নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম | তারিখ: ০৬-১০-২০১০
চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানার (সিইউএফএল) জেটিঘাটে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনায় বাংলাদেশ রসায়নশিল্প সংস্থাকে (বিসিআইসি) কোনো ব্যবস্থা নিতে দেননি তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী। বিসিআইসির তখনকার চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ইমামুজ্জামানের কাছে পুরো ঘটনা জানার পর একেবারে নিশ্চুপ হয়ে যান নিজামী। ইমামুজ্জামানের ভাষায়, ‘তাঁকে (নিজামী) ওই সময় কিছুটা গম্ভীর ও চিন্তান্বিত মনে হয়েছে।’
মেজর জেনারেল (অব.) ইমামুজ্জামান গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ কথা বলেন।
২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাতে বিসিআইসির নিয়ন্ত্রণাধীন সিইউএফএল জেটিঘাটে খালাসের সময় অবৈধ সমরাস্ত্রের বিশাল চালানটি ধরা পড়ে। আদালতে ইমামুজ্জামান দাবি করেন, অস্ত্র আটকের ঘটনায় বিসিআইসির চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁর বক্তব্য জানার জন্য ২ এপ্রিল সকালে চট্টগ্রামের এক সাংবাদিক ফোন করার পর তিনি ঘটনাটি জানতে পারেন। দুই দিন পর তিনি শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী ও মন্ত্রণালয়ের সচিব শোয়েব আহমেদের সঙ্গে দেখা করে বিস্তারিত জানান। কিন্তু তাঁরা কোনো দিকনির্দেশনা দেননি।
নিজামীর সঙ্গে দেখা করার বর্ণনা দিয়ে ইমামুজ্জামান আদালতে বলেন, ‘রোববার (৪ এপ্রিল, ২০০৪) সচিবের কক্ষ থেকে বের হয়ে আমি মন্ত্রীর কক্ষে যাই। উনাকে বিষয়টি পুরোপুরি খুলে বলার চেষ্টা করি। আমি অস্ত্র আটকের ব্যাপারে কিছু বলতে না-বলতেই তিনি (নিজামী) বলেন, “আমি বিষয়টা শুনেছি। এটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হ্যান্ডেল করছে। সেহেতু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিচ্ছে। কাজেই আমাদের কোনো কিছু করার প্রয়োজন নেই।” মনে হলো, তিনি (নিজামী) ব্যাপারটা এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। আমি তাঁকে দু-তিনবার জিজ্ঞেস করি, স্যার, এ ব্যাপারে আমাদের কিছু করতে হবে? স্যার, আপনি কি কোনো তদন্ত টিম গঠন করে দেবেন? তিনি (নিজামী) আমার কথার কোনো জবাব দেননি। হ্যাঁ-না কিছুই বলেননি। এ ব্যাপারে মন্ত্রী একেবারে নিশ্চুপ ছিলেন। তাঁকে ওই সময় কিছুটা গম্ভীর ও চিন্তান্বিত মনে হয়েছে। আমি হতাশ হয়ে মন্ত্রীর কক্ষ থেকে বের হয়ে আসি। আমি ভাবছিলাম, এত বড় একটা ঘটনা ঘটল। অথচ কারও কাছ থেকে কোনো নির্দেশনা পাচ্ছি না।’
১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় সাক্ষী হিসেবে ইমামুজ্জামানের এই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ করেন চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমান। বেলা আড়াইটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত হাকিমের খাস কামরায় জবানবন্দি নথিভুক্ত করা হয়।
১২ পৃষ্ঠার এই জবানবন্দিতে ইমামুজ্জামান বলেন, ওই অস্ত্রের চালান আটকের রাতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. নুরুল আমিন সিইউএফএলে রেস্ট হাউসে ছিলেন। ওই দিন ছিল শুক্রবার সরকারি ছুটির দিন। রোববার তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়ে গিয়ে শিল্পসচিব শোয়েব আহমেদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘তিনি (সচিব) আমাকে কোনো নির্দেশনা দেননি। তিনি বলেন, আমি (সচিব) মন্ত্রী মহোদয়কে বলেছি। এবার আপনিও বলেন। তিনি আপনার মুখেই শুনুক।’
জবানবন্দিতে আরও বলা হয়, অস্ত্র আটক ঘটনায় ইমামুজ্জামান সিইউএফএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে বিস্তারিত প্রতিবেদন চেয়ে পাঠান।
ইমামুজ্জামান বলেন, ‘সিইউএফএলের এমডির কাছে ফোন করে অস্ত্র আটকের পুরো বিষয়টি জানতে চাই। আর আমাকে শুরু থেকে না জানানোর ব্যাপারে কৈফিয়ত তলব করি।...এমডি বলেন, পুরো এলাকাটা ফোর্স ঘিরে রেখেছে। ডিজিএফআই, এনএসআই ও পুলিশের লোকজন আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে।...আমি তাঁকে নির্দেশ দিই, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সার্বিক বিষয়ে লিখিত প্রতিবেদন দেবেন।’
জবানবন্দিতে বিসিআইসির সাবেক চেয়ারম্যান ইমামুজ্জামান আরও বলেন, ওই সপ্তাহে তিনি সিইউএফএল থেকে তলবকৃত প্রতিবেদন পান। তাঁর ভাষায়, প্রতিবেদনটি ছিল অত্যন্ত দায়সারা গোছের। অবৈধ অস্ত্র আটক হয়েছে, এমন একটি শব্দ ছিল না তাতে। প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে উল্লেখ ছিল, ‘অবৈধ মালামাল আটক হয়েছে। ডিসি পোর্টের নেতৃত্বে তা আটক করে ফোর্সের মাধ্যমে চট্টগ্রাম শহরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, প্রতিবেদনটি মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) এনামুল হকের সই করা ছিল। কিন্তু নিয়ম হলো, বিসিআইসিতে পাঠানো চিঠি বা প্রতিবেদনে ব্যবস্থাপনা পরিচালক সই করবেন।
ইমামুজ্জামান আদালতে বলেন, আরও বিভিন্ন সূত্র থেকে নেওয়া তথ্যসহ এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে এ-সংক্রান্তে তাঁর সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। মন্ত্রী, সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব কিংবা অন্য কেউ এ ব্যাপারে বিসিআইসির চেয়ারম্যানের সঙ্গে আর কোনো আলোচনা করেননি। তিনি আদালতকে বলেন, ‘আমাদের দুর্ভাগ্য যে বিসিআইসির অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান সিইউএফএল ঘাটে অবৈধ অস্ত্র আটক হয়। আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। উনারা ব্যাপারটা নিয়ে অনাগ্রহ ও অনীহা দেখিয়েছেন।’
প্রসঙ্গত, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার তদন্ত বেশি দূর এগোতে পারেনি। এক-এগারোর পট পরিবর্তনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নতুন করে তদন্ত শুরু হলে সমরাস্ত্রের এই অবৈধ চালানের সঙ্গে প্রভাবশালী কয়েকজনের সম্পৃক্ততার কথা বেরিয়ে আসে। উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার জন্য এসব অস্ত্র আনা হয়েছিল। চীনের সমরাস্ত্র কারখানা থেকে অস্ত্রগুলো আনা ও খালাসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দুটি গোয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা ছিল বলে সিআইডির তদন্ত ও বিভিন্ন সাক্ষীর বক্তব্য থেকে জানা গেছে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর জোট সরকার আমলে সামরিক গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, এনএসআইয়ের পরিচালক উইং কমান্ডার (অব.) সাহাবউদ্দিন, উপপরিচালক মেজর (অব.) লিয়াকত হোসেন, মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন, সিইউএফএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসীন তালুকদার, সাবেক মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) এনামুল হক, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকে এই মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়।
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন