22 September 2010

৩৯ বছর পর মুক্তিযোদ্ধা হলেন আলশামস কমান্ডার সেলিম!

শফিক আদনান, কিশোরগঞ্জ

মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন আলশামস বাহিনীর কমান্ডার। তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষের ওপর চালানো হতো অত্যাচার-নির্যাতন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে আটকও করে। কিশোরগঞ্জের সেই আলশামস নেতা কাজী সেলিম খানকে ৩৯ বছর পর ২২ জুলাই মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত করা হয়। ২৫ জুলাই এ-সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয়। তাঁর মুক্তিযোদ্ধা নম্বর ৩৫৩০। বর্তমানে তিনি সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর এপিএসের দায়িত্ব পালন করছেন।

কিশোরগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় কাজী সেলিমদের বাসা ছিল স্বাধীনতাবিরোধীদের আস্তানা। তাঁদের বাসায় পাকিস্তানি বাহিনীর কুখ্যাত মেজর ইফতেখার ও ক্যাপ্টেন বুখারি নিয়মিত যাতায়াত করত। যুবতীদের তুলে নিয়ে সেই বাড়িতে আমোদ-ফুর্তি করত। কাজী সেলিম ও তাঁর ভাইয়েরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গাড়িতে করে শহরে টহল দিতেন।

কিশোরগঞ্জ তৎকালীন মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা সাবি্বর আহমেদ মানিক কালের কণ্ঠকে বলেন, কাজী সেলিম খান ও তাঁর ছোট ভাই কাজী শামীম খান মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা পালন করেছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্য ও কর্মকর্তারা সেলিমদের আখড়াবাজারের কাজীবাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করত।

সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান ও মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আগা হিলালী এক বিবৃতিতে বলেন, 'কাজী সেলিম খান আলশামস কমান্ডার ছিলেন।' তাঁরা অবিলম্বে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে তাঁর নাম বাদ দেওয়ার আহ্বান জানান।

কিশোরগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ইউনিট কমান্ডার মো. আসাদ উল্লাহ বলেন, 'কাজী সেলিম খান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন_ এমন তথ্য আমার জানা নেই।' তবে অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকায় আছে বলে তিনি স্বীকার করেন।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সহকারী কমান্ডার ছগির আহমেদ জানান, কাজী সেলিম ও তাঁর ভাইয়েরা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হানাদারদের গাড়িতে চড়ে কিশোরগঞ্জ শহরে টহল দিত। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর কাজী সেলিম ও তাঁর ছোট ভাই কাজী শামীমকে আটক করা হয়েছিল। পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় শহরে থেকে গোপনে মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজনৈতিক নেতাদের কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নানা তথ্য সরবরাহ করতেন ঊষা রানী দেবী। তিনি জানান, মেজর ইফতেখার ও ক্যাপ্টেন বুখারির গাড়িতে করে কাজী সেলিম খান ও কাজী শামীম খান শহরে ঘুরে বেড়াত। তাদের বাড়িতে বসেই তালিকা তৈরি করে লোকদের ধরে নিয়ে হত্যা করা হতো। এরাই পাকিস্তানি সেনাদের কাছে শহরের যুবতী মেয়েদের সন্ধান দিত।

ঊষা রানী বলেন, 'আজকে যদি কাজী সেলিমের মতো একজন স্বাধীনতাবিরোধীর নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ওঠে, তাহলে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম রাজাকার হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হোক। একই তালিকায় রাজাকার আর মুক্তিযোদ্ধার ঠাঁই হতে পারে না।'

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হতে হলে প্রথমে আবেদন করতে হয় মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলে। পরে এ আবেদন কমান্ড কাউন্সিল থেকে পাঠানো হয় মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো হয় জেলা প্রশাসকের কাছে। জেলা প্রশাসক পাঠান ইউএনওর কাছে। ইউএনও এটি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটির কাছে পাঠান। এখান থেকে আসে আবার ডিসির কাছে। জেলাতেও এ ধরনের একটি কমিটি আছে। ওই কমিটিতে জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে আবার তা চলে যায় কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলে। কাউন্সিল থেকে আবার মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে। পরে এটি গেজেটের জন্য পাঠানো হয় সরকারি ছাপাখানা বিজি প্রেসে।

কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক সিদ্দিকুর রহমান জানান, তিনি কয়েক মাস আগে এখানে যোগদান করেছেন। তাঁর সময়ে এ ধরনের কোনো প্রস্তাব পাঠানো হয়নি।

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূরে আলম সিদ্দিকী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না। আমার কার্যালয় থেকে এ ধরনের কোনো প্রস্তাব যায়নি।'

কিশোরগঞ্জ সদর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কমান্ডার অ্যাডভোকেট মতিউর রহমানও ওই ব্যক্তির ব্যাপারে কোনো প্রস্তাব পাঠাননি বলে জানান। জেলা কমান্ডার আসাদউল্লাহও একই কথা বলেন।

কিশোরগঞ্জ শহরের আখড়াবাজার এলাকার বাসিন্দা কাজী সেলিম খান। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গত ২২ জুলাইয়ের একটি প্রজ্ঞাপন ২৫ জুলাই গেজেটভুক্ত হয়। গেজেটে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কিশোরগঞ্জের তিন ব্যক্তির নাম তালিকাভুক্ত করা হয়। সরকারি গেজেটভুক্ত অন্য দুইজন হলেন_বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব শফিক আলম মেহেদী এবং কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার বিন্নাটি গ্রামের কাস্টমস কর্মকর্তা আবু হায়দার মো. লুৎফর রহমান। এ গেজেট প্রকাশ হওয়ার পর এলাকাবাসী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দেয়।

সরকারি গেজেটে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় বিতর্কিত ভূমিকার বিষয়ে জানতে চাইলে কাজী সেলিম খান বলেন, 'মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দ্বিতীয় তালিকায় আমার নাম ছিল। পরে ভুলবশত অন্যান্য তালিকা ও সরকারি গেজেটে নাম ওঠেনি।' তিনি আলশামস বাহিনীর সঙ্গে জড়িত ছিলেন না বলে দাবি করে বলেন, 'মন্ত্রী মহোদয়ের কাছ থেকে অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিতে না পেরে একটি মহল আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।'

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন