16 July 2010

মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ চলছে: জঙ্গি হামলায় জামায়াতের হাত

নিজস্ব প্রতিবেদক


'মুখে ইসলামী শাসনের কথা বলেন! ইসলামের কোথায় সুদের কথা বলা আছে? কিন্তু আপনি সুদ নিতে ও দিতে উৎসাহিত করেছেন। সরকারের শিল্প ও কৃষিমন্ত্রী থাকাকালে আপনি কি একবারের জন্যও সুদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন? এর পরও বলবেন আপনি ইসলামী শাসনের পক্ষে?'
মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদের সময় এভাবেই জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীকে ঘায়েল করলেন জেএমবির আমির সাইদুর রহমান। মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে জেএমবির সাইদুর, জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ ও নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

এদিকে গোয়েন্দা পুলিশের শীর্ষ এক কর্মকর্তা গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, দু-এক দিনের মধ্যে পুলিশের ওপর জঙ্গি হামলার ঘটনায় কদমতলী থানায় দায়েরকৃত মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার দেখাতে আদালতে আবেদন করা হবে। এ ছাড়া গত ২৩ মে দয়াগঞ্জ মোড়ে পুলিশের ওপর আরেকটি জঙ্গি হামলার ঘটনায় আসামি হবেন জামায়াত নেতারা। জঙ্গিদের এসব হামলার ঘটনায় জামায়াত নেতাদের সম্পৃক্ততা মিলেছে। জেএমবি-জামায়াত কানেকশন নিশ্চিত হওয়ার পরই এ সিদ্বান্ত নেওয়া হচ্ছে।

জামায়াত নেতারা যে জেএমবি জঙ্গিদের মদদদাতা, তা অনেকাংশে পরিষ্কার। এর অনেক তথ্যপ্রমাণও তাদের হাতে আছে। নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী ছাড়াও জঙ্গি ঘটনায় কামারুজ্জামান আসামি হবেন। জামায়াত বা অন্য কারো নাম এলে তাঁদেরও আসামি করা হবে। এ ছাড়া বগুড়া থেকে গ্রেপ্তারকৃত জেএমবির আরেক নেতা ভাগ্নে শহীদকেও জামায়াত নেতাদের মুখোমুখি করা হতে পারে।

অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের সময় পল্লবীর দুয়ারিপাড়ায় আলোকদি গ্রামে গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগি্নসংযোগের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটির তদন্ত এবং আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ১০ সদস্যের বিশেষ একটি সেল গঠন করেছে। রিমান্ডে থাকা দুই আসামি জামায়াত নেতা কাদের মোল্লা ও কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতাও পাওয়া গেছে বলে সিআইডি সূত্র দাবি করেছে।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার শেখ মো. মারুফ হাসান কালের কণ্ঠকে জানান, গ্রেপ্তারকৃত কাদের মোল্লা ও কামারুজ্জামানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।

জেএমবি ও জামায়াত নেতাদের মুখোমুখি : পুলিশের সূত্র জানায়, জামায়াত নেতাদের সঙ্গে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদে সাইদুর চাঞ্চল্যকর আরো অনেক তথ্য ফাঁস করেছেন। বুধবার রাতে একপর্যায়ে নিজামী সাইদুরকে উদ্দেশে করে বলেন, 'আপনি বোমা মেরে ইসলামী আন্দোলনের ক্ষতি করেছেন।' তা শুনে সাইদুর বলেন, 'এসব বলবেন না। ২০০৬ সালে আল-ফালাহ গলিতে ডেকে এনেছিলেন কেন? আপনার স্বাক্ষরিত চিঠি পেয়ে আল-ফালাহ গলিতে এসেছিলাম। জামায়াতের সিদ্ধান্তেই জেএমবির আমির হয়েছিলাম। তা কি ভুলে গেছেন?'

এসব শুনে মতিউর রহমান নিজামী চুপ মেরে যান। এ সময় জিজ্ঞাসাবাদকারীরা নিজামীর কাছে সাইদুরের দেওয়া এই বক্তব্যের সত্যতা জানতে চান। নিজামী বলেন, এসব কিছুই তাঁর মনে নেই। জিজ্ঞাসাবাদকারীরা তখন বলেন, 'ঠিক আছে স্যার, মনে পড়লে পরে শোনা যাবে।'

জিজ্ঞাসাবাদকারীরা এ পর্যায়ে বলেন, মন্ত্রী তো মুজাহিদ সাহেবও ছিলেন। তখন সাইদুর মুজাহিদকে উদ্দেশে করে বলেন, 'আপনি তো সমাজকল্যাণমন্ত্রী ছিলেন। দেশের পতিতালয়গুলো আপনার অধীনে ছিল। আপনি তো একবারের জন্যও এসব অনৈতিক কাজের প্রতিবাদ করেননি। তাহলে আপনি কিসের ইসলামী আন্দোলনের নেতা!'

এসব শুনে চুপ মেরে যান মুজাহিদ। জিজ্ঞাসাবাদকারীরা বলেন, স্যার, সাইদুর সাহেব কী বলছেন! তখন মুজাহিদ বলেন, এটা দীর্ঘদিনের একটা সমস্যা। এটা তো একার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এ সময় সাইদুর বলেন, "আপনি একবারের জন্য উদ্যোগ বা মন্ত্রিসভার বৈঠকে কি তুলেছিলেন? না পারলেও চেষ্টা তো করতে পারতেন? এসব 'জেনাহ' ঘটনার কোনো দায় আপনি এড়াতে পারেন না। ইসলাম ও কোরআন-হাদিসের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলে আপনি মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিতেন। কিন্তু তা করেননি। আপনাকে কিভাবে ইসলামী আন্দোলনের নেতা বলব?" এ সময় মুজাহিদ ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, 'সাইদুর, বেশি বাড়াবাড়ি করিয়ো না। তোমাকেও আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইয়ের পরিণতি বরণ করতে হবে।' সাইদুর বলেন, 'তা তো হবেই। আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইয়ের পরিণতির জন্য তো আপনারাই দায়ী। জেএমবির কি সব জেলায় নেটওয়ার্ক ছিল নাকি যে তারা দেশব্যাপী বোমা হামলা করবে? আপনাদের নির্দেশ ও সহযোগিতা ছাড়া ১৭ আগস্টের সিরিজ বোমা কখনোই সম্ভব হতো না।'

এসব শুনে মুজাহিদ আর কোনো কথা বলেননি।

পল্লবীর গণহত্যা : মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যার অভিযোগে পল্লবী থানায় দায়েরকৃত মামলায় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার পাঁচ দিনের রিমান্ডের গতকাল ছিল প্রথম দিন। সিআইডি সূত্র জানায়, এই মামলায় তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মতিউর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত বিশেষ সেল তাঁদের টানা জিজ্ঞাসাবাদ করছে। মামলার তদন্ত নিয়ে সিআইডি গতকাল বিকেলে মালিবাগ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনও করেছে। মামলার তদারকি কর্মকর্তা শেখ মারুফ জানান, গুরুত্বপূর্ণ এই মামলাটি সতর্কতার সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে মামলার বাদী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন মোল্লার সঙ্গে কথা হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলা হবে। এ ছাড়া তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছেও অনেক তথ্যপ্রমাণ আছে, যা তদন্তে সহায়ক হবে।

এদিকে জিজ্ঞাসাবাদকারীদের একটি সূত্র জানায়, বুধবার রাত থেকেই কামারুজ্জামান ও কাদের মোল্লাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। এই মামলা ছাড়াও যুদ্ধাপরাধসংক্রান্ত ঘটনার পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়েও জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। কাদের মোল্লা সরাসরি উত্তর দিলেও কামারুজ্জামান উত্তর দিতে চান না। অনেক সময় জিজ্ঞাসাবাদকারীদের পাল্টা প্রশ্ন করেন।

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন