নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল ও পিরোজপুর প্রতিনিধি
মুক্তিযুদ্ধের সময় দক্ষিণাঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের সবচেয়ে বড় আস্তানা ছিল পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার ছারছিনার পীরের দরবার শরিফে। তৎকালীন পীর শাহ আবু জাফর মোহম্মদ ছালেহ পাকিস্তানি বাহিনীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। দরবার শরিফের ভেতরে রয়েছে অরক্ষিত এক বধ্যভূমি। মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের লোকজন এ কথা জানান। ছারছিনা পীর জীবদ্দশায় 'স্বাধীনতা পদক' ও 'একুশে পদক' পেয়েছিলেন।
পিরোজপুর জেলা প্রশাসন স্বাধীনতাবিরোধীদের যে তালিকা তৈরি করেছিল, সেখানে ছারছিনা পীর শাহ আবু জাফর মোহম্মদ ছালেহর নাম রয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তদল গতকাল মঙ্গলবার দরবার শরিফের ভেতরের অরক্ষিত বধ্যভূমি পরিদর্শন করে। পীরের দরবার শরিফের বধ্যভূমিতে এটাই প্রথম কোনো সরকারি তদন্তদলের সফর। দরবার শরিফের ভেতরে মানুষ ধরে এনে কিভাবে হত্যা করা হতো, তদন্তদল শহীদদের পরিবারের কাছ থেকে তার বর্ণনা শুনে লিপিবদ্ধ করে।
তদন্তদলের প্রধান কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হেলাল উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা শুনেছি, মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক লোক ধরে নিয়ে ছারছিনা দরবার শরিফের ভেতরে খুন করা হয়েছে। দরবারের পেছনের দিক দিয়ে বয়ে চলা একটি খালের অংশে বাঁধ দিয়ে সেখানে লাশ ফেলে রাখা হতো।' তিনি বলেন, 'অরক্ষিত বধ্যভূমিটি পরিদর্শন শেষে পুরো বিষয়টি নিয়ে দরবার শরিফের ভেতরের আলিয়া মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সৈয়দ মুহাম্মদ শারফত আলীসহ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। দরবারের বধ্যভূমি সম্পর্কে আগে বিশদ জানা না থাকায় এটি আমাদের তালিকা থেকে বাদ পড়েছিল। কিন্তু মতবিনিময় সভায় বিষয়টি উঠে আসায় আমরা তড়িঘড়ি করে বধ্যভূমিটি পরিদর্শন করি।'
হেলাল উদ্দিনের নেতৃত্বে উপপরিদর্শক (এসআই) ওবায়দুল্লাহ, নূর হোসেন ও শাহজাহান গতকাল স্বরূপকাঠি উপজেলার কুড়িয়ানা পেয়ারা বাগান ও কুড়িয়ানা আর্যসম্মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়সংলগ্ন বধ্যভূমিসহ আটটি বধ্যভূমি পরিদর্শন করেন। এ সময় তাঁরা ২০ জনের সাক্ষ্য নেন। এর আগে তাঁরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধা, সুশীল সমাজ, শহীদ পরিবারের সদস্য, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
ছারছিনা আলিয়া মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সৈয়দ মুহাম্মদ শারফত আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'তদন্তদল আমার কাছে জানতে চেয়েছিল দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এ প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছিলেন কি না? আমি তদন্তদলকে জানিয়েছি, ১৯৫৭ সালে সাঈদী সাহেব এ প্রতিষ্ঠান থেকে দাখিলে প্রথম বিভাগে পাস করেন। দাখিল পাসের পর তৎকালীন পীরসাহেব শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে সাঈদীকে প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দিয়েছিলেন বলে শুনেছি। কিন্তু তাঁর প্রমাণাদি প্রতিষ্ঠানে রক্ষিত নেই।' মরহুম পীরের বিষয় কিংবা অভ্যন্তরের বধ্যভূমির ব্যাপারে তদন্তদল তাঁকে কোনো প্রশ্ন করেনি বলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দাবি করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বরূপকাঠি ও বানারীপাড়া নিয়ে গঠিত বেস কমান্ডার বেনু লাল দাশগুপ্ত কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার চোখের সামনে থেকে ছারছিনা পীরের অনুসারীরা মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান কাজীকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর আর সহযোদ্ধাকে ফিরে পাইনি। লাশও পাওয়া যায়নি।' তিনি আরো বলেন, 'ভেবেছিলাম, তদন্তদল স্বরূপকাঠিতে আসার আগে আমাদের অবহিত করবে। কিন্তু তারা সেটি করেনি।'
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন