14 July 2010

ধরা পড়ল জেএমবির বর্তমান প্রধান ভাগ্নে শহীদ, পাঁচ সহযোগী আটক

লিমন বাসার, বগুড়া

নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা'আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সাংগঠনিক প্রধান আনোয়ার আলম খোকা ওরফে ভাগ্নে শহীদ, রাজশাহী বিভাগের প্রধান শফিকুল ইসলাম ওরফে জামাই রফিকসহ মোট ছয়জন নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ভাগ্নে শহীদ পুলিশকে জানিয়েছে, সারা দেশে নতুন করে তারা দল গোছানো শুরু করেছিল। এ ছাড়া জেএমবির শক্তি জানান দিতে এবং সরকারকে হুঁশিয়ার করে দিতে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ১২ জনের তালিকা তৈরি করে তাঁদের হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
বগুড়া ও গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় সোমবার সন্ধ্যা থেকে গতকাল মঙ্গলবার ভোররাত পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে পুলিশ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে। তাদের কাছে বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্র, উচ্চ ক্ষমতার বিস্ফোরক ও দেশি অস্ত্র পাওয়া গেছে।

বগুড়ার পুলিশ সুপার হুমায়ন কবির কালের কণ্ঠকে জানান, জেএমবির প্রধান মাওলানা সাইদুর রহমান গ্রেপ্তার হওয়ার পর দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড ভাগ্নে শহীদ সংগঠন পরিচালনার দায়িত্ব পায়। এরপর থেকেই সে সংগঠন গোছানোর কাজ শুরু করে। ভাগ্নে শহীদ পুলিশকে জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে তারা দেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ১২ জনের 'হিটলিস্ট' তৈরি করে পর্যায়ক্রমে তাঁদের হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল। এতে করে সরকার জেএমবির সক্ষমতা সম্পর্কে বুঝতে পারবে এবং সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ওপর অত্যাচার বন্ধ হবে। পুলিশ সুপার তদন্তের স্বার্থে জেএমবির হিটলিস্টে থাকা ১২ জনের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। তিনি জানান, জেএমবির জঙ্গিরা এখন উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় আস্তানা গেড়েছে। সেখানে থেকেই এখন সারা দেশে সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

বগুড়া পুলিশ গতকাল প্রেস ব্রিফিংয়ে জানায়, পুলিশ সদর দপ্তরের বিশেষ গোয়েন্দা শাখা ও বগুড়া জেলা পুলিশের যৌথ অভিযান চালিয়ে সোমবার সন্ধ্যায় বগুড়া শহরের সিলিমপুর মহাসড়ক থেকে জেএমবির সাংগঠনকে প্রধান ভাগ্নে শহীদকে (৩০) গ্রেপ্তার করে। শহীদ ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরের আবদুল কাইয়ুমের ছেলে। ঢাকা থেকে বাসে চড়ে সে দিনাজপুর যাচ্ছিল।

সাদা পোশাকের পুলিশদল ভাগ্নে শহীদকে গ্রেপ্তার করার সময় সে লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরে ছিল। কোমরে ছিল একটি রিভলবার ও তিনটি গুলি। এরপর রাতে ভাগ্নে শহীদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার প্রধানপাড়া এলাকার একটি বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয় জেএমবির উত্তরাঞ্চলের প্রধান শফিকুল ইসলাম ওরফে জামাই রফিককে (২৮)। সে ঠাকুরগাঁওয়ের লক্ষ্মীপুর গ্রামের আবদুস সালামের ছেলে। একই সঙ্গে গ্রেপ্তার হয় গাইবান্ধা জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত জয়পুরহাটের রাংতা গ্রামের হায়দার আলীর ছেলে গিয়াস ওরফে রাসেল (২৫), এহসার সদস্য রাজশাহীর বাঘার আবদুল মান্নানের ছেলে শাকিল (২২), এহসার সদস্য বগুড়ার শিবগঞ্জের আবদুল মজিদ (৫০) এবং আনোয়ার হোসেন ওরফে আর্মি আনোয়ার (৪৮)।

জঙ্গিদের আস্তানা থেকে উদ্ধার করা হয় কয়েক কেজি উচ্চ ক্ষমতার বিস্ফোরক, কয়েক শ জিহাদি বই, ধারালো অস্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্র ও টাইম বোমা তৈরির সরঞ্জাম। গতকাল পর্যন্ত এসব মালের জব্দ তালিকা তৈরি না হওয়ায় পুরো হিসাব পুলিশ জানাতে পারেনি।

পুলিশ সুপার হুমায়ন কবির জানান, ঢাকা থেকে পুলিশের মহাপরিদর্শক নুর মোহাম্মদ সরাসরি অভিযানের তত্ত্বাবধান করেন। পুলিশের বিশেষ সেলে ভাগ্নে শহীদ এবং অন্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পুলিশ সুপার জানান, ভাগ্নে শহীদের সহযোগী হিসেবে গ্রেপ্তার হওয়া আবদুল মজিদ ও আর্মি আনোয়ার নতুন মুখ। তাদের বিষয়ে পুলিশের কাছে কোনো রেকর্ড নেই। বগুড়াসহ কয়েকটি জেলার মাঠপর্যায়ের জেএমবি সদস্য এবং দাতা সদস্যদের কাছে থেকে অর্থ সংগ্রহ করার দায়িত্ব ছিল এ দুজনের ওপর।

শিবিরকর্মী থেকে জেএমবিপ্রধান
মাঝারি গড়নের যুবক ভাগ্নে শহীদ ছিল বাংলা ভাইয়ের দেহরক্ষী। বগুড়া পুলিশের দেওয়া তথ্য ও কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছাত্রজীবনে শহীদ ছিল ছাত্রশিবিরের একনিষ্ঠ কর্মী। ১৯৯৮ সালের দিকে শিবিরের ক্যাডার হিসেবে সবাই তাকে চিনত। এরপর মামা তরিকুল ইসলামের (বর্তমানে ভারতে পলায়নরত) আহ্বানে জেএমবিতে যোগ দেয় শহীদ। তরিকুল ছিল ঠাকুরগাঁও জেলার জেএমবির প্রধান। জঙ্গিদলে যোগ দিয়ে আরো দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠে শহীদ।

২০০১ সালের আগস্টে জেএমবির এহসার সদস্য করে শহীদকে লালমনিরহাট জেলায় জেএমবির কর্মকাণ্ড পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০০২ সালে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে বোমাসহ জেএমবির দুজন এহসার সদস্য ধরা পড়লে দলের শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠক হয়। বাংলা ভাইয়ের উপস্থিতিতে দিনাজপুরে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সারা দেশের ১৫ জনকে নিয়ে ইসাবা (নীতি নির্ধারণ) কমিটি করা হয়। যৌথভাবে সেই ইসাবা কমিটির প্রধান হয় বাংলা ভাই ও ভাগ্নে শহীদ। এর আগে শহীদ ছিল বাংলা ভাইয়ের দেহরক্ষী।

২০০৪ সালে ভাগ্নে শহীদকে কিশোরগঞ্জ জেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর জেএমবিপ্রধান শায়খ আবদুর রহমান এবং বাংলা ভাইসহ অন্য শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার ও ফাঁসি দেওয়ার পর ভেঙে পড়ে জেএমবির সাংগঠনিক শক্তি। গা-ঢাকা দিতে ভাগ্নে শহীদ চলে যায় ঢাকায়। ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের একটি হোটেলে সে বয়ের কাজ করে একটানা আড়াই বছর। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে ২০০৭ সালে ভাগ্নে শহীদ রংপুর ও দিনাজপুর জেলার দায়িত্ব পায়। তখন জেএমবিপ্রধানের দায়িত্বে ছিল মাওলানা সাইদুর।

২০০৮ সালের অক্টোবরে উত্তরাঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত জেএমবি নেতা জাহাঙ্গীর পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলে উত্তরাঞ্চলের দায়িত্ব পড়ে ভাগ্নে শহীদের কাঁধে। এরপর গত বছর জেএমবির উচ্চপর্যায়ের চারজনকে নিয়ে গঠন করা হয় শুরা কমিটি। সেখানে মাওলানা সাইদুরের সঙ্গে দলের সেকেন্ড ইন কমান্ডের দায়িত্ব পায় ভাগ্নে শহীদ। চারজনের কমিটির অন্য সদস্যরা হলো_চট্টগ্রাম ও সিলেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত আশরাফ (বর্তমানে জেলে), ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সোহেল মাহবুব (বর্তমানে ভারতে), খুলনা ও বরিশালের দায়িত্বপ্রাপ্ত আবির উদ্দিন (বর্তমানে জেলে)।

পুলিশ জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে ভাগ্নে শহীদ ভারতে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা স্বীকার করেছে। ঘরে বসেই বন্দুক, পিস্তলের গুলি ও উচ্চ ক্ষমতার বোমা তৈরি করতে পারে সে। শহীদের বাড়ি ঠাকুরগাঁও হলেও সে সব সময় অবস্থান করত দিনাজপুরের সীমান্ত এলাকায়। তার স্ত্রীর তিনজন। প্রথম স্ত্রী সাবিনা আঁখি ও দ্বিতীয় স্ত্রী বদরুন নাহারের বাড়ি জয়পুরহাটে। তৃতীয় স্ত্রী সুমির বাড়ি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে। ভাগ্নে শহীদের বিরুদ্ধে পাবনার চাটমোহরে গ্রামীণ ব্যাংকে ডাকাতি, টাঙ্গাইলের বাসাইলে ব্র্যাক অফিসে ডাকাতি, অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে হত্যাচেষ্টা, জয়পুরহাটের ক্ষেতলালের মহেষপুরে পুলিশের ওপর হামলা করে অস্ত্র লুট করাসহ বিভিন্ন অভিযোগে সারা দেশে অর্ধশতাধিক মামলা রয়েছে।

জয়পুরহাটে পাঁচজন গ্রেপ্তার
জয়পুরহাট প্রতিনিধি জানান, জপুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলায় সন্দেহভাজন পাঁচ জেএমবি সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। জেএমবির পলাতক সদস্য সিরাজুল ইসলামের বাড়িতে গত সোমবার সন্ধ্যায় বৈঠক করার সময় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ইরাক যুদ্ধের একটি সিডি, ল্যাপটপ, ডিজিটাল ক্যামেরা, ছয়টি মোবাইল ফোনসেট ও ১০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়েছে।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলো_ঢাকার সূত্রাপুর থানার নারিন্দা রোডের তানভির হোসেন আদনান, একই থানার ৩৮ বানিয়ানগর এলাকার আল-মামুন স্বপন, নারিন্দা রোডের গোলাম মাহবুব, গেণ্ডারিয়া থানার ১০২ সরদনগর গুপ্ত রোডের লুৎফর রহমান এবং কোতোয়ালি থানার তাঁতীবাজারের ৩৯ সুতারনগর এলাকার রিয়াজ উদ্দিন।

পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তারকৃতরা পাঁচবিবির তাজপুর গ্রামে জেএমবি সদস্য ও পুলিশের তালিকাভুক্ত আসামি সিরাজুল ইসলামের বাড়িতে বৈঠক করছিল। খবর পেয়ে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে। তবে অভিযান চলাকালে সিরাজুল ইসলাম ও তার সহযোগী আবদুস শুকুর পালিয়ে যায়। পুলিশের ধারণা, তারা সেখানে কোনো নাশকতার পরিকল্পনা করছিল।

জেলার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার মাশরুকুর রহমান খালিদ জানান, এ ঘটনায় পাঁচবিবি থানায় একটি মামলা করা হয়েছে।

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন