22 August 2010

বাংলাদেশ বিমান, কাবোর উড়োজাহাজ এবং ৮৩-বিস

আলমগীর সাত্তার

কাবোর উড়োজাহাজটি নিয়ে কিছু বলার আগে, বাংলাদেশ বিমানের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের একটি বক্তব্য নিয়ে একটু আলোচনা করতে চাই।

বিমানের চেয়ারম্যান দাবি করেছেন, বিমান একটি পাবলিক লিমিটেড কম্পানি। বিমানসংক্রান্ত সব সিদ্ধান্তই বিমানের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান এবং সদস্যরাই কেবল গ্রহণ করার অধিকার রাখেন। বেসামরিক পরিবহন সংস্থার মন্ত্রীর বিমানের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার কোনো এক্তিয়ার নেই। কিন্তু সবাই জানে, যেকোনো পাবলিক লিমিটেড কম্পানির পরিচালনা পর্ষদকে ওই কম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের কথা শুনতে হয়। পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানসহ অন্য সদস্যদের নির্বাচিত করেন শেয়ারহোল্ডাররা। বিমান পাবলিক লিমিটেড কম্পানি হলেও এর শতভাগ শেয়ারের মালিক আমাদের সরকার। এ ক্ষেত্রে বিমানের পরিচালনা পর্ষদকে সরকারের সব নির্দেশ অবশ্যই মেনে চলতে হবে। সরকার একজনকে বিমান এবং সিভিল এভিয়েশন বিভাগ দেখাশোনা করার দায়িত্ব দিয়েছেন, যাকে আমরা মন্ত্রী বলে জানি। তাই বিমানের পরিচালনা পর্ষদকে ওই মন্ত্রী মহোদয়ের নির্দেশ মানতে হবে। আবার মন্ত্রী মহোদয়ও জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে দায়বদ্ধ। বাংলাদেশ বিমানের মালিক এখনো এ দেশেরই জনগণ। ১৯ আগস্ট এটিএন নিউজ চ্যানেলে কথাগুলো ভালো করেই বুঝিয়ে বলেছেন মন্ত্রী মহোদয়। আমি শুধু কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করলাম। এর কারণ পাঠকদের সবাই তো আর এটিএন নিউজ চ্যানেলে মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্য শোনেননি।

এবার লিজে আনা কাবোর উড়োজাহাজ সম্পর্কে কিছু কথা বলা যাক।

উড়োজাহাজ যাতে নিরাপদে চলাচল করতে পারে সে জন্য আইকাও (ICAO) ১৯০ দেশের জন্য কিছু নিয়মনীতি করে দিয়েছে। বাংলাদেশসহ এই ১৯০ দেশের সিভিল এভিয়েশন বিভাগ ওই নিয়মনীতিগুলো আন্তর্জাতিক আইন বলে মেনে চলে।

ভিন্নদেশ থেকে উড়োজাহাজ লিজ নেওয়ার এবং দেওয়ার ব্যাপারে আইকাও সে নিয়মনীতি করে দিয়েছে, তার ৮৩-বিস (83-bis) ধারায় বলা হয়েছে : ভিন্ন দেশ থেকে উড়োজাহাজ লিজের মাধ্যমে আনতে হলে উড়োজাহাজের মালিক প্রতিষ্ঠান এবং লিজ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান বা এয়ারলাইনের মধ্যে সবরকমের শর্তাবলি উল্লেখ করে একটি এমওইউ (mou = memorandum of understanding) স্বাক্ষর করতে হবে। এ ছাড়া যে দেশ থেকে উড়োজাহাজ আনয়ন করা হবে সে দেশের সিভিল এভিয়েশন এবং লিজ গ্রহণকারী দেশের সিভিল এভিয়েশন অথরিটির মধ্যে আলাদাভাবে আরো একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে হবে। এই চুক্তিকে বলা হয় এমওএ (MOA = Memorandum of agreement)। ওই চুক্তিতে উড়োজাহাজের এয়ারওয়ার্দিনেস, পাইলটদের যোগ্যতাসহ বিস্তারিত তথ্য থাকে। প্রতিটি উড়োজাহাজে দুই কপি করে ওই উড়োজাহাজের ফ্লাইট ম্যান্যুয়াল (Flight manual) রাখা সব দেশেই বাধ্যতামূলক। ওই ম্যান্যুয়ালে উড়োজাহাজটির সম্পূর্ণ ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা থাকে। ৮৩-বিস ধারা অনুযায়ী লিজ গ্রহণকারী দেশের সিভিল এভিয়েশন বিভাগকে উড়োজাহাজটির এক কপি ফ্লাইট ম্যান্যুয়াল সরবরাহ করতে হয়। আমার জানা মতে, কাবো উড়োজাহাজটি লিজে আনয়নের সময় ৮৩-বিস ধারা অনুযায়ী কোনো চুক্তি আমাদের সিভিল এভিয়েশন বিভাগের সঙ্গে করা হয়নি। তাই কাবোর উড়োজাহাজটির সঠিক ইতিহাস আমাদের জানা নেই।

পত্রপত্রিকার মাধ্যমে দেশবাসী জানে, কাবোর উড়োজাহাজটি অতিশয় পুরনো। চার বছর যাবৎ এই অ্যারোপ্লেনটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। অ্যারোপ্লেন অব্যবহৃত অবস্থায় ফেলে রাখতে হলেও কতগুলো নিয়মনীতি মানতে হয়। আলোচিত অ্যারোপ্লেনটি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকার সময় কি সে নিয়মনীতি মনে চলেছিল, তাও আমাদের জানা নেই।

আমার কথা হলো, এমন পুরনো দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রাখা অ্যারোপ্লেনটি জোড়াতালি দিয়ে ঠিক করে সম্মানিত হাজিদের পরিবহন করা কি ঠিক কাজ করা হবে? হাজিদের পরিবহন করতে গিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে প্লেনটি বিধ্বস্ত হলে এবং তাতে করে পাঁচ শর অধিক হাজি মারা গেলে বর্তমান সরকারের সুনাম কোন পর্যায়ে পেঁৗছবে, সে বিষয়ে শুধু বিমানের মন্ত্রী মহোদয় নন, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও চিন্তা করে দেখতে অনুরোধ করব।

আমি আমাদের বেসামরিক পরিবহন মন্ত্রীকে একটি বিষয়ে সতর্ক করে দিতে চাই যে, দীর্ঘকাল বিমানে পাইলট হিসেবে চাকরি করতে গিয়ে আমি দেখেছি, হজ ফ্লাইট শুরু হওয়ার আগে বিমানের নিজস্ব প্লেনগুলোর যান্ত্রিক ত্রুটি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। ফলে ওই প্লেনগুলো উড্ডয়ন ক্ষমতা হারিয়ে ভূমিতেই স্থান করে নেয়। এমনটা তো ইচ্ছে করেই করা হয়, যাতে করে শেষ মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে দ্বিগুণ ভাড়ায় বিদেশ থেকে লিজে উড়োজাহাজ আনতে বাধ্য হয়। এ বছর এমন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এর আছে আবার দুটি কারণ! প্রথমটি হলো, বিমানে বর্তমানে আছেন একজন চিফ ইঞ্জিনিয়ার, যিনি জামায়াতে ইসলামী দলের রুকন পর্যায়ের নেতা। এই রুকনের আছে আবার বেশ কিছু অনুসারী। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর প্রচেষ্টা হিসেবে সরকারের জন্য নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে তারা চাইবে। দ্বিতীয় কারণ, কাবোর উড়োজাহাজসংক্রান্ত ব্যাপারে মাননীয় মন্ত্রী তাঁর সততার কারণে অনেক শত্রু সৃষ্টি করেছেন। এই শত্রুরা অনেক ক্ষমতাধর। তাদের সবার নামোল্লেখ করে মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে আমার নিজের বিপদের মাত্রা বৃদ্ধি করতে চাই না।

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন