24 September 2010

চৌধুরীর ছেলে আমাকে মারধর করেছিল : সাংবাদিক নিজাম

এস এম আজাদ

১৯৭১ সালে সাকা পরিবারের হাতে নির্যাতিতদের একজন আজকের সিনিয়র সাংবাদিক নিজামউদ্দিন আহমেদ। আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সে কর্মরত নিজামের ধারণা, তিনিই হয়তো এখন একমাত্র জীবিত ব্যক্তি যাঁকে নিজ হাতে অত্যাচার করেছিলেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী। চট্টগ্রাম নগরীর একটি পোড়া বাড়ি থেকে তাঁদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে। গতকাল শুক্রবার কালের কণ্ঠকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাংবাদিক নিজাম স্মৃতি হাতড়ে জানান সেই দুঃসহ নির্যাতনের কথা।

৫ জুলাই ১৯৭১। চট্টগ্রাম শহরের হাজী লেনের একটি আধপোড়া বাড়ি। সেখানে এক সহযোগীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিন তরুণ। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। হঠাৎ 'হ্যান্ডসআপ' শব্দ শুনে লাফিয়ে ওঠেন তাঁরা। সাদা পোশাকধারী কয়েকজন ও দুজন পাকিস্তানি সৈন্য তাঁদের আটক করে নিয়ে যায় গুডস হিলে। পাহাড়ের ওপর অবস্থিত ওই বাড়ির মালিক তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধের সময় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাড়িটি স্থানীয় লোকজনের কাছে 'টর্চার সেল' হিসেবেই পরিচিত ছিল। বাড়িটিতে তিন তরুণকে উপস্থিত করার পর সেখানে চেয়ার ছেড়ে উঠে টুপি-পরা এক লোক বলেন, "শালা, তোরা মুক্তিযোদ্ধা হইছিস? তোরা 'জয় বাংলা' 'জয় বাংলা' বলছিস। আর হিন্দুরা ধুতি নাড়ছে...।" ওই লোক তেড়ে গিয়ে তরুণদের একজনকে কিল-ঘুষি মারতে থাকেন। এভাবে টানা ৯ দিন আটকে রেখে নির্যাতন আর পাঁচ মাস কারাগারে আটকে রাখা হয় তাঁদের। এ তিনজনেরই একজন নিজামউদ্দিন আহমেদ। টুপি-পরা লোকটি তাঁকেই মারধর করেছিলেন। নিজাম তখন চট্টগ্রাম কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র।

নিজাম উদ্দিন জানান, ১৯৭১ সালে তিনি তাঁর বাবা জহিরউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে চট্টগ্রামের চকবাজার এলাকায় থাকতেন। তাঁর বাবা ছিলেন মুসলিম হাই স্কুলের শিক্ষক। তাঁদের গ্রামের বাড়ি লোহাগাড়া থানার আদুনগর গ্রামে। ওই এলাকায় সিদ্দিক নামের এক তরুণ গিয়ে সহায়তা চান নিজামউদ্দিনের কাছে। তাঁরা জানতে পারেন সিদ্দিকের বাড়ি ঢাকায়। তিনি ভারতে গিয়ে 'হিট অ্যান্ড রান' প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন। প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে চান সিদ্দিক।

সিদ্দিকের সঙ্গে একজোট হন নিজামউদ্দিন, নন্দনকানন এলাকার সিরাজ উদ্দিন ও সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম ওরফে জুলু পাগলা। তাঁরা হাজী লেনের একটি পোড়া বাড়িতে আড্ডা দিতেন। রেকি করতেন। ৫ জুলাই দুপুর থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না সিদ্দিককে। সন্ধ্যায় রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনীর লোকজন বাড়িটি ঘেরাও করে ধরে নিয়ে যায় অন্য তিনজনকে। ওই বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে নিজামউদ্দিনদের কাছে থাকা দুটি গ্রেনেড ও একটি রাইফেল নিয়ে যায় হানাদার বাহিনীর দোসররা।

নিজামউদ্দিন বলেন, "ঘটনার সময় অন্যদের সম্বোধনে জানতে পারি, আমাদের ধরে নেওয়ার দলে ছিলেন একজন 'চৌধুরীর পোয়া'। আমি তখন তরুণ ছাত্র। কাউকে ভালোমতো চিনতাম না। তবে বুঝছি ওই 'চৌধুরীর পোয়া' ছিলেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বা তাঁর ভাই গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ, তখন তিনি বেশি অ্যাকটিভ ছিলেন। টর্চার সেল গুডস হিলে এ 'চৌধুরীর পোয়া' আমাকে মারধরও করেছেন।"

নিজামউদ্দিন বলেন, 'ফজলুল কাদের চৌধুরী আমাকে মারধর করে অন্যদের হাতে তুলে দেন। এরপর আমাকে আলাদা করে অন্য একটি ঘরে নিয়ে রাত ১২টা পর্যন্ত নির্যাতন চালানো হয়। পেছন দিকে হাত দুটো বেঁধে পেটানো হয় আমাকে। পালাবদল করে চলে এ মারধর। রাত ১২টার দিকে ঘরের সামনের গ্যারেজে নিয়ে তিনজনকেই আধবসা অবস্থায় বেঁধে রাখা হয়। এভাবেই ছিলাম সারা রাত, পরের দিন।'

নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে নিজামউদ্দিন আরো বলেন, পরের দিন ৬ তারিখ সন্ধ্যা ৬টার দিকে সাদা পোশাকে পাকিস্তানি বাহিনীর ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (এফআইইউ) কয়েকজন তাঁদের গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামের খেলোয়াড়দের ড্রেসিং রুমে। সেখানে নেওয়ার পর থেকে শারীরিক নির্যাতন চালানো হয় তাঁদের ওপর। ওই ক্যাম্পে ১৩ জুলাই পর্যন্ত রাখা হয় তাঁদের। সেখানে প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর পাহারা বদল হতো। দায়িত্ব শুরু করার সময় সেন্ট্রি মারধর করে তার কাজ শুরু করত। তাঁদের এক সহযোদ্ধা সিদ্দিকের পরিণতি সম্পর্কে নিজামউদ্দিন স্মৃতি হাতড়ে বলেন, 'পরে জানতে পারি, এক প্রতারকের ফাঁদে পড়ে সিদ্দিক। ওই প্রতারকের নাম ইউসুফ। সে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে রাজাকারদের চর হিসেবে কাজ শুরু করে। সে সিদ্দিককে বোঝায়, শান্তি কমিটির কাছ থেকে সার্টিফিকেট নিলে তাঁর কোনো সমস্যা থাকবে না। ৫ জুলাই সিদ্দিক ইউসুফের সঙ্গে গুডস হিলে গিয়ে আটক হন। তাঁকে টর্চার করে আমাদের সম্পর্কে তথ্য পায় তাঁরা। ওই তথ্যের ভিত্তিতেই চৌধুরীর পোয়ার নেতৃত্বে পোড়া বাড়িতে অভিযান চালানো হয়।'

নিজামউদ্দিন বলেন, '১৩ জুলাই রাতে ট্রাকে করে তিনজনকেই চট্টগ্রাম কারাগারের গেটে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জুলু পাগলাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সিরাজকে আলাদা কক্ষে পাঠানো হয়। আমাকে রাখা হয় ফাঁসির আসামির সেলে। অন্ধকার কক্ষ। টয়লেটের ব্যবস্থাও ছিল না। দুর্বিষহ কষ্টে কাটে পাঁচটি মাস।' ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে কারাগার থেকে ছাড়া পান নিজাম ও সিরাজ।
এক প্রশ্নের জবাবে নিজামউদ্দিন বলেন, 'আমার ওপর অত্যাচারের বিচার আমি চাই। এত দিন বিচার চাওয়ার মতো পরিবেশ ছিল না। শত বছর পরেও তাদের বিচার সম্ভব।'
ক্ষোভ প্রকাশ করে নিজামউদ্দিন বলেন, 'আমার ওপর নির্যাতনের কথা একসময় আমি বলা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কারণ, এসব কথা শুনলে ওই সময়ের দালালের বাচ্চারা মজা পায়। এতে লাভ হয় না। তবে বিচারের স্বার্থে এখন কথা বলতে চাই। তখন রাজাকারদের হাতে কত মানুষ মারা গেছেন, কত মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট হয়েছে। এ তুলনায় আমার বিচারের দাবি কিছুই নয়। আমি সব অপরাধেরই বিচার চাই।'

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন