নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম | তারিখ: ০৮-১০-২০১০
চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানার (সিইউএফএল) জেটিঘাটে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনায় শিল্প মন্ত্রণালয়কে জড়িয়ে খবর প্রকাশের পরও কোনো ব্যাখ্যা বা ব্যবস্থা নিতে দেননি তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী। বরং মন্ত্রণালয়ের সচিব শোয়েব আহাম্মদ এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললে নিজামী জবাবে বলেছিলেন, এ বিষয়ে দেশের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ অবগত আছে। সরকার সব ব্যবস্থা নিচ্ছে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা শোয়েব আহাম্মদ গতকাল বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ তথ্য জানান।
তৎকালীন শিল্পসচিব শোয়েব আহাম্মদ জবানবন্দিতে বলেন, ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাতে বিসিআইসির নিয়ন্ত্রণাধীন সিইউএফএল জেটিঘাটে খালাসের সময় অবৈধ সমরাস্ত্রের বিশাল চালানটি ধরা পড়ে। ৪ এপ্রিল তিনি শিল্পমন্ত্রী নিজামীকে বিষয়টি জানান। তিনি বলেন, ‘সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আমি শিল্পমন্ত্রীর কক্ষে যাই।...বলি, শুক্রবার ইমামুজ্জামান সাহেব (বিসিআইসির তৎকালীন চেয়ারম্যান) ফোন করেছিলেন। তিনি আমাকে সিইউএফএলের ঘাটে অস্ত্র আটকের ব্যাপারে জানিয়েছেন। আমার কথা শেষ করতে না-করতেই মন্ত্রী বলেন, “আমি এ বিষয় সবকিছু অবগত আছি।” মন্ত্রীকে বলি, ইমামুজ্জামান সাহেবকে নির্দেশ দিয়েছি সিইউএফএলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংশ্লিষ্টতা থাকলে, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।...তাঁকে এটাও বলি, আজ ইমামুজ্জামান সাহেব আসবেন এবং গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে জানাবেন। তিনি বলেন, তখন শিল্পমন্ত্রী নিজামী তাঁকে বলেছেন, এই অস্ত্র আটক বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাও মাঠে নেমেছে। তারা জিজ্ঞাসাবাদ করছে। সিইউএফএলের কেউ জড়িত কি না, তা তাঁরাই বের করতে পারবেন। এ ব্যাপারে শিল্প মন্ত্রণালয়কে আলাদাভাবে কিছু করতে হবে না।’
শোয়েব আহাম্মদ জবানবন্দিতে বলেন, ‘তখন আমি তাঁকে (নিজামী) বলি, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এ সম্পর্কে যে খবরগুলো দেখেছি, তাতে শিল্প মন্ত্রণালয়কে জড়িয়ে খবর পরিবেশিত হয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের অবশ্যই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এ জন্যই আমি বিসিআইসির চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দিয়েছি ব্যবস্থা নিয়ে মন্ত্রণালয়কে জানাতে। আমি মনে করি, তা দরকার আছে। এ পর্যায়ে তিনি (নিজামী) বলেন, “দেশের হাইয়েস্ট অথরিটিও (সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ) এ বিষয়ে অবগত আছে। সরকার সব ব্যবস্থা নিচ্ছে।” তিনি আমাকে আরও বলেন, “আপনি কি মনে করেন, আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলি নাই।” ওই সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কোনো পূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন।’
সাবেক শিল্পসচিব আদালতে বলেন, শিল্পমন্ত্রী নিজামীর সঙ্গে আলাপের সময় তিনি ওই দিনের একটি সংবাদের বিষয়ে বলেছিলেন, বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, ঘটনার রাতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব নুরুল আমিন সিইউএফএলের রেস্টহাউসে অবস্থান করছিলেন। এ সম্পর্কে শিল্পসচিব কিছুই জানতেন না। নুরুল আমিন কবে কখন সেখানে গেছেন, চট্টগ্রাম সফর কর্মসূচি কীভাবে করলেন, তাও বুঝতে পারছেন না বলে তিনি নিজামীকে বলেছিলেন। শিল্পসচিব বলেন, ‘মন্ত্রী বলেন, “আপনি তো সরকারি কাজে বেশ কিছুদিন বিদেশে ছিলেন, এ সময় অতিরিক্ত সচিব নুরুল আমিন তো সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। সেভাবেই হয়তো তিনি এ ট্যুরে গিয়ে থাকবেন।” আমি তখন বললাম, আজ রোববার, তিনি এখনো ফিরেননি। সিইউএফএলের এত বড় ঘটনা সম্পর্কে তিনি ঘটনাস্থলে অবস্থান করা সত্ত্বেও কিছুই জানাননি। একটা ফোন পর্যন্ত করেননি। আমি অফিসে এসে শুনলাম, তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে সিইউএফএল থেকে কক্সবাজার চলে গেছেন। তখন মন্ত্রী মহোদয় বলেন, “এটা তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার।” আমি বলেছি, এত বড় একটা ঘটনার সময় তাঁর সেখানে অবস্থান এবং কিছু না জানানো আমি যথার্থ মনে করি না। তিনি (নিজামী) বলেন, “আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন। সরকার এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।” এরপর আমি আমার কক্ষে চলে যাই।’
শোয়েব আহাম্মদ আদালতে বলেন, অতিরিক্ত সচিব নুরুল আমিন পরে ঢাকায় ফিরলেও তাঁর সঙ্গে দেখা করেননি। তিনি বলেন, নুরুল আমিন মন্ত্রী মহোদয়ের অত্যন্ত আস্থাভাজন লোক ছিলেন। মন্ত্রী মহোদয়ই তাঁকে শিল্প মন্ত্রণালয়ে নিয়ে আসেন। তিনি মূলত রেলওয়ের ক্যাডারের অফিসার ছিলেন।
১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলায় শোয়েব আহাম্মদ গতকাল বেলা দুইটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমানের আদালতে এই জবানবন্দি দেন। এর আগে তাঁকে এ মামলায় সিআইডি জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল।
জবানবন্দিতে সাবেক এই শিল্পসচিব দাবি করেন, ‘অস্ত্র আটকের এ ঘটনা পরদিন সকালে বিসিআইসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ইমামুজ্জামান টেলিফোন করে জানান। তাঁকে (ইমামুজ্জামান) জিজ্ঞেস করি, ওখানে কি সিইউএফএলের নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন উপস্থিত ছিল না? তাদের উপস্থিতিতে সেখানে অবৈধ অস্ত্রের ট্রলার কীভাবে ভিড়ল, আর কীভাবেই বা সে অস্ত্রশস্ত্র আনলোড হলো? ইমামুজ্জামান বললেন, “এটা তো আমারও প্রশ্ন।” আমি তাকে নির্দেশনা দিই, বিসিআইসির চেয়ারম্যান হিসেবে সিইউএফএলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পৃক্ততা ও শৈথিল্য আছে কি না, তা নিরূপণ করতে হবে। কারণ, এটা আপনার অধীন শিল্প-কারখানা। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার পর আপনি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করবেন।’ শোয়েব আহাম্মদ বলেন, এই কথোপকথনে ইমামুজ্জামান জানান, তিনি বিষয়টি এরই মধ্যে শিল্পমন্ত্রীকেও জানিয়েছেন।
জবানবন্দিতে বলা হয়, তিন-চার দিন পর ইমামুজ্জামান সচিব শোয়েব আহাম্মদকে ফোন করে জানান, ‘স্যার, সিইউএফএল থেকে একটি রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। রিপোর্টে অস্ত্র আটক বিষয়ে কিছুই বলা নেই। সে রিপোর্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর মতো নয়। এই রিপোর্ট অত্যন্ত দায়সারা গোছের।’
শোয়েব আহাম্মদ বলেন, ‘জুন মাসে ইন্দোনেশিয়া থেকে ফেরার পর মন্ত্রী একদিন বলেন, “আমি আপনাকে বলেছিলাম, সরকার এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, স্বরাষ্ট্রসচিবের নেতৃত্বে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা তাদের কার্যক্রমও গ্রহণ করেছে। আমি তো মনে করি, সরকার যথোপযুক্ত ব্যবস্থাই নিয়েছে”।’ জবানবন্দিতে সাবেক সচিব আরও বলেন, এরপর এ বিষয়ে শিল্পমন্ত্রী নিজামীর সঙ্গে তাঁর আর কখনো কোনো কথা হয়নি। তাঁর মনে হয়েছিল, নিজামী এ বিষয়ে কথা বলতে অপছন্দ করেন। কিছুদিন পর ২৮ জুলাই (২০০৪) তাঁকে অপ্রত্যাশিতভাবে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে বদলি করা হয়।
শোয়েব আহাম্মদ বলেন, অস্ত্র আটকের পর যে তিন মাস তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়ে ছিলেন, তাতে তাঁর মনে হয়েছে, প্রকৃত ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। মন্ত্রী মহোদয়ের কথাবার্তা এবং অতিরিক্ত সচিব নুরুল আমিনের রহস্যজনক আচরণ দেখে মনে হয়েছে, পুরো ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
প্রসঙ্গত, এর আগে গত মঙ্গলবার বিসিআইসির সাবেক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ইমামুজ্জামান আদালতে এ মামলায় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন