26 September 2010

একদিনে শতাধিক হিন্দুকে হত্যা

Fri, Sep 24th, 2010 10:32 pm BdST

মিন্টু চৌধুরী
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিবেদক
চট্টগ্রাম, সেপ্টেম্বর ২৪ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- একাত্তরের ১৩ এপ্রিল রাউজানের তিনটি এলাকায় দিনভর পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুসলিম লীগের সশস্ত্র কর্মী ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা হত্যা করে শতাধিক হিন্দু নর-নারীকে।

সেদিন কুণ্ডেশ্বরী, জগৎমল্ল ও ঊনসত্তর পাড়ার হামলায় নিহত হয় কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহসহ ১০৭ জন।

হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁেচ যাওয়া কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী ও তাদের স্বজন শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দিয়েছেন সেদিনের সে ঘটনার বিবরণ।

ঘটনা ৩৯ বছর আগের হলেও তা যেন তাদের কাছে 'এইতো সেদিনের'। সে স্মৃতি মনে উঠলে আজও তারা শিউরে ওঠেন, হয়ে পড়েন হতবিহ্বল।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দলের কাছে 'কোথায়-কীভাবে' সেদিন পাকবাহিনী তাদের এদেশীয় দোসরদের সহায়তায় ওই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিলো শুক্রবার তা বর্ণনা করে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন তারা।

রাউজানের দুটি স্থানের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তার বাবা তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর সম্পৃক্ততার বিষয়টি উঠে এসেছে।

সালাউদ্দিন কাদের অবশ্য তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছেন। তার দাবি, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে ছিলেন।

একাত্তরের ১৩ এপ্রিল সকালে কুণ্ডেশ্বরীতে নিজ বাড়িতে নূতন চন্দ্র সিংহকে, দুপুরে এর তিন কিলোমিটার দূরে জগৎমল্ল পাড়ায় একই পরিবারের সাতজনসহ ৩৭ জন নারী-পুরুষ এবং বিকাল ৫টার দিকে পাহাড়তলীর ঊনসত্তর পাড়ায় ৬৯ জনকে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের শিকার সকলেই সংখ্যালঘু হিন্দু স�প্রদায়ের।

কুণ্ডেশ্বরী ওষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহকে নিজ বাড়ির জগদ্ধাত্রী মন্দিরের সামনে হত্যা করা হয় বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দল ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে জানিয়েছেন তার বড় ভাইয়ের ছেলে ভূপতি চন্দ্র সিংহ (৬৩)।

নূতন চন্দ্র সিংকে গুলি করে হত্যার স্থানটি দেখিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, "একাত্তরের ১৩ এপ্রিল সকাল ৯টায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী পাক আর্মিদের সঙ্গে নিয়ে কুণ্ডেশ্বরী ভবনে আসে। এসময় আর্মিরা কাকার (নূতন সিং) সঙ্গে কথা বলে সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যায়।

"কিন্তু সে (সাকা চৌধুরী) রাউজান কলেজ ক্যাম্প থেকে ১০টার দিকে দুই গাড়ি সেনা নিয়ে কুণ্ডেশ্বরী ভবনে আসে। এসময় তারা ভবনের গেইট ভেঙ্গে প্রবেশ করে।"

তখন সাকা চৌধুরীর সঙ্গে স্থানীয় মুসলিম লীগ সদস্য ও রাজাকার আবদুল মাবুদ, নবাব মিয়া, গোলাম আলী, এলাহী বক্স ও আবদুস সালাম ছিলো বলে জানান ভূপতি সিংহ।

তিনি বলেন, "সে সময় আমি প্রাণভয়ে ভবন থেকে এক-দেড় কিলোমিটার দূরে বিনাজুরী গ্রামে আশ্রয় নেই। পরে তিনটি গুলির শব্দ শুনতে পাই এবং তার কিছু পরে ঘটনাস্থলে আসি।

কুণ্ডেশ্বরী ভবনের প্রবেশ পথের অদূরে পুকুর পাড়ে তার 'কাকাকে দাহ করা হয়' বলে কন্নাজড়িত কণ্ঠে জানান ভূপতি সিংহ।

নূতন চন্দ্র সিংহর ছেলে প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "সাকা চৌধুরীই পাক বাহিনীকে আমাদের বাড়িতে এনে বাবাকে গুলি করে হত্যা করিয়েছিলো।"

রঞ্জন সিংহ জানান, ঘটনার দুই দিন আগে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তিনি দেশ ত্যাগ করেন। তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান আমানত খাঁ চৌধুরী তাদেরকে এ তথ্য জানান।

মল্লপাড়ায় ৩৭ জন হত্যার সাক্ষী জোৎস্নাপ্রভা

কুণ্ডেশ্বরীর দুই কিলোমিটার দূরে জগৎমল্ল পাড়ার ৮০ বছর বয়সী জোৎস্নাপ্রভা এখন আর আগের মতো শুনতে পান না, চোখেও দেখেন না ভালভাবে।

একাত্তরের ১৩ এপ্রিল দুপুরে স্বামীসহ সাতজনকে হারিয়েছেন তিনি। তার চোখের সামনে ৩৭ জনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হয়। নির্মম ওই স্মৃতি নিয়ে আজও বেঁচে আছেন তিনি।

অভিযোগ রয়েছে, নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যার পর ফেরার পথে সাকা চৌধুরী ও তার অনুগতরা পাকবাহিনীকে এনে এ হত্যাযজ্ঞ চালায়।

শুক্রবার দুপুরে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালের তদন্ত দল যখন জোৎস্নাপ্রভার বাড়িতে পৌঁছায় তখনো তিনি বারান্দায় বসা। অনেক কষ্টে স্মৃতি হাতড়ে তদন্ত দলের কাছে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি।

তার স্বজনদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, জ্যোৎস্নাপ্রভা চৌধুরীর বাড়ির উঠানে সেদিন জড়ো করা হয়েছিলো প্রায় ৪০ জনকে। পরে তাদের ব্রাশ ফায়ার করা হয়। গুলির শব্দে লাশের স্তুপের ওপর পড়ে জ্ঞান হারিয়ে প্রাণে বেঁচে যান জ্যোৎস্নাপ্রভা; হারান স্বামীসহ সাতজনকে।

তার বাড়ির অদূরে শহীদ ৩৫ জনের নামফলক সম্বলিত একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। তদন্ত দল ও উপস্থিত সাংবাদিকরা শহীদদের স্মরণে শুক্রবার সেখানে এক মিনিট নিরবতা পালন করেন।

ঊনসত্তর পাড়ায় দাহর পরিবর্তে মাটিচাপা

ঊনসত্তর পাড়ার মহাজন বাড়ির পুকুর ঘাট সংলগ্ন পাড় দেখিয়ে অজিত মহাজন (৫৫) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "এখানেই ৭০-৭২ জন নারী-পুরুষকে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করা হয়।"

ব্রাশ ফায়ারে অজিতের বাবা যোগেশ মহাজন, বড় ভাই রণজিত মহাজনসহ হিন্দু স�প্রদায়ের ৬৯ জন প্রাণ হারান।

অজিত মহাজন জানান, পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের ভয়ে ওই হিন্দু পাড়ার সব যুবক পালিয়ে থাকায় নিহত ৬৯ জনকে ধর্মীয় মতে দাহ করা হয়নি। মহাজন বাড়ির ওই পুকুর সংলগ্ন একটি খাড়িতেই কোনরকমে মাটিচাপা দেওয়া হয়।

হত্যাকাণ্ডের সময় তার মা হরিলতা মহাজন ও বৌদি মিনতি মহাজনকে পুকুরের একপাশে বসিয়ে রাখা হয়েছিলো বলেও তিনি জানান।

অিজিত বলেন, "স্থানীয় মুসলিম লীগের নেতারা পাকিস্তানি বাহিনীকে আমাদের পাড়ায় নিয়ে এসে এ হত্যাকাণ্ড চালায়।"

তবে ওই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া পাক বাহিনীর এ দেশীয় দোসরদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানাতে পারেননি তিনি।

অজিত অভিযোগ করেন, ঊনসত্তর পাড়ায় হত্যাকাণ্ডে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা এখনো কোনো স্বীকৃতি পায়নি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/এমসি/এজে/জিএনএ/১০৩০ ঘ.

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন