শরীফা বুলবুল
'আমার বাবার খুনি সাকা চৌধুরী স্বাধীন বাংলাদেশে এখনো বীরদর্পে ঘুরছেন! এটা অন্যায়। এটা আমার পরিবারের জন্য বড় আঘাত। এর চেয়ে বেদনার ব্যাপার আমার জন্য আর কী হতে পারে! যে পতাকার জন্য লাখ লাখ বাঙালি জীবন দিয়েছে, সেই পতাকা গাড়িতে উড়িয়ে সাকা যখন ঘুরে বেরিয়েছেন, তখন বাবার মৃত্যুটা আমার কাছে আরো বেশি কষ্টদায়ক হয়ে উঠেছিল। আমি আমার বাবার হত্যাকারী সাকার বিচার চাই। আমি এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করছি।' পিতৃহত্যার বিচার চাইতে গিয়ে দানবীর নূতন চন্দ্র সিংহের সেজো ছেলে প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ (৭০) ব্যথিত স্বরে কালের কণ্ঠকে এভাবেই তাঁর ক্ষোভের কথা জানালেন।
তিনি জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নূতন চন্দ্র সিংহের পরিবার ভারত থেকে দেশে ফিরে আসে। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁর পুত্র সত্য রঞ্জন সিংহ পিতার হত্যার বিচার দাবি করে ফকা (ফজলুল কাদের) চৌধুরী ও তাঁর ছেলে সাকা (সালাহউদ্দিন কাদের) চৌধুরীকে প্রধান আসামি করে দশজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন [মামলা নম্বর ৪১ (তারিখ ২৯-১) ৭২, ধারা ৩০২/১২০/১৯৮ বিপিসি]। এ মামলার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন (১৩-৩৬৫/৭৩) করা হয় এবং চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের স্মারক ৮/জেএস তারিখ ২-১-৭৪ মূলে নথিটি হাইকোর্টে প্রেরণ করা হলে তা আর ফেরত আসেনি। এর কপি আদালত থেকে শুরু করে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাসহ উচ্চ পর্যায়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর সেসব গায়েব হয়ে গেছে। এ বিষয়ে রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিখিল মণ্ডল কালের কণ্ঠকে বলেন, '১৯৭২ সালে এ মামলার চার্জশিট হয়েছিল, যার নম্বর-৬৪/৭৪। ১৯৭২ সালেই তা কোর্টে চলে যায়। কিন্তু সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী রিভিশন করে এটাসহ আরো পাঁচটি মামলা হাইকোর্টে নিয়ে যান। এরপর ওই মামলার আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। হাইকোর্টে আছে কি না তাও জানি না।'
প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহের বর্ণনা থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ আর মলি্লক, ড. আনিসুজ্জামান, ড. জাকির উদ্দিন, সৈয়দ আলী আহসান, ড. শামসুল হক, ড. আলী ইমদাদ খান ও তাঁদের ৩২টি পরিবারের প্রায় ৪৭ জন সদস্য নিয়ে নূতন চন্দ্র সিংহের কুণ্ডেশ্বরী ভবনে আশ্রয় নেন। তাঁরা সেখানে তিন দিন ছিলেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হাটহাজারী থেকে রাউজানের দিকে অভিযান শুরু করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও তাঁদের পরিবার ভারতীয় সীমান্তের উদ্দেশে কুণ্ডেশ্বরী ভবন ত্যাগের প্রস্তুতি নেয়। এ সময় তাঁরা নূতন চন্দ্র সিংহকে তাঁদের সঙ্গে যাওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি তাঁর প্রিয় প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করে যেতে অস্বীকৃতি জানান। একাত্তরের ১৩ এপ্রিল চারটি আর্মড ট্রাক ও দুটি জিপে করে একদল পাকিস্তানি সৈন্যকে পথ দেখিয়ে কুণ্ডেশ্বরী ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। নূতন চন্দ্র সিংহ তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে অমায়িক ব্যবহার করে পাক সেনাদলকে অভ্যর্থনা জানান। তাঁদের কাছে তিনি কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়, স্কুল, কলেজের বিস্তারিত বিবরণ দেন। নূতন চন্দ্র সিংহের কথায় সন্তুষ্ট হয়ে পাকিস্তানি বালুচ ক্যাপ্টেন তাঁর সঙ্গী সেনাদলকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। নূতন চন্দ্র সিংহ মন্দিরে প্রার্থনা করতে যান। ওই সময় বালুচ ক্যাপ্টেনকে নাকি সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেছিলেন, 'আমার বাবার নির্দেশ আছে নূতন চন্দ্র সিংহকে মেরে ফেলার।' ক্যাপ্টেন দ্বিধায় পড়ে যান, ইতস্তত করতে থাকেন। একপর্যায়ে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী মন্দিরে প্রবেশ করে প্রার্থনারত বৃদ্ধ নূতন চন্দ্র সিংহকে টেনেহিঁচড়ে বের করে আনেন। এরপর ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন পাকিস্তানি সেনাদের সামনে। উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে থাকা নূতন চন্দ্র সিংহকে পাক সেনাদের গুলি করতে বিলম্ব দেখে নিজের পিস্তল থেকে সাকা তাঁর বুকে, পাঁজরে, বাম চোখের নিচে ও বাহুতে উপর্যুপরি গুলি করেন। নিজের প্রতিষ্ঠানের চত্বরেই মৃত্যু ঘটে দানবীর নূতন চন্দ্র সিংহের।
প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ বলেন, 'বাবার মৃত্যুসংবাদ শুনে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। কারণ ফজলুল কাদের চৌধুরী ছিলেন বাবার বন্ধু। সত্তরের নির্বাচনের আগের রাতে তিনি বাবার কাছে তিনবার এসেছিলেন। প্রতিবারই বাবার সঙ্গে আমি ছিলাম। চৌধুরী সাহেব বাবাকে বলেছিলেন, 'নূতন বাবু ছেলেরা বোধহয় আমাকে হারিয়ে দেবে। অবস্থা সুবিধার নয়।' বাবা প্রত্যেকবারই বলেছিলেন, 'ছেলেদের কথা জানি না, তবে আমার এবং আমার স্ত্রীর ভোট আপনি পাবেনই। আপনি এত অধৈর্য হচ্ছেন কেন? ভোটে হারলেই বা কী? তাতে কি আপনার জমিদারি যাবে? একবার হারবেন আর একবার জিতবেন।' চৌধুরী সাহেব জবাবে বলেছিলেন, 'নূতন বাবু, আপনি সহজ-সরল মানুষ, রাজনীতি সম্পর্কে কিছুই বোঝেন না। তাই কথাটা এত সহজে বলতে পারলেন।' এটাই ছিল বাবা ও আমার সঙ্গে ফজলুল কাদের চৌধুরীর শেষ দেখা। আমার বয়স তখন ৩১ বছর। নির্বাচনে তাঁর বিরোধিতা করেছি বলে টার্গেট ছিলাম আমি এবং আমার মেজদা (সত্য সিংহ)। আমাদের না পেয়ে তাঁরা বাবাকে শেষ করে দিল।'
প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ আরো বলেন, 'পাকিস্তানি আর্মি দুবার এসে আমার বাবাকে না মেরে ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু সাকা ওদের বলেছিল, 'আমার বাবার আদেশ আছে।' ফকা যখন সাকার কাছে জানতে চাইলেন, কাকে মেরেছিস, সাকা বলেছিলেন, 'নূতন বাবুকে'। তখন ফকা হায় হায় করে উঠে বলেছিলেন, তুই এ কী করলি! আমি তো বলেছিলাম, ছেলেদেরকে মারতে...!'
এ হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'একাত্তরে আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেকে কুণ্ডেশ্বরীতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমি এক রাত ছিলাম। আমার স্ত্রী দুই রাত ছিলেন। সেখানে থাকা নিরাপদ নয় ভেবে আমরা গ্রামের দিকে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু নূতন বাবু যাননি। তাঁকে বলেছিলাম, এখানে একা থাকা কারো পক্ষেই নিরাপদ নয়। তিনি বলেছিলেন, আমি কুণ্ডেশ্বরী মাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। এমন দেশপ্রেমিক মানুষ ছিলেন তিনি। পরে তাঁর ছেলের কাছে শুনলাম, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী তাঁকে হত্যা করেছে। শুনে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। ওরা এমন একজন অসাধারণ দানবীরকে অমানবিকভাবে হত্যা করেছে! এটা ক্ষমাহীন অপরাধ। তাঁর হত্যাকারীদের বিচার হওয়া উচিত। সেই সঙ্গে একাত্তরে যারা আমার প্রিয় শিক্ষকদের হত্যা করেছে, তাদেরও বিচার চাই। ওই সব হত্যাকাণ্ডের বীভৎসতা ভুলতে পারি না। স্বাধীনতা লাভের সময় থেকে যুদ্ধাপরীদের বিচার হবে এই আশা করে আসছি। এত দিনে মনে হচ্ছে, আমাদের সে আশা পূরণ হবে। দেরিতে হলেও হচ্ছে এটাই আশার কথা।'
একাত্তরে কুণ্ডেশ্বরীতে আশ্রয় নিয়েছিলেন আরেক অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান। নূতন বাবু প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'খুবই সাধারণ এবং দরদি মানুষ ছিলেন তিনি। এক ধরনের ধ্যানমগ্ন থাকতেন। আমরা যখন নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গিয়েছিলাম, তখন তিনি থেকে গিয়েছিলেন। পরে শুনেছি সেই মানুষটিকে মেরে ফেলা হয়েছে। তাঁর হত্যার সঙ্গে জড়িত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বা যে-ই হোন, তাঁর বিচার হওয়া উচিত। মানুষটি নারীশিক্ষার জন্য কত কিছু করেছেন। মেয়েদের প্রতি ছিল তাঁর বেশ সফট কর্নার। তিনি বলতেন, সমাজকে এগিয়ে নিতে হলে মায়ের আশীর্বাদ যেমন দরকার, তেমনি মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলা দরকার।'
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন