21 September 2010

পাকিস্তান থেকে আকাশপথে আসে জাল মুদ্রা: সেই মজুমদারের খোঁজে গোয়েন্দারা

টিপু সুলতান | তারিখ: ২২-০৯-২০১০

পাকিস্তানকেন্দ্রিক মুদ্রা আন্তদেশীয় জালিয়াত চক্রের এ দেশের অন্যতম প্রধান নিয়ন্ত্রক সোলায়মান মজুমদারকে এখন খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। প্রতিবেশী একটি দেশ থেকেও মজুমদারের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র জানিয়েছে।
অভিযোগ আছে, মজুমদার পাকিস্তানের একটি সংস্থার সহায়তায় বাংলাদেশে বসে ভারত ও নেপালে জাল মুদ্রা বিপণনের সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া এ দেশের ধর্মভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদেরও এই তৎপরতায় যুক্ত করা এবং জঙ্গিদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
এই মজুমদার গত ফেব্রুয়ারি মাসে এক সহযোগীসহ একবার ধরা পড়লেও পাঁচ সপ্তাহের মাথায় জামিনে বেরিয়ে পাকিস্তান চলে যান। এরপর আবার তিনি পাকিস্তান থেকে জাল ভারতীয় রুপি ও মার্কিন ডলার ছাপিয়ে আকাশপথে বাংলাদেশ হয়ে ভারত ও নেপালে বাজারজাতের কারবার শুরু করেন। এ ব্যাপারে নানা তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার পর একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মজুমদারকে ধরার জন্য মাঠে নামে।
জানতে চাইলে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মজুমদার এখন এ দেশেই আছেন বলে গোয়েন্দা-তথ্য রয়েছে। তাঁকে ধরতে গত দুই সপ্তাহে বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি অভিযান চালানো হয়েছে। এরই মধ্যে চক্রটির দুই সদস্য ধরাও পড়েছেন। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে মুদ্রা জালিয়াত চক্রের তৎপরতা সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, মজুমদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, পাকিস্তানের একটি গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে মজুমদার এ দেশে জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) ও হরকাতুল জিহাদের (হুজি) মতো জঙ্গি সংগঠনকেও ভারতীয় জাল মুদ্রার কারবারে সম্পৃক্ত করেছেন। কয়েক বছরে বাংলাদেশ ও ভারতে গ্রেপ্তার হওয়া জাল মুদ্রার কারবারিদের কাছ থেকে উভয় দেশের গোয়েন্দারা এ তথ্য পান। এ ছাড়া এর আগে গ্রেপ্তার হওয়া জেএমবির আমির মাওলানা সাইদুর রহমান ও শুরা সদস্য রফিকুল ইসলাম ওরফে জোবায়েরের কাছ থেকেও এ ব্যাপারে তথ্য পায় পুলিশ। ২০০৮ সালের ২৯ অক্টোবর ঢাকায় বনশ্রী ও মিরপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ গ্রেপ্তার করে জেএমবির মুদ্রা জালিয়াত চক্রের কয়েকজনকে।
মূলত বর্তমান সরকারের আমলে মুদ্রা জালিয়াত চক্রের কয়েকজন পাকিস্তানি নাগরিক ধরা পড়ার পর এই মজুমদার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পায় ডিবি। ডিবি চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে বিপুল ভারতীয় জাল মুদ্রাসহ এ চক্রের একজন বড় নেতা আবদুল মান্নানকে এবং পরদিন এই চক্রের এ দেশীয় প্রধান সোলায়মান মজুমদারকে গ্রেপ্তার করে। মজুমদারের বাড়ি কুমিল্লা সদরের (দক্ষিণ) ধামাইতরী গ্রামে। ঢাকার কাপাসিয়ায় ১০০ বিঘা জমির ওপর তাঁর বাগানবাড়ি আছে।
কার্যকর জিজ্ঞাসাবাদ হয়নি: ডিবির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, গ্রেপ্তারের পর মজুমদারকে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। কিন্তু মজুমদার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদকারী কর্মকর্তাদের পর্যাপ্ত জানাশোনা না থাকায় রিমান্ডে তাঁর কাছ থেকে বেশি তথ্য বের করা যায়নি।
গ্রেপ্তারের পাঁচ সপ্তাহের মাথায় গত মার্চ মাসে মজুমদার ও তাঁর সহযোগী মান্নান জামিনে বেরিয়ে পালিয়ে যান। এরপর তাঁকে ধরার জন্য গোয়েন্দা পুলিশ মামলার হাজিরার দিন আদালতে ওত পেতে থেকেও তাঁকে পায়নি।
আমাদের আদালত প্রতিবেদক জানান, মামলার নথিপত্রে দেখা যায়, মজুমদার প্রতি মাসে মামলার হাজিরা দিতেন। সর্বশেষ গত ৪ জুলাইও তাঁর হাজিরা ছিল, এরপর ২৮ আগস্ট। তাঁর পক্ষে আইনজীবী সময় প্রার্থনা করেন।
ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার মাহাবুবর রহমান জানান, গত সপ্তাহে গ্রেপ্তার হওয়া মজুমদারের সহযোগী রফিকুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেছে, মজুমদার আদালতে না গিয়েই মামলার হাজিরা দিতেন। নিম্নপদস্থ কর্মীদের টাকা দিয়ে তিনি এ ব্যবস্থা করেন।
কর্মকর্তারা জানান, ইতিপূর্বে গ্রেপ্তার হওয়া পাকিস্তানের নাগরিক মোহাম্মদ দানিশ ও সাব্বির আলী, ভারতের রুবিনা হোসেন একই চক্রের সদস্য। এই চক্রের পাকিস্তানি সদস্যরা ওই দেশে জাল মুদ্রা বানিয়ে মজুমদারের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতে পাঠাত।
বিমানবন্দর থেকে সীমান্ত পর্যন্ত নেটওয়ার্ক: এই জালিয়াত চক্রের কাজের ধরন সম্পর্কে জানা যায়, দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকাসহ সব বড় শহর এবং সীমান্ত এলাকায় এসব চক্রের জোরালো নেটওয়ার্ক রয়েছে। বিমানবন্দরে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাজ হলো মুদ্রাগুলো নিরাপদে বিমানবন্দর থেকে শহরে নির্দিষ্টজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া। আর সেই ব্যক্তির কাজ হলো ভেতরের চাহিদা অনুযায়ী মুদ্রা রেখে, বাকি মুদ্রাগুলো সীমান্তে চালান করে দেওয়া।
ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার মাহাবুবুর রহমান জানান, ১৬ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হওয়া রফিক রিমান্ডে জানিয়েছেন, চক্রটি মূলত পাকিস্তানে জাল মুদ্রা ছাপিয়ে আকাশপথে বাংলাদেশ ও নেপালে নিয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে তারা বেশির ভাগই পাকিস্তানি বিমান সংস্থার কোনো কোনো বৈমানিক বা কর্মীকে ব্যবহার করে। তারা কখনো পাকিস্তান থেকে সরাসরি আবার কখনো দুবাই হয়ে ফ্লাইটে মুদ্রার চালান আনে। রফিক জানিয়েছেন, সম্প্রতি তাঁরা ২০ কার্টন জাল মুদ্রা এনেছেন আকাশপথে। একেকটি কার্টনে এক লাখ রুপি বা ডলার থাকে। রফিকের কাছ থেকে এমন এক কার্টনসহ মোট এক লাখ ১০ হাজার ভারতীয় রুপি উদ্ধার করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এ চক্রের চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে সবচেয়ে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। ঢাকা থেকে সীমান্ত হয়ে ভারত পর্যন্ত এসব মুদ্রা পাঠানোর কাজে মজুমদারের অধীন আরও ১০ জন বড় নেতা রয়েছে। তাদের বলা হয় পাইকার। এ রকম অন্তত ১০ জন পাইকারকে গোয়েন্দারা শনাক্ত করেছেন। এদের মধ্যে রফিক, মাহতাব, ফয়সাল, আমান অন্যতম। রফিক এখন রিমান্ডে। ফয়সাল ও আমান ইতিপূর্বে গ্রেপ্তার হলেও জামিন নিয়ে পালিয়ে গেছে।

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন