21 September 2010

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার: জামায়াতের চার নেতার মুক্তির আবেদন খারিজ

নিজস্ব প্রতিবেদক | তারিখ: ২২-০৯-২০১০

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধ করার অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার মুক্তি চেয়ে করা আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গতকাল মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল ওই চার নেতার পক্ষে করা চারটি আবেদনই খারিজ করে দেন। একই সঙ্গে আরও দুটি আবেদন উপস্থাপন করা হয়নি বলে খারিজ করে দেওয়া হয়।

গতকাল সকালে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে কড়া নিরাপত্তা-ব্যবস্থায় ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তবে তাঁকে আটক রাখার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের (প্রসিকিউটর) করা আবেদনে সন্তুষ্ট না হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল সম্পূরক আবেদন দিতে বলে শুনানি মুলতবি করেন। সাঈদীকে আজ বুধবার হাজির করারও নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। তবে কারা সূত্রগুলো গতকাল রাতে জানিয়েছে, সাঈদী অসুস্থতা বোধ করায় তাঁকে আজ হাজির করা হবে না।

নিজামীসহ চার জামায়াত নেতার পক্ষে করা ছয়টি আবেদনের ওপর গতকাল শুনানি হয়। অভিযোগ গঠনের আগে ট্রাইব্যুনালের সব কার্যক্রম স্থগিত করাসহ তিনটি আবেদন খারিজ করা হয়। অপর দুটি আবেদনের মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তাঁদের বিরুদ্ধে করা পল্লবী ও কেরানীগঞ্জ থানায় করা দুটি মামলার নথিপত্র মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে পাঠানো এবং ট্রাইব্যুনালে তাঁদের করা আবেদন ও অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের অনুলিপি (সার্টিফাউড কপি) সরবরাহের আবেদন ছিল। এ ছাড়া চারজনের পক্ষে মনোনীত ব্যক্তিকে মামলা পরিচালনার ক্ষমতা অর্পণ (লেটার অব অথরিটি) এবং তাঁদের বিরুদ্ধে ২৬ জুলাই জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আদেশ প্রত্যাহার চেয়ে পৃথক দুটি আবেদন উপস্থাপন করা হয়নি বিবেচনায় খারিজ করে দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।

সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ: গতকাল শুনানির শুরুতে সাঈদীর পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য ওকালতনামা জমা দেন আইনজীবী তাজুল ইসলাম। এরপর সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগের শুনানিতে প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, ‘যে মামলার অভিযোগ পড়ব, তা সাধারণ কোনো মামলা নয়।’ তিনি বলেন, ‘একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধকালে অপরাধ সংগঠনকারী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ওরফে দেলু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন এজাজের সঙ্গে দেখা করে পাকিস্তান রক্ষা করার প্রয়োজনীয় সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতার অঙ্গীকার করেন। ক্যাপ্টেন এজাজের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি করার পর তিনি স্থানীয় জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠন নিয়ে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনী গঠন করে নিজেদের পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়ক বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁরা স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে পিরোজপুরসহ আশপাশের এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নাগরিকদের হত্যা, বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের উদ্দেশে নারীদের পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে জোর করে তুলে দিয়ে অপরাধ সংঘটন করেন।’

হায়দার আলী আরও বলেন, দেলু ও তাঁর সহযোগীরা ১৯৭১ সালের ৮ মে আনুমানিক দুপুর তিনটায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সমর্থনকারী, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের আলমগীর পশারী, মাহবুব পশারী, চান মিয়া পশারী ও জাহাঙ্গীর পশারীদের (সাং-চিতলিয়া, থানা ও জেলা পিরোজপুর) বাড়ি ঘেরাও করেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে বাড়ি-ঘরে অনুপ্রবেশ করে ঘরে থাকা নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার ও মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করেন তাঁরা। তাঁরা বাড়িঘর পুড়িয়ে দেন। ২ জুন আনুমানিক ১০টার সময় দেলুর নেতৃত্বে অন্য অপরাধীরা পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে টেংরাখালী গ্রামের পূর্ব সীমানায় উমেদপুর গ্রামের হিন্দুপাড়ায় যান। তাঁরা গ্রামটি ঘেরাও করে প্রত্যেক ঘরে অনুপ্রবেশ করে নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার ও মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে তাদের উচ্ছেদ করতে বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন। অপরাধী রাজাকার বাহিনী পিরোজপুর এলাকার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সঙ্গে নিয়ে মুক্তিবাহিনীকে হত্যা করার নামে গ্রামের নিরীহ শান্তিপ্রিয় নাগরিক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্রদের হত্যা করে লাশ গুম করে রাখেন ও যুবতীদের ধরে এনে পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে অমানুষিক নির্যাতন ও ধর্ষণ করে হত্যা করেছেন বলে তথ্য-প্রমাণ রয়েছে।

শুনানিতে সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত এসব মানবতাবিরোধী অপরাধ আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ৩(২) ধারার আওতায় অন্তর্ভুক্ত। ১৯৭৩ সালের আইনের ১১(৫) ধারা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তদন্তের বৃহত্তর স্বার্থে তাঁকে আটক বা গ্রেপ্তার রাখা একান্ত প্রয়োজন। এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের কাছে প্রয়োজনীয় আদেশ প্রার্থনা করছি। এ পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল আইনজীবীর উদ্দেশে বলেন, ১১(৫) ধারা অনুযায়ী যুক্তি নেই। জবাবে হায়দার আলী বলেন, আইনের ধারাগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে সম্পৃক্ত। অপরাধের তদন্ত চলাকালে তদন্তকারী কর্মকর্তা যেকোনো সময় এ ধরনের অপরাধের অভিযোগ রয়েছে, সে ব্যক্তিকে আটক বা গ্রেপ্তার করার জন্য আবেদন করতে পারবেন। সাঈদীকে আটক রাখার ব্যাপারে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। তদন্তের বৃহত্তর স্বার্থে তাঁকে আটক রাখা দরকার।

ট্রাইব্যুনাল বলেন, সাঈদীকে আটক বা গ্রেপ্তার রাখার উদ্দেশ্য কী তার যুক্তি (গ্রাউন্ড) বর্ণনা করতে হবে। এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালকে সন্তুষ্ট করতে হবে। হায়দার আলী বলেন, আবেদনে বিষয়টি রয়েছে, তবে তা যথাযথ স্থানে উল্লেখ নেই। ট্রাইব্যুনাল বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা (ট্রাইব্যুনাল) সন্তুষ্ট হতে পারিনি। আবেদন যথাযথভাবে পেশ করুন। ট্রাইব্যুনালের এক সদস্য বলেন, সাক্ষ্য-প্রমাণ পাচ্ছেন, তাহলে কেন তাঁকে কারাগারে (কাস্টডি) রাখতে হবে।

এরপর ট্রাইব্যুনাল শুনানি মুলতবি করে সাঈদীকে কারাগারে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

অপর চারজনের আবেদন: জামায়াতের চার নেতার বিরুদ্ধে গত ২৬ জুলাই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইবুন্যাল। তবে অন্য মামলায় ওই সময় তাঁরা কারাগারে আটক থাকায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল না করে ফেরত পাঠায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরে ২ আগস্ট ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয় তাঁদের। ওই দিন পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত তাঁদের কারাগারে আটক রাখার নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এ আদেশ প্রত্যাহারসহ চারজনের পক্ষে ছয়টি আবেদন করা হয় আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে। বেলা ১১টা ২৮ মিনিট থেকে ১২টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত ট্রাইব্যুনাল ছয় আবেদনের ওপর শুনানি গ্রহণ করেন ও আদেশ দেন।

ছয় আবেদন: শুনানির শুরুতে আইনজীবী তাজুল ইসলাম চার জামায়াত নেতার পক্ষে একাধিক আইনজীবী মামলা পরিচালনা করবেন বলে জানান। এরপর আইনজীবী মাসুদ আহমেদ সাঈদ বলেন, লেটার অব অথরিটি দেওয়ার জন্য (মামলা পরিচালনার ক্ষমতা অর্পণপত্র) আবেদন জানান। ট্রাইব্যুনাল বলেন, ওকালতনামা দেওয়া হয়েছে। এরপরও এটি কেন প্রয়োজন? পরে আইনজীবী আবেদনটি প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা জানালে ট্রাইব্যুনাল তা উত্থাপিত হয়নি বলে খারিজ করে দেন।

আরেক কৌঁসুলি গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী গত ২৬ জুলাই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আদেশ প্রত্যাহারের আবেদন জানান। ট্রাইব্যুনাল বলেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা যখন কার্যকর হয়নি, তখন তা প্রত্যাহারের কী প্রয়োজন? তদন্ত চলছে। আইন অনুযায়ী পরোয়ানা জারি করা যায়। জবাবে গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী বলেন, অভিযোগ গঠনের আগেই ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়। এ পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল তাঁকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনাকে মনে রাখতে হবে, কী ঘটনার অভিযোগে বিচার হচ্ছে? এখানে একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হচ্ছে। এ আবেদনটিও উত্থাপিত হয়নি বলে খারিজ করে দেন ট্রাইব্যুনাল।

শেষ পর্যায়: জামায়াতে ইসলামীর চারজনের পক্ষে আইনজীবী ফখরুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের আলোকে সংবিধানের প্রথম সংশোধনী হয়। তৎকালীন আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর আইন ও সংবিধান সংশোধনের বিলটি সংসদে পেশ করেন। ওই সময় তিনি সংসদে বলেছিলেন, পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্যই আইন। এ ভূখণ্ডে ১৯৭১ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। এ সময় ট্রাইব্যুনাল ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, যুদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে। ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বিষয়টি রয়েছে। জবাবে ফখরুল ইসলাম বলেন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে যুদ্ধ শব্দটি নেই। এ বিতর্কের পর ফখরুল বলেন, পল্লবী ও কেরানীগঞ্জের যে দুটি মামলা ট্রাইব্যুনালে এসেছে তার কার্যক্রম স্থগিত থাকা প্রয়োজন। এ সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, এখানে কোনো মামলা আসেনি। এ বিষয়ে কোনো ধরনের কার্যক্রম ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন নেই। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনাল কোনো আদেশ দিয়ে হাকিম আদালত (ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট) থেকে মামলা আনেনি।

এরপর আইনজীবী তাজুল ইসলাম বলেন, ট্রাইব্যুনালে মামলা এসেছে। আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে। এ দুটি মামলার নথিপত্র মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে পাঠানোর আরজি জানান তিনি। ট্রাইব্যুনাল বলেন, এ ধরনের মামলা ট্রাইব্যুনালের কাছে নেই। তাই আবেদন খারিজ করা হলো। একপর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল মন্তব্য করেন ‘আপনারা নতুন, আইনটিও নতুন, আমরাও নতুন। সময়মতো সব ঠিক হয়ে যাবে।’

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন