8 January 2011

বৈরী হাওয়ায় টালমাটাল জামায়াতকর্মীরা হতাশ

সেলিম জাহিদ

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক পাঁচ শীর্ষস্থানীয় নেতার শূন্যতা কাটাতে পারছে না জামায়াতে ইসলামী। দলের এই নীতিনির্ধারকদের গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে শুরুর দিকে জামায়াত আন্দোলনে নামার চেষ্টা করে। তবে সে চেষ্টা সফল হয়নি। একদিকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষে দেশব্যাপী প্রবল জনমত, অন্যদিকে বিভিন্ন মামলায় দলের আরো অনেক নেতা-কর্মীর গ্রেপ্তার হওয়াÑসব মিলিয়ে কঠিন অবস্থায় জামায়াত। এ অবস্থায় ভেঙে গেছে দলীয় কর্মীদের মনোবল। গতি নেই সাংগঠনিক কর্মসূচিতেও।
জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা ছাড়াও আরো তিন গুরুত্বপূর্ণ নেতা পাঁচ মাস ধরে কারাগারে আছেন বিভিন্ন মামলায়। তাঁদের মুক্তির দাবিতে রাজপথে নামার বিষয়ে প্রথম দিকে এক ধরনের জেদ ছিল কর্মীদের মনে। এখন আর তেমনটি নেই।
মতিঝিল থানা জামায়াতের কর্মী আবদুল বাসেত কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারের উগ্র আচরণে আমাদের কর্মীদের মধ্যে কিছুটা হতাশা জন্মেছে, এটা ঠিক। আবার সরকারের মেয়াদও অনেক বাকি। এ কারণে অনেকে চুপচাপ আছে।’
শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মুক্তির দাবিতে জামায়াত বারবার কঠিন আন্দোলনের হুমকি দিয়ে এলেও কার্যত বিক্ষোভ সমাবেশের বাইরে কোনো কর্মসূচি দিতে পারেনি। খোদ রাজধানীতেই রাস্তায় নামতে পারেনি দলটি। সর্বশেষ গত ২৯ ডিসেম্বর দলের বিক্ষোভ সমাবেশে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি এ টি এম আজহারুল ইসলাম প্রথমবারের মতো হরতালের কথা উচ্চারণ করেন।
সামনে জোরালো কর্মসূচি আছে কি না, জানতে চাইলে এ টি এম আজহার বলেন, ‘কর্মসূচি দেব কিভাবে, সরকার তো আমাদের মাঠই দিচ্ছে না, এমনকি কমিউনিটি সেন্টারও ভাড়া নিতে দিচ্ছে না। আমাদের এত ভয় কেন, জানি না। এ অবস্থা বেশি দিন থাকবে না।’
কবে নাগাদ এ অবস্থার অবসান হবে, জিজ্ঞেস করলে জামায়াতের এই নেতা বলেন, ‘এখন তো নির্বাচন (পৌরসভা) শুরু হচ্ছে। এটাও তো আন্দোলনেরই অংশ।’
জানা গেছে, সারা দেশে জামায়াতের স্বাভাবিক তৎপরতা নেই। এখনো জেলা ও থানাপর্যায়ের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কার্যালয় তালাবদ্ধ। কেন্দ্র ঘোষিত কোনো কর্মসূচি পালিত হয় না ওই সব এলাকায়। অন্যদিকে ছাত্রশিবিরের তৎপরতা চলছে অনেকটা নিষিদ্ধ সংগঠনের মতো। কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদ দীর্ঘদিন বসতে পারেনি পল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। সংগঠনের সভাপতি ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিমের প্রকাশ্য তৎপরতা নেই। আত্মগোপনে থেকেই সম্প্রতি তাঁকে বিদায় নিতে হয়েছে সভাপতির পদ থেকে। তবে সংগঠন দুটি নানা কৌশলে কর্মীদের উজ্জীবিত রাখার চেষ্টা করছে।
নিজামী গ্রেপ্তার হওয়ার পর নিয়োগপ্রাপ্ত ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদের মেয়াদ আরো ছয় মাস বাড়ানো হয়েছে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার বৈঠকের পর জামায়াত এখন ২০১১ সালে সংগঠনের বার্ষিক পরিকল্পনা করছে। সারা দেশে থানা আমির নির্বাচন শেষ পর্যায়ে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে শিবিরের এবং জুলাই মাসে জামায়াতের ওপর যে ধাক্কা আসে, তা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি সংগঠন দুটি। গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগকর্মী ফারুক হোসেন হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে চিরুনি অভিযান চালায়। এটি ছিল শিবিরের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের সময় প্রথম ধাক্কা।
ফারুক হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন অভিযোগে সারা দেশে জামায়াত-শিবিরের প্রায় সাড়ে তিন হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের মধ্যে ৭৫০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নেওয়া হয়। জানা গেছে, গ্রেপ্তার ও মামলার ভয়ে কর্মীরা পিছু হটেছে। জামিনে মুক্ত হওয়া কর্মীদের বড় একটি অংশকে মাঠে দেখা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় ইচ্ছা থাকলেও মাঠের আন্দোলন-কর্মসূচি দিতে সাহস পাচ্ছেন না দলের নীতিনির্ধারকরা। বরং তৃণমূল নেতাদের সতর্কতার সঙ্গে তৎপরতা চালানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে কেন্দ্র থেকে। গোপন বৈঠক বন্ধ রেখে দলীয় কার্যালয়ে বসে সাংগঠনিক বৈঠক করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কর্মীদের মনোবল ভেঙে যাওয়া কিংবা সংগঠন দুর্বল হওয়ার বিষয়টি অবশ্য স্বীকার করেন না জামায়াত নেতারা। জামায়াতের ঢাকা মহানগরীর একটি থানার আমির জানান, তাঁরা ধৈর্য ধরে অপেক্ষায় আছেন। দলের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা আবদুল হালিম বলেন, ‘অন্য দলের নেতা গ্রেপ্তার হলে কর্মীরা নেতিয়ে যায়। আমাদের নেতা গ্রেপ্তার হলে কর্মীদের নৈতিক মান আরো উজ্জীবিত হয়।’ এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সদস্য ও সাবেক শিবির সভাপতি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ দাবি করেন, ‘দুটি ধকল কাটিয়ে আমাদের নেতা-কর্মীরা মানসিক ও রাজনৈতিক উভয় দিক থেকে নিজস্ব অবস্থানে ফিরে এসেছে।’
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে দায়ের করা একটি মামলায় গত বছরের ২৯ জুলাই মতিউর রহমান নিজামী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ গ্রেপ্তার হন। ১৩ আগস্ট গ্রেপ্তার হন দলের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা। সর্বশেষ গ্রেপ্তার হন অন্য সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মুজিবুর রহমান। ভিন্ন মামলায় ঢাকা মহানগর জামায়াতের আমির রফিকুল ইসলাম খান, রাজশাহীর আমির আতাউর রহমান ও খুলনা মহানগর আমির মিয়া গোলাম পরওয়ার গ্রেপ্তার হন। সব মিলিয়ে দলের গুরুত্বপূর্ণ এক ডজন নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামায়াতে এলোমেলো অবস্থা দেখা দেয়। কর্মীদের ভেতরেও আতঙ্ক ও হতাশা নেমে আসে।
শুরুতে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মুক্তির দাবি ছিল জামায়াতের মুখ্য ইস্যু। দাবিটি ধীরে ধীরে নিচে নামছে। গত ৭ ডিসেম্বর জামায়াতের পক্ষ থেকে সারা দেশে জেলা প্রশাসকদের দেওয়া স্মারকলিপিতে যে ৯টি দাবির উল্লেখ করা হয়, এর আট নম্বরে ছিল নিজামী ও মুজাহিদের মুক্তির বিষয়টি।
জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি এ টি এম আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মুক্তির দাবি নিচে নেমে গেছে, কথাটি ঠিক নয়। আমরা সব সময় তাঁদের মুক্তির দাবি জানিয়ে আসছি। এ মুহূর্তে আমরা জাতীয় ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করছি। উনারা (নিজামী, মুজাহিদ প্রমুখ) জাতীয় নেতা। তাই জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মুক্তির দাবিও এখন একটি জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।’

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন