নিজস্ব প্রতিবেদক
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল রাখার পাঁয়তারা চলছে। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির এ চেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযোগ, শিবিরের বেশ কিছু নেতা-কর্মী কৌশলে বড় দুই ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলে অনুপ্রবেশ করে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাচ্ছে। ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারীরা বেশি সক্রিয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত বেশির ভাগ সঙ্ঘাত-সংঘর্ষের পেছনেই অনুপ্রবেশকারী শিবিরকর্মীদের ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নতুন কমিটিতেও শীর্ষ পদ পেতে চেষ্টা করছেন শিবিরঘেঁষা কয়েকজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক-কর্মকর্তা তাঁদের মদদ দিচ্ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এরকম অনুপ্রবেশ যে হচ্ছে তা আমরাও আন্দাজ করেছিলাম। পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করার পর এখন আরো নিশ্চিত হলাম। এজন্য এখন আমাদের আরো বেশি সতর্ক হতে হবে।' ছাত্রলীগের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন 'এ বিষয়ে তাদের বেশি সতর্ক হতে হবে।'
পুলিশ ও ছাত্রলীগ নেতারাও এ ধরনের অনুপ্রবেশের কথা স্বীকার করেছেন। তবে কেউ কেউ বলেছেন, নিজেদের দোষ অন্যের ওপর চাপানোর জন্যই এখন এসব কাদা ছোড়াছুড়ি হচ্ছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত ঘোষিত কমিটির সভাপতি কামরুল হাসান রিপন ছাত্রলীগে শিবিরের অনুপ্রবেশের কথা স্বীকার করে বলেন, 'বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে আমাদের দলের মধ্যম সারির কিছু নেতা দল ভারী করতে শিবিরকর্মীদের দলে টানেন। পরে তাঁরাই শিবিরের এজেন্ট হয়ে ক্যাম্পাসে নানা রকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটান। আমি বারবার এসব ঘটনায় বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একজন শীর্ষ নেতার কারণে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। এখন তিনজন গ্রেপ্তার হওয়ার পর প্রমাণ হলো আমি যা বলেছিলাম তা ঠিক।' তিনি দুঃখ করে বলেন, 'কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ এই অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে হঠাৎ করে কমিটিই বিলুপ্ত করে দিল। এর মাধ্যমে শিবিরকে রক্ষা করে মূলত ছাত্রলীগকেই দমন করা হলো।'
কোতোয়ালি থানার ওসি সালাহউদ্দিন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অনেক আগে থেকেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। শিবির ছাত্রলীগে ঢুকে ঠুনকো বিষয়ে ছাত্রলীগের নামে গণ্ডগোল বাধাচ্ছে। তবে আমরা আইনবিরোধী যেকোনো কর্মকাণ্ডের বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছি।'
বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা জানান, ছাত্র রাজনীতির গুরুত্ব বিবেচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর যে কটি প্রতিষ্ঠানের নাম আসে, এর অন্যতম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। তা ছাড়া অবৈধ পথে টাকা রোজগারের সুযোগও এখানে বেশি। এজন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়টি দখলে রাখতে ছাত্র সংগঠনগুলো বেশ তৎপর। ঢাকার অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় হতে না পেরে ছাত্রশিবির এখানে ঢোকার চেষ্টা করেছে নানাভাবে। চারদলীয় জোট সরকারের শেষ সময়েও তাঁরা এই প্রতিষ্ঠানে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করে। তবে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের বাধার কারণে সফল হয়নি। এরপর তারা ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। তারা নানা কায়দায় ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলে অনুপ্রবেশ করতে শুরু করে।
ছাত্রলীগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগের কিছু নেতা দল ভারী করতে শিবিরকর্মীকেও কাছে টানেন। বর্তমানে অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা বেশ বেড়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে প্রথম দিকের অনুপ্রবেশকারীরা 'ছাত্রলীগের চেয়েও বেশি ছাত্রলীগ' হয়ে নানা ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাতে থাকে। ছাত্রলীগ সেজে তারা মূলত এসব ঘটনার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করে রাখতে চায়।
ছাত্রলীগের একটি সূত্রে জানা যায়, গত ২১ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটায় শিবির থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীরাই। এই ঘটনায় পুলিশ যে কজনকে গ্রেপ্তার করে তারা বিষয়টি স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তারকৃতদের বাসার সামনে বঙ্গবন্ধুর ছবি টানানো থাকলেও ভেতরে নানা ধরনের 'জিহাদি' বই পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, ২১ ডিসেম্বরের সংঘর্ষের ঘটনায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করার পর এখন নতুন কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এ জন্য পদ প্রত্যাশীরা শুরু করেছেন তদবির ও গ্রুপিং। শীর্ষ পদের প্রত্যাশী অন্তত তিনজন রয়েছেন, যাঁরা শিবিরঘেঁষা। অভিযোগ পাওয়া গেছে, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একটি অংশের সমর্থন রয়েছে তাঁদের প্রতি। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন বলেন, 'নতুন কমিটিতে পরীক্ষিত নেতারাই ঠাঁই পাবেন।' কমিটি করতে কিছুদিন সময় লাগবে বলেও তিনি জানান।
এদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যেও দলাদলি শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি উপাচার্যের কাছে অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে। প্রক্টরিয়াল বডির পদত্যাগের কথাও শোনা যায়। তবে উপাচার্য ও প্রক্টর দুইজনই পদত্যাগের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। উপাচার্য অধ্যাপক মেসবাহ উদ্দিন বলেছেন, 'পদত্যাগের কথা ঠিক নয়।'
প্রক্টর কাজী আসাদুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'দেখা গেছে কিছু ঘটনার জন্য প্রক্টরিয়াল বডিকে দায়ী করা হয়। প্রকৃত ঘটনা এড়িয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়। এসব ঘটনা আমরা উপাচার্যকে জানিয়েছি। তবে পদত্যাগ করিনি।' শিবিরের অনুপ্রবেশের বিষয়ে তিনি বলেন, 'অনুপ্রবেশ যে ঘটছে তার তো অকাট্য প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে। এজন্য আমরা আরো সতর্ক। আর যাতে কোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলা হয়েছে। ছাত্রনেতাদেরও বলে দেওয়া হয়েছে, একাডেমিক কর্মকাণ্ডের স্বার্থবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ড মানা হবে না।'
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন