নিজস্ব প্রতিবেদক
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল বা কোনো সরকারি কার্যালয়ে বোরকা কিংবা ধর্মীয় পোশাক পরতে কাউকে বাধ্য করা যাবে না বলে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে মেয়েদের বাধা না দেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
গতকাল রবিবার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে সুয়োমোটো এসব আদেশ দেন। এর আগে গত ২ মার্চ হাইকোর্টের অপর একটি বেঞ্চ বোরকা না পরার কারণে কোনো মহিলা বা বালিকাকে গ্রেপ্তার বা নির্যাতন বা হয়রানি না করতে সরকার ও পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
গতকাল নাটোরের সরকারি রানী ভবানী মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হককে ২৬ আগস্ট আদালতে সশরীরে হাজির হয়ে তাঁর অবস্থান ব্যাখ্যা করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে জরুরিভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
একই সঙ্গে আদালত বোরকা পরতে বাধ্য করা এবং খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড থেকে মেয়েদের বাধা দেওয়া কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তার কারণ জানতে চেয়ে সরকারের প্রতি রুল জারি করেছেন। শিক্ষা, স্বরাষ্ট্রসচিব, সংস্কৃতি, সমাজকল্যাণ, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং নাটোরের সরকারি রানী ভবানী মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হকের প্রতি এই রুল জারি করা হয়। আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
'নাটোরের সরকারি রানী ভবানী মহিলা কলেজ, বোরকা না পরলে আসতে মানা' শিরোনামে গতকাল রবিবার দৈনিক 'কালের কণ্ঠ' পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, "নাটোর রানী ভবানী সরকারি মহিলা কলেজে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ও খেলাধুলায় ছাত্রীদের অংশ নেওয়ার ওপর জারি রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক মাস দুয়েক আগে কলেজে যোগ দেওয়ার পরই নির্দেশ দেন, বোরকা পরে আসতে হবে ছাত্রীদের। এ নির্দেশ না মানায় অনেককেই কলেজে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, অধ্যক্ষ 'অবাধ্য' ছাত্রীদের গায়ে হাত তুলতে পর্যন্ত দ্বিধা করেন না।"
এই প্রতিবেদনটি গতকাল সংশ্লিষ্ট আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক ও অ্যাডভোকেট কে এম হাফিজুল আলম। তাঁরা গতকাল 'কালের কণ্ঠ' পত্রিকাটি আদালতে উপস্থাপন করে আদালতের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। আদালত সংক্ষিপ্ত শুনানি শেষে ওই আদেশ দেন।
ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক আদালতে শুনানিকালে বলেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বসবাস করে। এ কারণেই দেশের সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা ধর্মের লোক কর্মরত থাকেন। সেখানে বিশেষ ধর্মের পোশাক পরতে বাধ্য করা হলে অন্য ধর্মের যারা আছেন, তাঁদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হয়। এ ছাড়া মুসলিমদের মধ্যে যারা ধর্মীয় পোশাক পরতে ইচ্ছুক নন, তাঁদেরও ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করা হয়। তিনি বলেন, সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য দেখাতে পারবে না। রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করবে। তিনি বলেন, সংবিধান অনুযায়ী কারো মেধা বিকাশে বাধা দেওয়া যাবে না। স্কুল-কলেজে মেধা বিকাশের একটি অপরিহার্য বিষয় হচ্ছে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। তাই এ কাজে বাধা দেওয়া যাবে না। বাধা দেওয়াটা সংবিধান লঙ্ঘন। এ ছাড়া আইনের দৃষ্টিতে এটা অবৈধ ও বেআইনি। তিনি বলেন, মেয়েদের খেলাধুলা থেকে বিরত রাখা ও বোরকা পরতে বাধ্য করা বৈষম্যমূলক।
উল্লেখ্য, রানী ভবানী মহিলা কলেজের আড়াই শ শিক্ষার্থী তাদের অভিযোগসংবলিত একটি চিঠি গত ৭ আগস্ট শিক্ষাসচিব বরাবর কুরিয়ারে পাঠান। তবে এখন পর্যন্ত সমস্যার কোনো সুরাহা হয়নি। চিঠিতে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন, জুন মাসে এ কলেজে যোগ দেন অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক। এরপরই তিনি ছাত্রীদের বোরকা ও মার্কিন সাদা কাপড়ের স্কার্ফ পরে আসার নির্দেশ দেন। নির্দেশ অমান্যকারীদের কলেজ গেট থেকে বিদায় করে দেওয়া হয়। দু-একজন ছাত্রী তাঁর চোখ এড়িয়ে কলেজে ঢুকে পড়লে অধ্যক্ষ অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন ও গায়ে হাত তোলেন। শিক্ষার্থীদের আরো অভিযোগ, অধ্যক্ষ কলেজে মেয়েদের সব ধরনের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি হোস্টেলের মেয়েদের জানান না দিয়েই অনেকের কক্ষে ঢুকে পড়েন। এতে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছে ছাত্রীরা। শিক্ষাসচিবের কাছ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে গত বৃহস্পতিবার কয়েকজন ছাত্রী স্থানীয় সাংবাদিকদের বিষয়টি জানান।
রংপুরের ঘটনা
গত মার্চে বোরকা না পরার কারণে রংপুরে চিড়িয়াখানা ও সুরভী উদ্যান থেকে ১৯ যুবক-যুবতীকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। এরপর তাদের মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। ইসলামপরিপন্থী, ধর্মীয় আইনবিরোধী ও বেপর্দানশীন অবস্থায় চলাফেরা করায় তাদের আটক করা হয়।
এ ঘটনায় গত ২ মার্চ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হলে ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক, অ্যাডভোকেট কে এম হাফিজুল ইসলাম ও ব্যারিস্টার ইমতাজুল হাই একটি রিট আবেদন করেন। এর ওপর প্রাথমিক শুনানি শেষে আদালত রংপুরে চিড়িয়াখানা ও সুরভী উদ্যান থেকে যুবক-যুবতীদের আটকের ঘটনার কেন তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং ওই তদন্তের ওপর ভিত্তি করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে না_তার কারণ জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। ওই রুল এখনো বিচারাধীন। এই রুলের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২ মার্চ হাইকোর্ট বোরখা না পরার কারণে কোনো নারী বা বালিকাকে গ্রেপ্তার বা নির্যাতন বা হয়রানি না করতে সরকার ও পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দেন।
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন