপনীয়) পাঠিয়েছিলেন। সেখানে বলা হয়, বিদ্রোহ চলার সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জিকে টেলিফোন করেন। শেখ হাসিনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চান। তবে সহযোগিতার ধরন সম্পর্কে তিনি কিছু বলেননি। প্রণব মুখার্জি প্রয়োজনে 'সাড়া' দেওয়ার আশ্বাস দেন।

শিবশঙ্কর মেনন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিককে জানান, বিষয়টি নিয়ে ভারত সরকার লন্ডন, বেইজিং ও টোকিওর সঙ্গেও যোগাযোগ করেছে। বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে ভারতের উদ্বেগ ছিল দুটি। প্রথমত, উদ্ভূত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কট্টরপন্থী ধর্মীয় দল জামায়াতে ইসলামী 'ঘোলাপানিতে মাছ
শিকারের' চেষ্টা করতে পারে। ঘটনার সঙ্গে জামায়াত সরাসরি জড়িত_ এমন কথা সরাসরি বলেননি শিবশঙ্কর। তবে যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকে তিনি জানান, বিডিআর বিদ্রোহ পূর্বপরিকল্পিত এবং ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে ভরাডুবি ও ধর্মীয় জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বের মধ্যে হতাশা রয়েছে। ভারতের উদ্বিগ্ন হওয়ার দ্বিতীয় কারণ হলো_বিদ্রোহের ঘটনা বাংলাদেশে বেসামরিক সরকার ও সেনাবাহিনীর সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিককে শিবশঙ্কর বলেন, বিদ্রোহে অনেক কর্মকর্তাকে হারানো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এতে সমস্যায় পড়তে পারে হাসিনার সরকার। বিদ্রোহী জওয়ানরা সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার পর লাশ পয়োনালায় ফেলে দেয় বলে উল্লেখ করেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব। তবে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান মইন উ আহমেদের ওপর ভরসা রেখে বলেন, পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে তিনি সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছেন।

বিডিআর বিদ্রোহ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দেওয়া বিবৃতির প্রশংসা করেন শিবশঙ্কর মেনন। তিনি পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটানোর জন্য ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়মিত যোগাযোগ এবং সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর জোর দেন। শিবশঙ্কর আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, প্রথম পর্যায়ের জটিল অবস্থার অবসান হয়েছে, কিন্তু এর পরে কী ঘটবে তা বোঝার জন্য অনেক দিন লাগতে পারে।

বিডিআর বিদ্রোহের প্রায় এক মাস পর ২০০৯ সালের ২৬ মার্চ ওয়াশিংটনে আরেকটি তারবার্তা (১৯৮৯৫২ : গোপনীয়) পাঠায় যুক্তরাষ্ট্রের দিল্লি দূতাবাস। সে সময় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের কর্মকর্তাদের বলেন, বিদ্রোহের সঙ্গে ধর্মীয় কট্টরপন্থী দলের সম্ভাব্য যোগসূত্র নিয়ে দিল্লি উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, বিদ্রোহের হোতাদের অনেকে আগের বিএনপি সরকারের সময়ে নিয়োগ পায় এবং তাদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্ক রয়েছে।

এর কয়েক দিন পরেই (১৩ এপ্রিল) ভারতের পররাষ্ট্রসচিব শিবশঙ্কর মেনন ঢাকা সফর করেন। দিল্লি ফিরে গিয়ে শিবশঙ্কর যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার বারলেইয়ের সঙ্গে একটি বৈঠক করেন। আলোচনায় ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বলেন, বিডিআর বিদ্রোহের পর বাংলাদেশ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। ওই বৈঠক সম্পর্কে ১৬ এপ্রিল ওয়াশিংটনে একটি তারবার্তা (২০২৬১৫ : গোপনীয়) পাঠায় দূতাবাস।

যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে আশঙ্কা প্রকাশ করে শিবশঙ্কর বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে উগ্রপন্থীরা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকারকে অস্থিতিশীল করতে পারে। এতে ভারতে জঙ্গিগোষ্ঠীর হামলা চালানোর সুযোগ তৈরি হবে। কোন গোষ্ঠীগুলোর ব্যাপারে ভারত সরকার উদ্বিগ্ন_ রাষ্ট্রদূতের এমন প্রশ্নের জবাবে শিবশঙ্কর বলেন, জামায়াতে ইসলামী থেকে শুরু করে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী, বাংলাদেশের (হুজি, বি) মতো জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো নিয়ে ভয় পাওয়ার কারণ রয়েছে।

শিবশঙ্কর বলেন, যদিও খুব মামুলি ইস্যু প্রায়ই বাংলাদেশের রাজনীতিকে হজম করে ফেলে, তার পরও তিনি বিস্মিত, কারণ বিদ্রোহের পর চরম অস্থিতিশীলতা তৈরি হলেও বাংলাদেশের রাজনীতিকরা বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার বাড়ির মতো কিছু বিষয় নিয়ে ব্যস্ত আছেন। পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের দোদুল্যমানতা নিয়ে ভারত উদ্বিগ্ন ছিল। মেনন ধরে নিয়েছিলেন, বাংলাদেশ সরকার ঠিকমতো কাজ করছে না।

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন