সেলিম জাহিদ
পাঁচ শীর্ষ নেতার মুক্তি ও দলের বিপর্যয় উতরানোর পথ নিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দোটানায় ভুগছে। কোন পথে, কিভাবে এগোলে পরিস্থিতি অনুকূল আসবে_তা নিয়ে বিস্তর আলোচনার পরও দলটির নীতিনির্ধারকরা কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। এ অবস্থায় জামায়াত সরকারের চূড়ান্ত অবস্থান দেখার কৌশল নিয়েছে।
নিজামী, সাঈদী, মুজাহিদের পর গতকাল বিকেলে গ্রেপ্তার হয়েছেন দলের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা। এই দুই নেতার গ্রেপ্তারের বিষয়ে আগেই আভাস পাওয়ায় দলটির নীতিনির্ধারকরা হতচকিত হলেও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হননি।
কামারুজ্জামান ও কাদের মোল্লার গ্রেপ্তারের পর দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, 'সরকার তো ঘোষণা দিয়েই এসব করছে। এক মন্ত্রী বলেছেন, জামায়াত-শিবিরকে পেটাও, আরেক মন্ত্রী বলেছেন, তাদের রাজনীতিই শেষ করে দিতে হবে।'
মুজিবুর রহমান বলেন, 'ওরা ধরবে, ধরুক। ধরে নিয়ে কী করবে। আমাদের আল্লাহ আছে, আমরা হতাশ নই।' রাতে বৈঠকে বসে দলের করণীয় ঠিক করবেন বলে জানান তিনি।
সার্বিক পরিস্থিতিতে দলের অনুসারীদের বড় একটি অংশ কঠোর কর্মসূচি নিয়ে এখনই মাঠে নামতে প্রস্তুত। তবে নীতিনির্ধারকরা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে চান ঠাণ্ডা মাথায়। এখনই শক্তি ক্ষয় না করে তাঁরা সরকারের বাকি মেয়াদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে লম্বা কর্মসূচির পরামর্শ দিচ্ছেন। গ্রেপ্তার হওয়া নেতাদের অনুসারীরা মনে করছেন, সরকার ধরপাকড় ও নির্যাতন করে ধীরে ধীরে যেভাবে দলের শক্তি ক্ষয় করে দিচ্ছে, তাতে এভাবে কিছুদিন চললে কর্মীদের আর মাঠে আনা যাবে না।
পল্টন থানার আমির ও সাবেক শিবির সভাপতি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, 'লোকজন কঠোর কর্মসূচি চাচ্ছে, নেতারা চাচ্ছেন ধীরে-সুস্থে। ফলে নেতা-কর্মীদের চিন্তার মধ্যে কিছুটা দোটানা তো আছেই।' ড. মাসুদকে জামায়াতের স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্মের উদীয়মান নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
গত ২৯ জুন দলের আমির মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে গ্রেপ্তার করার পর এই ইস্যুতে বিক্ষোভ করতে গিয়ে এ পর্যন্ত সারা দেশে ৮৫০ নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে গতকাল দুই নেতার গ্রেপ্তারের আগে ও পরে এ বিষয়ে জোরালো কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। এত বড় বিপর্যয়ের পরও দলটির নেতা-কর্মীরা এখন পর্যন্ত নীরব। ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন হিসেবে জামায়াত-শিবিরের যে প্রতিক্রিয়া দেখানোর কথা, তা দেখা যায়নি।
খেলাফত মজলিশের কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক সম্পাদক মাওলানা রুহুল আমিন সাদী বলেন, 'নাগরিকত্ব মামলায় গোলাম আযম ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নিজামী-মুজাহিদ গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামায়াত তাৎক্ষণিক যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল, এবার পাঁচ শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তারের পরও তা দেখা যায়নি। ব্যাপারটি পরিষ্কার নয়।'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, 'আমরা পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধে নামতে চাচ্ছি না। সময় হলে একসঙ্গে লোকজন নামবে। আমরা এখন শক্তি সঞ্চয় করছি।'
শীর্ষ নেতাদের মুক্তি আন্দোলন নিয়ে জামায়াত-শিবিরের তৃণমূল পর্যায়েও নানা প্রশ্ন। সাধারণ মানুষও জানতে চাচ্ছে, জামায়াত-শিবির আসলে কী করছে। তাদের এই নীরবতায় 'নাশকতার' পরিকল্পনাসহ নানা আশঙ্কা ডালপালা মেলছে। সরকারের পক্ষ থেকেও জামায়াত-শিবিরের যেকোনো নাশকতা চেষ্টার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জামায়াতের উচ্চপর্যায় থেকে সারা দেশের সব পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সর্বোচ্চ সতর্কতা ও সংগঠিত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ডাক এলেই মাঠে নামার জন্য প্রস্তুত থাকারও নির্দেশনা রয়েছে।
নাশকতার বিষয়ে প্রশ্ন করলে এ টি এম আজহার বলেন, 'সভা-সমাবেশ পণ্ড ও নেতাদের গ্রেপ্তার করে সরকার নিজেই সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে, আবার জামায়াতের বিরুদ্ধে নাশকতা পরিকল্পনার কথাও বলছে। যারা নিজেরাই সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে, তাদের মুুখে অন্যের বিরুদ্ধে নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগ মানায় না।'
জানা গেছে, যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াত নেতাদের জড়ানের পর সর্বশেষ পরিণতি দেখে তার পরই জামায়াত কঠিন সিদ্ধান্ত নেবে। এ ক্ষেত্রে তারা তাদের প্রধান রাজনৈতিক মিত্র বিএনপির সহযোগিতা চাইবে। সহযোগিতা পেলে কর্মসূচি একরকম, দায়সারা সমর্থন দেখালে কৌশল হবে আরেক রকম।
জামায়াতদলীয় সংসদ সদস্য ও দলের ঢাকা মহানগর সেক্রেটারি হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, 'কৌশলগত কারণেই আমরা কঠোর কর্মসূচি দিচ্ছি না।' সুইচ ওপেন না করাই ভালো, 'যদি বাঁধ রক্ষা করা না যায়' মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'আমরা ঠাণ্ডা মাথায় এগোচ্ছি।'
আলাপ-আলোচনায় জানা গেছে, জামায়াতের সর্বস্তরের নেতৃত্ব এখনই সরকার পতন আন্দোলনে যেতে এক পায়ে খাড়া; কিন্তু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে তাঁরা সেদিকে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। তাঁরা মনে করছেন, জঙ্গিবাদের সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক নিয়ে এত দিন যে প্রচারণা ছিল, এখন মারমুখো আচরণ করলে সরকার তা প্রমাণ করে ছাড়বে।
সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি দূতাবাসগুলো জামায়াতের কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। পাঁচ নেতার গ্রেপ্তার ও সরকারের যুদ্ধাপরাধের বিচার আয়োজনের প্রেক্ষাপটে দলটি কোন পথে এগোচ্ছে, তার ওপর সূক্ষ্ম দৃষ্টি রাখছে দূতাবাসগুলো।
দলের ঢাকা মহানগর শাখার সহকারী সেক্রেটারি মাওলানা আবদুল হালিম এমন আশঙ্কার কথা স্বীকার করে বলেন, 'সরকার কী চাচ্ছে আমরা বুঝতে পেরেছি। এ জন্য পাঁচ নেতার মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ ছাড়া মাঠে শক্ত কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে না।'
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে দলের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সবকিছুর একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া আছে। আমরা সেভাবেই এগোচ্ছি। আন্দোলন নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিকভাবে চলবে, আইনি লড়াইও চলবে। আমরা সরকারের পাতা ফাঁদে পা দিতে চাই না।'
সরকারের ফাঁদটা কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'সরকারের মন্ত্রীরাই বলছেন, জামায়াত কিছুই করতে পারল না। এর মানে তারা উসকানি দিচ্ছে।'
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন