1 September 2010

জামায়াতের কৌশল: নিষিদ্ধ হলে আত্মগোপন

সেলিম জাহিদ

নিষিদ্ধ হলে জামায়াতে ইসলামী বিকল্প কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করবে না। অন্য কোনো দলের ছায়াতলেও আশ্রয় নেবে না। সমাজসেবা ও ধর্মীয় কার্যক্রমের আবরণে দলের নেতা-কর্মীরা সংগঠিত থেকে গোপনে রাজনৈতিক তৎপরতা চালাবে।

দলের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা এ বিষয়ে কোনো স্পষ্ট তথ্য জানাতে অস্বীকৃতি জানালেও নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে, জামায়াতে ইসলামী নাম পাল্টে নতুন দল না করার ব্যাপারে দলীয় সিদ্ধান্ত একরকম চূড়ান্ত।

ঢাকা মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি ও দলের সংসদ সদস্য হামিদুর রহমান আযাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'জামায়াতে ইসলামী জামায়াতে ইসলামীই। বিকল্প দল আবার কী?'

দলের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা আবদুল হালিম স্পষ্ট করেই বলেন, 'আমরা নতুন কোনো দল করব না।' দলটির তরুণ নেতা ও শিবিরের সাবেক সভাপতি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ যোগ করেন, 'নতুন পার্টি করার অর্থ সরকারের সিদ্ধান্তকে তাৎক্ষণিকভাবে মেনে নেওয়া।'

সূত্র জানিয়েছে, সরকার জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করুক অথবা নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন বাতিল করুক_নিষেধাজ্ঞা আদেশের আইনি দিক পর্যালোচনা করে জামায়াত এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবে। আদালতের চূড়ান্ত রায় ঘোষণার আগ পর্যন্ত তারা গোপনে সংগঠন করবে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সাংবিধানিকভাবে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ অথবা জামায়াতকে এককভাবে নিষিদ্ধ করা হলে বিকল্প রাজনৈতিক দল গঠনসহ দলের কর্মপন্থা ঠিক করতে সম্প্রতি জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির অধ্যাপক এ কে এম নাজির আহমদকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি 'রাজনৈতিক কমিটি' গঠন করা হয়। গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত এ কমিটির প্রধান ছিলেন দলের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ। জামায়াত নিষিদ্ধ হলে নতুন নামে দল গঠন করা সমীচীন হবে কি না, তা যাচাই করেছে এ কমিটি। দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সঙ্গে আলাদাভাবে মতবিনিময় করেন কমিটির সদস্যরা। জানা গেছে, সংস্কারপন্থী অংশটি নতুন দল গঠনের পক্ষে মত দিলেও বেশির ভাগ মতামত আসে এর বিপক্ষে।

জামায়াত গোপন রাজনীতিতে গেলে এর প্রভাব কী হতে পারে_জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, 'জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলে আমার মনে হয় না সরকারের খুব একটা লাভ হবে। দল নিষিদ্ধ হলে তারা হয় আন্ডারগ্রাউন্ডে যাবে, না হয় অন্য পার্টিতে যাবে।'

নতুন দলে ঝুঁকি : বিকল্প রাজনৈতিক দল গঠনে জামায়াতের নীতি-নির্ধারকদের অনাগ্রহের পেছনে তিনটি কারণ অনুসন্ধান করে পাওয়া গেছে। প্রথমটি হচ্ছে, নতুন দল গঠন করলে নতুন নেতৃত্বের দাবি উঠতে পারে। তাতে দলের নেতৃত্ব নিয়ে নতুন করে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্বকে আগের নেতৃত্বের ছায়া হিসেবে ধরা হয়। নতুন দল গঠন হলে পুরনো নেতৃত্ব বাদ দেওয়ার জোর দাবি উঠতে পারে।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে, নতুন নামে দল গঠন করা হলে কথিত সংস্কারপন্থী অংশের প্রভাব বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীসহ কথিত সংস্কারপন্থী অংশটি 'জামায়াতে ইসলামী' নাম এবং নেতৃত্ব পরিবর্তনের পক্ষে। এখন নতুন নামে দল করলে এ অংশটির বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা-চেতনাই গ্রহণযোগ্যতা পাবে।

তৃতীয়টি হচ্ছে, অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে জামায়াত নাম বদল করতে চাচ্ছে না। ১৯৭২ সালে জামায়াত নিষিদ্ধ হওয়ার পর দলের নেতা-কর্মীরা আরো কয়েকটি দলের সমন্বয়ে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল) গঠন করেন। এক বছর পর আইডিএলের সভাপতি হন তৎকালীণ পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা আবদুর রহিম। কিন্তু ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান সরকার পলিটিক্যাল পার্টিজ রেগুলেশন রহিত করার পর 'জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ' স্বনামে রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত নিলেও মাওলানা আবদুর রহিম ও তাঁর অনুসারীরা আর জামায়াতে ফেরেননি। পরে জামায়াত তাঁকে অব্যাহতি দিতে বাধ্য হয়। নতুন দল না করার ক্ষেত্রে সে অভিজ্ঞতাটি মাথায় রেখেছে জামায়াত।

প্রয়োজনে চার কর্মসূচির একটি বাদ : একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিষিদ্ধ হলে জামায়াতে ইসলামী দলের গঠনতন্ত্রের ছয় নম্বর ধারার স্থায়ী চার কর্মসূচির মধ্যে রাজনৈতিক কর্মসূচিটি বাদ দিয়ে বাকি তিন দফা কর্মসূচি চালিয়ে যাবে। এ তিন দফায় দাওয়াত, সংগঠন ও প্রশিক্ষণ, সমাজসেবা ও সংস্কারের কথা বলা আছে। অন্যদিকে স্থায়ী কর্মসূচির চার নম্বরে বলা হয়েছে, 'ইসলামের পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠাকল্পে গোটা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় বাঞ্ছিত সংশোধন আনয়নের উদ্দেশ্যে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সরকার পরিবর্তন এবং সমাজের সর্বস্তরে সৎ ও খোদাভীরু নেতৃত্ব কায়েমের চেষ্টা করা।'

এ কর্মসূচিতে রাজনৈতিক সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। নিষিদ্ধ হলে আপদকালে জামায়াত এ অংশটি বাদ দেবে বলে জানা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের একজন সদস্য বলেন, 'জামায়াত নিছক কেবল একটি রাজনৈতিক দল নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী আন্দোলন। সুতরাং নিষিদ্ধ হলে জামায়াত অন্য তিন কর্মসূচির ভিত্তিতে দাওয়াতি কাজ চালিয়ে যাবে।'

তিনবার নিষিদ্ধ : ১৯৪১ সালে জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন সময়ে দলটি নিষিদ্ধ হয়। প্রথম নিষিদ্ধ হয় ১৯৫৯ সালের ৮ অক্টোবর। ওই সময় আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করলে জামায়াতসহ সব দলের রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৬২ সালের ১৫ জুলাই পর্যন্ত এ ফরমান বলবৎ ছিল। এরপর ১৯৬৪ সালের ৬ জানুয়ারি আইয়ুব খান জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন। এ সময় জামায়াতের তাত্তি্বক নেতা মাওলানা সৈয়দ আবুল আলা মওদুদীসহ ৬০ জন নেতাকে গ্রেপ্তার করে কারাবন্দি করা হয়। সে বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের রায়ে জামায়াত আবার প্রকাশ্যে রাজনীতি করার অধিকার পায়।

সর্বশেষ ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান হলে জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামের নামে দল গঠন এবং ইসলামী আন্দোলন ও তৎপরতা নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান পলিটিক্যাল পার্টিজ রেগুলেশনের (পিপিআর) আওতায় রাজনৈতিক দল গঠনের অনুমতি দিলে কয়েকটি অবলুপ্ত দলের সমন্বয়ে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল) গঠিত হলে জামায়াতের নেতা-কর্মীরা তাতে যোগ দেন। ১৯৭৯ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে পিপিআর রহিত করা হলে ওই বছরের ২৫ মে সম্মেলন করে জামায়াতে ইসলামী নামে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর ঘোষণা দিয়ে কাজ শুরু করে দলটি।

জানা গেছে, যতবারই নিষিদ্ধ হয়েছে, ততবারই জামায়াত গোপনে সাংগঠনিক কাজ চালিয়েছে। কখনো জামায়াতের রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ থাকেনি। এ বিষয়ে জামায়াতের সাবেক ভারপ্রাপ্ত আমির মরহুম আব্বাস আলী খান তাঁর 'জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস' গ্রন্থে লিখেন, 'বাংলাদেশে জামায়াত কর্মীগণ রীতিমতো সংগঠনের মাধ্যমে প্রকাশ্যে ইসলামী আন্দোলন না করলেও আন্দোলন থেকে দূরে সরে পড়েননি। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক-দ্বীনি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের মধ্যে আন্দোলনের প্রেরণা জাগ্রত রাখেন।'

অতীতের প্রেক্ষাপট এখন আর নেই মন্তব্য করে হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, 'দল নিষিদ্ধ করা কোনো গণতান্ত্রিক আচরণ নয়। জামায়াত নিবন্ধিত ও জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল একটি আইনানুগ সংগঠন। একে কোনো অজুহাতে নিষিদ্ধ করার সুযোগ নেই।'

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন