10 August 2010

চিহ্নিত এক রাজাকারের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ

তাবিউর রহমান, ঢাকা ও শরীফ আহমেদ শামীম, গাজীপুর

গাজীপুুরে একজন আইনজীবীর বিরুদ্ধে আদালতের নির্দেশ লঙ্ঘন করে অন্যের জমি দখল এবং জমির মালিকের বিরুদ্ধে উপর্যুপরি মামলা দিয়ে হয়রানি করার অভিযোগ এসেছে। অভিযুক্ত অ্যাডভোকেট এম এ মালেক ওরফে মালেক দাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগও রয়েছে। গত সোমবার গোপালগঞ্জে দায়ের করা এক মামলায় বলা হয়, ১৯৭১ সালে মালেক দাই একজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেন। মামলায় এম এ মালেককে জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

বর্তমানে গাজীপুরে বসবাস করলেও এম এ মালেকের পৈতৃক নিবাস গোপালগঞ্জে। ২০০৮ সালে তৈরি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কোটালীপাড়া ইউনিটের সশস্ত্র রাজাকারদের তালিকার ১৮৭ নম্বরে তাঁর নাম রয়েছে।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গাজীপুর সদরের দক্ষিণ ছায়াবীথি এলাকায় রুহুল কুদ্দুস সোহাগ নামের একজন ব্যবসায়ী গত বছর ছয় শতাংশ জমি (৩৪৫ নম্বর খতিয়ানভুক্ত আরএস ২৫৪৫) কেনেন। ২০০৮ সালে পাশের ২২৯৯ নম্বর দাগের সাত শতাংশ জমি কিনেছিলেন এম এ মালেক। সোহাগ কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁর জমিতে এম এ মালেক বাড়ি নির্মাণের চেষ্টা করছেন। বাধা দেওয়ায় মালেক তাঁর বিরুদ্ধে গত ২৫ জানুয়ারি গাজীপুর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। এরপর চার মাসের ব্যবধানে তিনি আদালতে সোহাগের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির আরো চারটি মামলা দায়ের করেন।

সোহাগ বলেন, গত ২৪ মে মালেকের আবেদনের পর গাজীপুর জেলা জজ ওই জমিতে তাঁর (সোহাগ) যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এরপর সোহাগ উচ্চ আদালতে আপিল করলে গত ১০ জুন আদালত জমির ওপর স্থিতাবস্থা জারি করেন। এ আদেশ বহাল থাকা অবস্থায়ই গত বৃহস্পতিবার এম এ মালেক আবারও নির্মাণকাজ শুরু করেছেন।
তবে এম এ মালেক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই গাজীপুর জেলা জজ সোহাগকে জমিতে যেতে নিষেধ করেছেন। উচ্চ আদালতের স্থিতাবস্থার কথা আমার জানা নেই।'

সোহাগ বলেন, এম এ মালেক প্রভাবশালী আইনজীবী হওয়ায় তিনি (সোহাগ) অন্য আইনজীবীদেরও পাশে পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, 'গত জানুয়ারি মাসের আগে পর্যন্ত দেশের কোনো থানায় আমার নামে মামলা তো দূরের কথা, একটা সামান্য জিডি পর্যন্ত ছিল না। অথচ একজন যুদ্ধাপরাধীর অপকর্মে বাধা দেওয়ার কারণে চার-পাঁচটি মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। আইনজীবীর অভাবে জামিন নিতে পারছি না। আমার পালিয়ে বেড়ানোর সুযোগে এম এ মালেক আবারও বাড়ি নির্মাণ শুরু করেছেন।' সোহাগ আরো বলেন, 'এম এ মালেকের ২৫ জানুয়ারির মামলায় আমার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। আমার জন্য অ্যাডভোকেট আবুল আলা মোহাম্মদ তাকি আদালতে জামিন চাইতে গেলে তাঁকে গাজীপুর জেলা আইনজীবী সমিতি থেকে বহিষ্কার করে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়।'

এদিকে ব্যবসায়ী সোহাগ ও এম এ মালেকের দলিল পর্যালোচনা করে একাধিক আইনজীবী জানান, দুজনের জমির দাগ খতিয়ান সবই আলাদা। দলিল অনুযায়ী ভোগ দখলে গেলে বিরোধ মিটে যাবে। জানা যায়, দলিল অনুযায়ী জমির সীমানা চিহ্নিত করে দিতে গাজীপুর পৌরসভা কর্তৃপক্ষ দুই পক্ষকে ডাকলেও সাড়া দেননি এম এ মালেক। এরপর একাধিক নোটিশ দিলেও তিনি জবাব দেননি। পরে পৌরসভার সার্ভেয়ার সোহাগের জমির সীমানা নির্ধারণ করে গত ১২ মে প্রতিবেদন দিয়েছেন। এতে দেখা যায়, আইনজীবী এম এ মালেক যে জায়গায় ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন, তার বেশির ভাগ জমিই সোহাগের।

অভিযোগ যুদ্ধাপরাধেরও : আমাদের গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গাজীপুর জজকোর্টের আইনজীবী এম এ মালেকের বিরুদ্ধে গত সোমবার গোপালগঞ্জ অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে মামলা (নম্বর ২৯৩/২০১০) করা হয়েছে। এতে ১৯৭১ সালের ১৪ জুন কোটালীপাড়া থানার হরিণাহাটি-মধুরনাগ্রা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা ইব্রাহিম খানকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়।
গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া থানার চামুরখী গ্রামের বাসিন্দা মো. রতন খান মামলাটি করেন। মামলায় বলা হয়, বাদীর চাচা মুক্তিযোদ্ধা মো. ইব্রাহিম খাঁ ১৯৭১ সালে হেমায়েত বাহিনীর অধীনে লড়াই করেন। একাত্তরের ১৪ জুন গভীর রাতে মালেক দাইয়ের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনীর একটি দল ইব্রাহিম খাঁকে হরিণাহাটি গ্রাম থেকে ধরে নিয়ে যায়। পরে রাজাকাররা তাঁকে গুলি করে এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। এম এ মালেক কোটালীপাড়ার উলাহাটির প্রয়াত আব্দুল গফুর দাইয়ের ছেলে।

জানা যায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিন বীর বিক্রমের বাহিনী আরো অনেক রাজাকারের সঙ্গে মালেক দাইকেও অস্ত্রসহ আটক করেছিল। তবে পরে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে এম এ মালেক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে আনা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ মিথ্যা। আমাকে হেমায়েত সাহেব অস্ত্রসহ আটক করেননি।' যুদ্ধের সময় আপনার ভূমিকা কী ছিল_এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমি মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম।' তবে কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন, সেটা তিনি বলতে পারেননি।

যোগাযোগ করা হলে মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিন বীর বিক্রম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মালেক দাই শুধু রাজাকারই নয়, সে নারী নির্যাতনকারী ও লুটপাটকারীও ছিল। তার সাহসের পুরস্কার দিতে পাকিস্তানি বাহিনী তাকে আলবদর বাহিনীরও সদস্য বানায়।' হেমায়েত উদ্দিন জানান, তাঁর বাহিনী ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জের ঘাঘর থানা ক্যাম্প থেকে মালেক দাইকে আটক করে। 'এ রকম একজন যুদ্ধাপরাধীকে গাজীপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সাপোর্ট করা ঠিক হয়নি' বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

গাজীপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. আবদুস সোবহান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সোহাগের পক্ষে আইনজীবী দাঁড়ানোর ব্যাপারে সমিতির কোনো লিখিত বাধা নেই। মালেক মিয়া যুদ্ধাপরাধী কি না, সে ব্যাপারে আমাদের কাছে লিখিত কোনো ডকুমেন্ট নেই।' সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, 'স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মালেক মিয়ার বয়স কত ছিল যে তাঁকে আপনারা রাজাকার বলছেন?'

এ ব্যাপারে এম এ মালেক জানিয়েছেন, তিনি ১৯৬৪ সালে এসএসসি পাস করেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ২৫-২৬ ছিলো।

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন