24 September 2010

রাজধানীর সিলগালা বাড়িতে শিবিরের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প: বোমার সরঞ্জাম ছাড়াও র‌্যাব-পুলিশের পোশাক উদ্ধার

রেজোয়ান বিশ্বাস

রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের ২৬৬ নম্বর বাড়ি। পরিচিত-অপরিচিত লোকের নিয়মিত যাতায়াত। রাতের আঁধারে গোপন বৈঠক। স্থানীয় লোকজনের বিস্তর অভিযোগ। এ নিয়ে চলে পুলিশের একাধিক অভিযান। একপর্যায়ে পুলিশ সিলগালা করে দেয় বাড়িটি। তার পরও গোপনে চলতে থাকে তৎপরতা। সিলগালা খুলে চালু করা হয় জঙ্গি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প।

পুলিশ গতকাল শুক্রবার ভোরে তৃতীয় দফা অভিযান চালায় বাড়িটিতে। উদ্ধার করা হয় সরকারবিরোধী প্রচারপত্র, জঙ্গিসংক্রান্ত বিপুল জিহাদি বই ও খেলনা অস্ত্র। আরো পাওয়া যায় র‌্যাব, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের পোশাক। আটক করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী বাড়ির দুই তত্ত্বাবধায়ককে। বাড়িটির মালিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের জামায়াতপন্থী শিক্ষক অধ্যাপক ড. আমিনুর রহমান মজুমদার। তাঁকে গতকাল থানায় ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। আবারও তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

পুলিশ জানায়, রাজধানীর অতি ব্যস্ততম এলিফ্যান্ট রোডের ওই বাড়িটি ছাত্রশিবিরের গোপন আস্তানা হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। আড়াই মাস আগে দুবার বাড়িটিতে অভিযান চালিয়ে সরকারবিরোধী বিভিন্ন কাগজপত্র পাওয়া যায়। এরপর সেটি কিছুদিন সিলগালা করে রাখা হয়। সেই থেকে বাড়িটি একপ্রকার পরিত্যক্ত অবস্থায়ই ছিল। গতকাল তৃতীয় দফা সেখানে অভিযান চালিয়ে বিপুল জঙ্গি সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। এদিকে পুলিশের পক্ষ থেকে সিলগালা করে দেওয়া বাড়িতে জঙ্গিদের সরঞ্জাম পাওয়া নিয়ে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।

নিউমার্কেট থানার অপারেশন অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, স্থানীয় লোকজনের অভিযোগের কারণে আড়াই মাস আগে দুবার ওই বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। এবার অভিযান চালিয়ে ছাত্রশিবিরের অনেক নথিপত্র এবং খেলনা অস্ত্র ছাড়াও র‌্যাব-পুলিশের পোশাক পাওয়া গেছে। বাড়ির মালিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আমিনুর রহমান মজুমদারকে সকালে থানায় ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তিনি পুলিশকে জানান, তাঁর বাড়ি থেকে শিবিরের যেসব সরঞ্জাম পাওয়া গেছে তা তিনি জানতেন না। প্রায় তিন মাস আগে তাঁর বাড়িতে শিবিরকর্মীরা ভাড়ায় থাকত।

নিউমার্কেট থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মহিউদ্দিন বলেন, শুক্রবার ভোরে থানা পুলিশের টহল টিম এলিফ্যান্ট রোড এলাকায় ডিউটিতে ছিল। স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে তারা জানতে পারে কে বা কারা ২৬৬ নম্বর বাড়ির গেটের তালা ভেঙেছে। তাৎক্ষণিক সেখানে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। এরপর পুরো বাসায় তল্লাশি চালিয়ে দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষ থেকে জঙ্গি সরঞ্জাম পাওয়া যায়। পরে খোঁজ নিয়ে পুলিশ জানতে পারে, বাড়িটি দেখাশোনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক হলের কর্মচারী মোস্তাফিজুর রহমান ও সিদ্দিক উল্লাহ। তাদের একই এলাকার ২৫০ নম্বর বাড়ি থেকে আটক করা হয়। ওই বাড়িটিও ড. আমিনুর রহমানের।

গতকাল সরেজমিন ওই এলাকায় গেলে স্থানীয় লোকজন বাড়িটি নিয়ে নানা ধরনের অভিযোগ করেন। আপাতদৃষ্টিতে বাড়িটি আগাছায় ভর্তি। বাইরে থেকে দেখে মনে হয়, সেখানে কেউ থাকে না। স্থানীয় লোকজনের কাছে বাড়িটি 'শিবিরের মেস' নামে পরিচিত। এ সময় কথা হয় বাড়িটির সামনে নির্মাণাধীন একটি বাড়ির কেয়ারটেকার কালাম হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, '২৬৬ নম্বর বাড়িটি ঘিরে অনেক আগে থেকেই এলাকাবাসীর সন্দেহ রয়েছে। আড়াই মাস আগেও পুলিশ ওই বাড়িতে অভিযান চালায়। লোক মারফত জেনেছি, বাড়িটি জঙ্গি ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।' নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন জানান, রাত যত গভীর হয় বাড়িটিতে লোকের আনাগোনাও তত বাড়তে থাকে।

আটককৃত মোস্তাফিজ গতকাল দুপুরে কালের কণ্ঠকে জানান, ড. আমিনুর রহমান ও তাঁর বাড়ি কুমিল্লার কৃষ্ণপুরে। স্যারের নির্দেশে ২৬৬ নম্বর বাড়িটি তিনি দেখাশোনা করতেন। বাসাটি দুই মাস ধরে তালাবদ্ধ ছিল। আগে মেস ছিল। বর্তমানে দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে আনিস নামে একজন থাকে। সিদ্দিক উল্লাহ বলেন, 'আমার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর চাটখিলে। স্যারের দুটি বাড়ির ২৫০ নম্বর বাড়িটি দেখাশোনা করি। এই বাড়ির নিচতলায় একটি ফোন-ফ্যাক্সের দোকান রয়েছে। দোকানটি স্যারের ছাত্র আনোয়ার ভাড়া নিয়েছে। সে শিবিরকর্মী। আমি ওই দোকানে মাসিক তিন হাজার টাকা বেতনে চাকরি করি মাত্র। চার বছর ধরে এখানে কাজ করছি। স্যারের ঘনিষ্ঠ অনেকেই এই এলাকায় থাকে।'

পুলিশ জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে শিবিরের যে কয়েকটি আস্তানা পুলিশ চিহ্নিত করেছিল এই বাড়িটি তার মধ্যে অন্যতম। এ ছাড়া ড. আমিনুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিবিরের মদদদাতা হিসেবে পরিচিত। ওই এলাকায় শিবিরের বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। ড. আমিনুরের বাসাটি জামায়াত-শিবিরের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
জব্দকৃত সরঞ্জাম সম্পর্কে পুলিশ জানায়, কয়েকটি বড় স্টিলের ট্রাঙ্ক ভেঙে বিপুল জিহাদি বই, বোমা তৈরির সরঞ্জাম, তিনটি প্লাস্টিকের খেলনা পিস্তল, দুটি প্লাস্টিকের খেলনা এসএমজি ও শর্টগান, তিনটি সবুজ কাপড়ের ব্যানার, আনসার, পুলিশ ও র‌্যাবের পোশাক, বাংলাদেশের পাঁচটি জাতীয় পতাকা, ছাত্রশিবিরের সাংগঠনিক চাঁদা আদায়ের রসিদ ও ১০টি বাংলাদেশ ইসলামনামা, ছাত্রশিবিরের সাংগঠনিক কয়েকটি বই, ছাত্রশিবিরের পাঁচটি লিফলেট, শিবিরের সদস্য সম্মেলনের ছয়টি ভাউচার, শিবিরের আয়-ব্যয়ের হিসাব_যার ভেতরে স্যার এফ রহমান হলের শিবিরের সদস্যদের নাম রয়েছে, ১০টি পুরনো সানলাইট কনকা ব্যাটারি, ১০টি ক্যাসেট, হ্যান্ডকাফ, বাঁশি, পোস্টার, টেলিভিশন, ব্যানার, ১৫টি ভিডিও, ১০টি অডিও ক্যাসেট, একটি প্যাকেটে ৬০ গ্রাম সাদা, লাল ও হলুদ রঙের পাউডার, ১/১১ পরবর্তী সময়ের বিভিন্ন ধরনের লিফলেট, লোহার টুকরা, অডিও ক্যাসেট, পুলিশের ড্রেস, টুপি, জুতা ও শিবিরের দলিলপত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া উদ্ধারকৃত নথিপত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল শাখার ছাত্রনেতাদের তালিকা পাওয়া গেছে। পুলিশের ধারণা, এই তালিকা শিবিরের হিট লিস্ট হতে পারে। এ ছাড়া ওই বাসা থেকে উদ্ধার করা খেলনা অস্ত্রগুলো শিবিরের প্রশিক্ষণ কাজে ব্যবহার করা হতো বলে মনে করছে পুলিশ।

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন