নূপুর দেব ও জাহেদুল আলম, রাউজান ঘুরে এসে
'একাত্তর সালে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জড়িত থাকার অনেক অভিযোগ পাওয়া গেছে। আরো অভিযোগ আসছে। সব অভিযোগ সমন্বয় করে কাল (শনিবার) দুপুর ১২টায় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সংবাদ সম্মেলন করে তুলে ধরা হবে।' একাত্তরের মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তদলের অন্যতম সদস্য অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে এ কথা বলেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তদল চট্টগ্রামের রাউজানে গিয়ে গতকাল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু করেছে। গতকাল সকাল ১০টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত তিন দফায় মোট ১৭ জনের সাক্ষ্য নেন এই দলের সদস্যরা। এ সময় সংবাদকর্মী বা অন্য কাউকে সেখানে উপস্থিত থাকতে দেওয়া হয়নি। হত্যাকাণ্ড, নির্যাতনসহ বিভিন্ন অপরাধের বিষয়ে তদন্ত কমিটির কাছে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহতের স্বজন, নির্যাতনের শিকার পরিবারের সদস্য ও প্রত্যক্ষদর্শীরা।
সাক্ষ্য দান শেষে ৭০ বছর বয়সী প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমার বাবা নূতন চন্দ্র সিংহকে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহ আল হারুন ও বর্তমানের বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলেছিলেন। রাজাকাররা যেকোনো ক্ষতি করতে পারে_এই আশঙ্কা থেকেই তাঁরা এই পরামর্শ দিয়েছিলেন। সে সময় আমাদের বাড়িতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্যসহ ২৭ জন শিক্ষক আশ্রয় নিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সকাল ১০টায় আমার বাবাকে যখন পাকিস্তানি আর্মিরা টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে আসে, তখন তিনি মন্দিরে প্রার্থনা করছিলেন। মন্দিরের সামনেই তাঁকে ব্রাশফায়ার করা হয়। এরপর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বন্দুক দিয়ে গুলি করে বাবার মৃত্যু নিশ্চিত করে। আমি আমার বাবা হত্যার বিচার চাই।'
তদন্তদল আজ শনিবার সংবাদ সম্মেলনের আগে চট্টগ্রাম মহানগরীর গনি বেকারি এলাকায় অবস্থিত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাসভবন গুডস হিলসহ বধ্যভূমি পরিদর্শন করবে। গতকাল তদন্তদল রাউজানের কুণ্ডেশ্বরী নূতন সিংহের বাড়ি, জগৎ মল্লপাড়া ও ঊনসত্তরপাড়ার লোকজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে।
এদিকে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তদন্তদলের কাছে সাক্ষ্য না দিতে তাঁর অনুসারীরা এলাকাবাসীকে হুমকি দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। হুমকি দিয়ে বলা হয়, এর পরিণতি ভয়াবহ হবে। হুমকির বিষয়টিও তদন্ত কমিটির কাছে তুলে ধরেন সাক্ষ্যদাতারা। গতকাল সকালে মোটরসাইকেল নিয়ে বেশ কিছু যুবক সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জগৎ মল্লপাড়ায় গিয়ে মহড়া ও হুমকি দেয়। বৃহস্পতিবার রাতেও তারা একইভাবে হুমকি দেয় বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক এলাকাবাসী জানিয়েছে। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল বিকেলে একসঙ্গে এখানে ৩৫ জনকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়।
পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের উপস্থিতিতে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে রাউজানের তিনটি এলাকায় তদন্তদল সাক্ষ্য গ্রহণ করে।
তদন্তদলের নেতৃত্ব দেন অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু। এ ছাড়া ছিলেন অ্যাডভোকেট জিয়াদ আল মালুম, মোখলেছুর রহমান, রানা দাশগুপ্ত, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মতিউর রহমান, সহকারী পুলিশ সুপার নুরুল ইসলাম, দুই পরিদর্শক আবদুর রাজ্জাক ও ইদ্রিস আলী।
দানবীর, সমাজসেবক ও শ্রী কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্র সিংহের বাড়িতে এক ঘণ্টা সাক্ষ্য গ্রহণের পর তদন্তদল যায় পাশের জগৎ মল্লপাড়ায়। যুদ্ধাহত জ্যোৎস্না বালা চৌধুরীসহ পাঁচজন এ সময় নির্যাতনের কাহিনী তুলে ধরেন। পরে জ্যোৎস্না বালা চৌধুরী বলেন, 'আমার স্বামী কিরণ চন্দ্র চৌধুরী, দেবর, সন্তানসহ সাতজনকে শান্তি কমিটির সভা আছে বলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে যায় স্থানীয় রাজাকাররা। ওই দিনই তাদেরসহ মোট ৩৫ জনকে হত্যা করা হয়।' আরেক প্রত্যক্ষদর্শী বাদল কৃষ্ণ চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, তাঁর শ্বশুর মধুসূদনকে একই দিন ঘর থেকে ঢেকে নিয়ে হত্যা করা হয়।
দুপুর ১টার দিকে ঊনসত্তরপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এখানে ১১ জন তদন্ত কমিটির কাছে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এঁদের মধ্যে ৯ জন বিধবা নারী ও দুজন পুরুষ। স্কুলে গিয়ে দেখা গেছে, মুষলধারে বৃষ্টি উপেক্ষা করে সিএনজি চালিত অটোরিকশায় চড়ে এসব সাক্ষী সাক্ষ্য দিতে হাজির হন। সাগর বালা, প্রভা বালা, শান্তি পাল, উর্মিলা পাল, বাসন্তি ঘোষ, বীরেন্দ্র বড়ুয়া ও মিনতি মহাজন তদন্ত কর্মকর্তার কাছে বিস্তারিত বর্ণনা দেন। স্কুলের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে তদন্তদল হেঁটে পাশের সতীশ মহাজনের বাড়ির বধ্যভূমি দেখতে যায়। এ সময় তদন্তদলকে নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে পাহাড়তলী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা মোহাম্মদ ইব্রাহীম আঙুল দেখিয়ে বলেন, পুকুরের পাশে একটি ছোট খাল ছিল। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সন্ধ্যায় ৭০ জন নারী-পুরুষকে ঘর থেকে ঢেকে এনে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। তাদের সবাই ছিল সনাতন ধর্মাবলম্বী। হত্যার পর সৎকার না করে মাটিচাপা দেওয়া হয়। সাকা চৌধুরীর নেতৃত্বে এই গণহত্যা হয়েছে। এর আগে ইব্রাহীম তদন্ত কমিটির কাছে সাক্ষ্য দেন।
হত্যাকাণ্ডের রোমহর্ষক এই কাহিনী শোনার পর তদন্তদলের সদস্যরা উপস্থিত এলাকাবাসীর কাছে জানতে চান, তারা এই গণহত্যার বিচার চান কি না। সমস্বরে সবাই জবাব দেন, 'আমরা অবশ্যই বিচার চাই।' তারপর বধ্যভূমির সামনে সবাই দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন।
ঊনসত্তরপাড়ায় গণহত্যায় নিহতদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধের সামনে দাঁড়িয়ে তদন্তদলের সদস্যরা স্থানীয় এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলেন। তখন পূর্ব গুজরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্বাস উদ্দিন বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি এলাকায় অবস্থান করছিলাম। ১২ এপ্রিল দুপুরে চট্টগ্রাম থেকে পাহাড়তলী হয়ে রাউজান যাওয়ার পথে জগন্নাথবাড়ির বটগাছের সামনে ফজলুল কাদের চৌধুরী, তাঁর ছেলে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীর গাড়ি আটকে রাখে এলাকাবাসী। গাড়ি থেকে নামিয়ে তাঁদের জুতা নিক্ষেপ করে এলাকাবাসী। পরদিন ঊনসত্তরপাড়ায় সতীশ মহাজনের বাড়িতে স্থানীয় রাজাকার রাজ্জাক, পেয়ারু, ইউসুফ, মুকতুল হোসেন, ইসমাইলসহ বেশ কয়েকজন ওই এলাকার ৭০ জন নিরীহ নারী-পুরুষকে হত্যা করে। এদের মধ্যে ৫১ জনের নাম পাওয়া গেছে।
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন