9 July 2010

সন্দেহভাজন ২৫ যুদ্ধাপরাধীর পাসপোর্ট জব্দ প্রক্রিয়া শুরু: বিদেশি দূতাবাসগুলোতে ছবি ও পাসপোর্ট নম্বরসহ তালিকা পাঠানো হয়েছে

উম্মুল ওয়ারা সুইটি ও প্রতীক ইজাজ

জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমসহ সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধীদের পাসপোর্ট জব্দ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাঁরা যেন বিদেশ যেতে বা বহির্বিশ্বের সঙ্গে লবিং করতে না পারেন, সে জন্য কড়া নজরদারি আরোপ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ঢাকায় বিভিন্ন দেশের দূতাবাসগুলোতে সন্দেহভাজনদের ছবি, পাসপোর্ট নম্বরসহ তালিকা পাঠানো হয়েছে। এসব ব্যক্তিকে কোনোভাবেই যেন ভিসা দেওয়া না হয়, সে ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা করার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠানোরও সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রে জানা গেছে।

এরই মধ্যে সরকার ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকার ভিত্তিতে ২৫ জন সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধীর চলাচলের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।

সূত্রমতে, গত ২৬ জুন কালের কণ্ঠে গোলাম আযমের লন্ডন যাওয়া সম্পর্কিত সংবাদ প্রকাশের পরই বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নজরে আসে। মন্ত্রণালয় থেকে লন্ডনের বাংলাদেশ দূতাবাসের কাছে জানতে চাওয়া হয়, গোলাম আযমের ভিসা পাওয়ার প্রসঙ্গটি কোন পর্যায়ে রয়েছে। মন্ত্রণালয়কে সেখান থেকে জানানো হয়, দুই বছর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যুক্তরাজ্যে যাওয়ার জন্য গোলাম আযমের আবেদন নাকচ করা হয়। এরপর যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী গোলাম আযমের ছেলে ও পরিবারের পক্ষ থেকে এ নিয়ে আদালতে আপিল করা হয়। সম্প্রতি ওই আপিলের রায় গোলাম আযমের পক্ষে যায়। এর ভিত্তিতে তাঁর ভিসা করানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

পাসপোর্ট অফিসের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, গোলাম আযমের দেশত্যাগ সম্পর্কে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর তাদের কাছে তাঁর পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সন্দেহভাজনদের তালিকা দিয়ে বলা হয়েছে, দেশের সব পাসপোর্ট অফিসে যেন তাঁদের পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়ানো বা নতুন পাসপোর্ট দেওয়ার বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।

ওই সূত্র জানায়, ২০০৮ সালের অক্টোবরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষ থেকে দুর্নীতিবাজ বিবেচিত রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধীর তিনটি তালিকা দেওয়া হয় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে। এসব ব্যক্তি যেন কোনোভাবেই জাল পাসপোর্ট বা পাসপোর্ট নবায়ন করতে না পারে, সে নির্দেশনাও দেওয়া হয়।

ওই সূত্র জানায়, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সেসব নির্দেশনা আর কার্যকর না থাকায় গত বছর থেকে এ পর্যন্ত সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে মতিউর রহমান নিজামী, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ কয়েকজন তাঁদের পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়িয়ে নেন। তবে তাঁরা কেউই অনেকবার চেষ্টা করেও বিদেশে যাওয়ার ভিসা পাননি। ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাস হওয়ার পর বর্তমান সরকার আবারও সন্দেহভাজনদের বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

এদিকে আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, গোলাম আযমের বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়া জানাজানি হওয়ার পর এ নিয়ে সরকার আরো জোর তৎপরতা শুরু করেছে। গত ২৬ জুন সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয় মিলে একটি বিশেষ বৈঠক করে। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সন্দেহভাজনদের ওপর নজরদারি বাড়ানো, তাঁদের পাসপোর্ট জব্দ, বাংলাদেশে অবস্থিত দূতাবাসগুলোকে সহযোগিতা করার অনুরোধ এবং বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকার নির্দেশ জারির।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, তারা বিষয়টি আমলে নিয়ে কাজ শুরু করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত দূতাবাস কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই দূতাবাসগুলোতে এ অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠানো হবে।

পররাষ্ট্রসচিব মিজারুল কায়েস গত সোমবার কালের কণ্ঠকে বলেন, সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধীদের কোনো ধরনের সহযোগিতা না করতে দূতাবাসগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে। নিউইয়র্ক, অটোয়া, লন্ডনসহ মধ্যপ্রাচ্যের বাংলাদেশ মিশনগুলোকে এরই মধ্যে সতর্ক থাকার জন্য বলা হয়েছে। এ ছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে বিশ্বের সমর্থন আদায়ে মন্ত্রণালয় থেকে চেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, 'বিচারের কাজ আমরা অনেকটাই গুছিয়ে এনেছি। সন্দেহভাজনদের বিষয়েও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাঁরা যেন কোনোভাবেই বিদেশ যেতে না পারেন বা বিচারকাজ নষ্ট করতে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র করতে না পারেন, তাও দেখা হচ্ছে। আজও (গতকাল) আমরা এ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ট্রাইব্যুনালের তদন্তকারী সংস্থা ও আইনজীবী প্যানেলের সঙ্গে বৈঠক করেছি।'

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন বলেন, 'সবকিছুই আমাদের নজরে আছে। কে কখন বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছেন, কোথায় ষড়যন্ত্র করছেন_সবকিছুই নজরদারির মধ্যে রয়েছে। আপনারা নিশ্চয় এরই মধ্যে বুঝতে পারছেন, তাঁদের কোনো ষড়যন্ত্রই কাজে লাগছে না। কেউ পালাতে পারবে না।'

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'এর মধ্যে গোলাম আযমসহ সন্দেহভাজন কয়েকজনের পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে। তাঁদের ছবিসহ একটি তালিকা সংশ্লিষ্ট সব স্থানে পেঁৗছে দেওয়া হয়েছে। সবার গতিবিধির ওপর মনিটরিং আছে। গোলাম আযমকে গত পাঁচ মাস থেকেই নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। দেশ থেকে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে তিনি যুক্তরাজ্য থেকে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি কোনোভাবেই যেতে পারবেন না।'

গতকাল বৃহস্পতিবার গোলাম আযমের মগবাজারের বাসায় বারবার টেলিফোন করেও তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। সকালে তাঁর বাড়ির আশপাশের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, গোলাম আযম বেশির ভাগ সময় বাড়িতেই থাকেন। খুব একটা বের হন না। ১০ দিন ধরে এ এলাকায় গণমাধ্যম কর্মীদের আনাগোনা বেড়েছে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান। হাফিজ উদ্দিন নামের একজন বলেন, 'ইদানীং গোলাম আযমের বাড়ির সামনে এবং আমাদের এলাকায় অনেক অপরিচিত লোককে দেখা যায়। সবাই ধারণা করছে, তাঁরা বিশেষ কোনো সংস্থার সদস্য হবেন।' তিনি আরো জানান, মতিউর রহমান নিজামীসহ তিন জামায়াত নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে এলাকায় গুজব রয়েছে, গোলাম আযমও গ্রেপ্তার হতে পারেন। তাঁকে মসজিদে নামাজ পড়তে যেতে দেখা যায়। তবে তাঁকে দেখে এখন বেশ অসুস্থ মনে হয়।

সন্দেহভাজনদের তালিকা : জানা গেছে, নজরদারিতে থাকা ২৫ জন সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে আছেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম, জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির মাওলানা আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসুফ, নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুস সোবহান, নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, নায়েবে আমির আব্দুল কাদের মোল্লা, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, সিলেট দক্ষিণ জেলা জামায়াতের আমির ও কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য মাওলানা হাবিবুর রহমান, এ বি এম খালেক মজুমদার, জামায়াতের নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাশেম আলী, কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর আমির রফিকুল ইসলাম খান, প্রিন্সিপাল শাহ মোহাম্মদ রুহল কুদ্দুস, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও সাবেক এমপি মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী, জামায়াতের চট্টগ্রাম মহানগর আমির মাওলানা শামসুল ইসলাম, আবুল কালাম আজাদ বা বাচ্চু রাজাকার, জামায়াতের সাবেক আমির আফতাব উদ্দিন মোল্লা, গাইবান্ধা জেলা জামায়াতের সাবেক আমির আবু সালেহ মোহাম্মদ আজিজ (ঘোড়া আজিজ)।

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠনগুলোর তৎপরতা : একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে আবারও পথে নেমেছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সংগঠনগুলো। এসব সংগঠনের পক্ষ থেকে যুদ্ধাপরাধের বিচারে ধীরগতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব মানুষকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। সংগঠন নেতারা বলেছেন, বিচার নিশ্চিত করতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। যুদ্ধাপরাধের বিচার নস্যাৎ করতে অপরাধীরা দেশে ও দেশের বাইরে নানা অপচেষ্টায় লিপ্ত। সরকারকে আরো কৌশলী হতে হবে।

যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনালকে সর্বাত্দক সহযোগিতার জন্য ইতিমধ্যে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করেছে 'ট্রাইব্যুনাল সহায়ক মঞ্চ'। মঞ্চের আহ্বায়ক শাহরিয়ার কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, 'যুদ্ধাপরাধের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে পারে_এমন তৎপরতা প্রতিরোধে জনমত গঠন ও আইনি সহায়তা পেতে দেশে-বিদেশে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে অনেক খ্যাতিমান আইনজীবী যুদ্ধাপরাধের বিচারে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।'

মঞ্চের পক্ষ থেকে গত বুধবার ট্রাইব্যুনালে শীর্ষ ২৫ যুদ্ধাপরাধীর তালিকা ও তাঁদের যুদ্ধাপরাধসহ একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য-উপাত্ত জমা দেওয়া হয়েছে।

শাহরিয়ার কবির বলেন, 'আমরা সাত মন্ত্রণালয়ে ৯ দফা সুপারিশ জমা দিয়েছি। সুষ্ঠু বিচারে সরকারের উচিত ট্রাইব্যুনালে অন্তত ২৫ জন করে তদন্ত কর্মকর্তা ও আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া এবং বিচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিরাপত্তা বাড়ানো। ট্রাইব্যুনালে একজন উপযুক্ত মুখপাত্র নিয়োগ দিতে হবে। দেশের বিভিন্ন আদালতে দায়ের করা যুদ্ধাপরাধসংক্রান্ত মামলাগুলো ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ারে আনতে হবে সরকারকে।'

দ্রুত বিচার শুরুর দাবি জানিয়েছে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম। ফোরাম সভাপতি ও পরিকল্পনামন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার বীর উত্তম বলেন, 'যুদ্ধাপরাধের বিচারে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বা জাতীয় পর্যায়ে কোনো বাধা নেই। কিন্তু অপরাধীরা নানা অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই সরকারের উচিত আরো কৌশলী হয়ে বিচারপ্রক্রিয়া বিলম্বিত না করে দ্রুত সম্পন্ন করা। কারণ বিচারপ্রক্রিয়া পর্যাপ্ত দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে না। এটা আমাদের কাম্য নয়।' তিনি যুদ্ধাপরাধের বিচার নিশ্চিত করতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তিকে আগের মতো ঐক্যবদ্ধ হয়ে সোচ্চার থাকার আহ্বান জানান।

যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। পার্টির সভাপতি মনজুরুল আহসান খান ও সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, জামায়াতের অনেক নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ থাকার পরও তাঁদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। এ সুযোগে জামায়াত দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির পরিকল্পনা করছে।

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন