22 September 2010

যুবকের এক প্রতিষ্ঠানের কাছেই এক লাখ ৯০ হাজার গ্রাহকের পাওনা ১৭৫০ কোটি টাকা: অর্থের হিসাব মেলাতেই শেষ কমিশনের মেয়াদ

মনজুর আহমেদ | তারিখ: ২৩-০৯-২০১০

যুবকের লাখ লাখ গ্রাহক ও তাঁদের জমা করা অর্থের হিসাব করতেই সরকার গঠিত কমিশনের প্রথম দফার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এক দফা মেয়াদ বাড়ানো হলেও তারও এক মাস চলে গেছে হিসাব মেলাতেই। এখনো হিসাব করছে কমিশন।

সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, যুবকের একটি প্রতিষ্ঠান হাউজিং অ্যান্ড রিয়েল এস্টেট ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের এক লাখ ৯০ হাজার গ্রাহকের প্রায় এক হাজার ৭৫০ কোটি টাকা জমা রাখার দাবিসংক্রান্ত তথ্য তালিকাভুক্ত করতে পেরেছে কমিশন। বহুমাত্রিক প্রতারণার মাধ্যমে নানা ধরনের ফন্দিফিকির তৈরি করে জনগণের কাছ থেকে অর্থ তুলে নিয়েছিল আলোচিত এই যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি বা যুবক এবং এর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো।

বিগত বিএনপি সরকারের সময় অবৈধ ব্যাংকিং কর্মকাণ্ডের অভিযোগে যুবকের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। সে সময় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একটি গোয়েন্দা সংস্থা নানাভাবে চেষ্টা-তদবির করেও প্রতারিত জনগণের অর্থ ফেরত দিতে পারেনি। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুবকের গ্রাহকের জমা করা অর্থ পরিশোধ ও হয়রানি বন্ধ, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি হস্তান্তরে স্থাগিতাদেশ ও প্রশাসক নিয়োগ করে স্থায়ী সমাধানের ক্ষেত্রে তদন্ত করার জন্য একটি কমিশন গঠন করে ২৬ জানুয়ারি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে এই কমিশনের সভাপতি করা হয়।

কমিশন শুরুতেই গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে যুবকের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জমা করা অর্থের তথ্য দেওয়ার আহ্বান জানায়। লিখিত তথ্য জমা হওয়ার পর দেখা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকে অবস্থিত কমিশনের দপ্তরে কাগজের বিরাট পাহাড় জমে গেছে। লাখ লাখ গ্রাহক ও তাঁদের জমা করা অর্থের হিসাব করতেই কমিশনের মেয়াদ ১২০ দিন অতিক্রান্ত হয়ে যায়। মেয়াদ নতুন করে আরও ছয় মাস বাড়ানো হয়েছে। তবে নতুন মেয়াদের এক মাস প্রায় শেষ হলেও এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ডজনের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসাব তৈরির কাজ শেষ করতে পারছেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদের সময় যুবকের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। গতকাল বুধবার সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত জানিয়ে মতামত চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের যেসব সংস্থা এজাতীয় প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন দেয়, তাদের এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে, যাতে জনগণকে প্রতারিত না হতে হয়।’ তিনি একই সঙ্গে জনগণকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘অনুমোদিত তফসিলি ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক, নিবন্ধিত এনজিও ছাড়া কারও কাছে জনগণের টাকা খাটানো বা জমা রাখা উচিত নয়।’

এদিকে কমিশনের দেওয়া বিভিন্ন নির্দেশ যুবক কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন করছে না বলেও জানা গেছে। আবার কমিশন গত ১৯ মে অর্থ মন্ত্রণালয়কে এক চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছে, যুবক ও যুবকসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে কোনো স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তর করতে না পারে, সে জন্য আদালতের মাধ্যমে স্থগিতাদেশ পেতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপের কথা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়নি। বরং যুবক কর্তৃপক্ষ এটি বন্ধ করতে মন্ত্রণালয়ে চেষ্টা করছে।

এর আগে কমিশন নিজেই গত ৬ ও ১২ মে দুটি সংবাদপত্রে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে যুবক ও যুবকসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কেউ যাতে কোনো লেনদেন না করে, সম্পত্তি ক্রয় বা হস্তান্তর বা স্থানান্তর-সম্পর্কিত চুক্তি না করে, সে বিষয়ে জনগণকে সতর্ক করে। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরও সম্পদ বিক্রি বা হস্তান্তরের সংবাদ পেয়েই কমিশন অর্থ মন্ত্রণালয়কে এ-সংক্রান্ত চিঠি দেয়।
সূত্র জানায়, কমিশন গত ৪ মে যুবকের মালিকপক্ষকে ৩০ মে তদন্ত কমিশনের সামনে উপস্থিত থাকতে নোটিশ দেয়। একই সঙ্গে যুবক ও যুবকসংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের শাখা বা অফিসের ঠিকানাসহ তালিকা, শাখাভিত্তিক গ্রাহকের জমা নেওয়া অর্থের পরিমাণ (প্রত্যেক গ্রাহকের নাম, ঠিকানা ও জমা করা অর্থের পরিমাণ পৃথকভাবে) উল্লেখ করা, যুবক ও যুবকসংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির বিবরণ ও সংযুক্ত ছকে বর্ণিত তথ্যাদির সমর্থনে হলফনামা আনতে বলা হয়। প্রথম দফায় না এলেও দ্বিতীয় দফায় যুবক তাদের প্রতিনিধি পাঠায়।
যুবকের একটি সূত্র জানায়, গ্রাহকের অর্থ পরিশোধে উৎসাহ জোগাতে কমিশনের সভাপতি তাঁদের মালিকপক্ষের সঙ্গে একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠকও করেন। সেখানে তাঁদের পরামর্শ দেওয়া হয়, ফেনী ও বাগেরহাটের নয় হাজার গ্রাহকের তালিকা তৈরি হয়েছে। তাঁদের অর্থ পরিশোধ করে দেওয়া হোক। এর জন্য কমিশন সচিবালয় যেসব তথ্য পেয়েছে, তা নমুনা হিসেবে যুবককে দেওয়া হয়। কিন্তু কয়েক মাস হলেও নানা অজুহাতে অর্থ পরিশোধ করেনি যুবক।

জানা গেছে, এই দুটি জেলার গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেওয়া সম্পর্কে যুবক কমিশনকে ১৪ আগস্ট একটি চিঠি দেয়। এতে বলা হয়েছে, জেলার অফিসগুলো খোলার বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর জন্য বকেয়া ভাড়া পরিশোধ ও কর্মকর্তাদের খুঁজে বের করা দরকার। সংগঠক ও সংগ্রাহক কোড ও সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ের নাম ছাড়া তথ্য যাচাই করা সম্ভব নয়। চূড়ান্ত পর্যায়ে চুক্তির মূল কপি প্রয়োজন হবে। তারা বলেছে, কী আছে এবং কী নেই, তা অফিস খোলার পরই বলা সম্ভব। অফিস না খুলে এর কিছুই যাচাই করা সম্ভব নয়।

জানা গেছে, যুবক কমিশনের কাছে তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা দিয়েছে। তালিকায় যুবক বলেছে, দেশের একটি বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলের ৫৭ ভাগ মালিকানা রয়েছে তাদের। কিন্তু কমসংখ্যক শেয়ারধারকেরা অবৈধভাবে এই চ্যানেলটি ভোগদখল করে চালাচ্ছে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তা ছিল এ ক্ষেত্রে।

উল্লেখ্য, ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৬ সালের ২৪ মে অবৈধ ব্যাংকিং কর্মকাণ্ড পরিচালনার দায়ে যুবককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে যুবকের জবাব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় যুবকের সব ধরনের আমানত নেওয়া, ঋণ বিতরণ ইত্যাদি কর্মকাণ্ড বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি সাধারণ জনগণের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ সুদ ও লভ্যাংশসহ ফেরত দিতে ২০০৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০০৭ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত যুবক জনগণের অর্থ ফেরত দেয়নি।

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন