সেলিম জাহিদ
বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। জামায়াতের বর্তমান 'বিপদের সময়' বিএনপির 'কার্যত নীরব' ভূমিকাকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিএনপির 'কৌশলী অবস্থান' হিসেবে দেখছেন। কারণ তাঁদের হিসেবে, সরকারের কঠোর মনোভাবের কারণে এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে জামায়াত আর লাভবান হবে বিএনপি। ভোটের হিসাব-নিকাশ থেকে ইসলামপন্থী ভোটারদের সমর্থন তখন বিএনপির দিকে ঝুঁকবে এবং বিএনপির ভোটব্যাংক সমৃদ্ধ হবে। এই সরল বিশ্লেষণ থেকেই বিএনপির নীতিনির্ধারকদের একটি অংশ মনে করছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারি কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কৌশলী অবস্থান গ্রহণই বিএনপির জন্য রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।
বিষয়টি জামায়াতের পক্ষ থেকে আক্ষেপের সঙ্গে নিয়ে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। জানা গেছে, পরস্পরের আস্থায় চিড় ধরানো পর্যন্ত না গড়ালেও বিষয়টি দুই পক্ষই যার যার মতো করে পর্যবেক্ষণ করছে। তবে এ স্নায়ুযুদ্ধ এখন পর্যন্ত দল দুটির নীতিনির্ধারক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. হাসান মোহাম্মদ মনে করেন, বাহাত্তরের সংবিধান সংশোধিত আকারেও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে ইসলামী দলগুলো অবশ্যই একটা ধাক্কা খাবে এবং এই অংশটির বেশির ভাগ শেষ পর্যন্ত বিএনপির দিকেই ঝুঁকবে। তিনি বলেন, 'বিএনপি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করে না, কিন্তু ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাস করে। আমার বিশ্বাস, এ পরিস্থিতিতে বিএনপি কৌশলী হবে। বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াস ভূমিকায় যাবে না।'
ড. হাসান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত শিক্ষকদের প্যানেল সাদা দলের আহ্বায়ক ছিলেন। তিনি এক দশক আগে 'জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ : নেতৃত্ব, সংগঠন ও আদর্শ' বিষয়ে থিসিস করেন।
জামায়াত নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফজলুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরা নিয়ে বিএনপি বাড়াবাড়ি কিছু করবে না। কারণ স্বাভাবিক প্রবণতায় ভোটের রাজনীতিতে আলটিমেট রেজাল্ট তাদের দিকেই যাবে।' বিএনপিতে এই কৌশল সম্পর্কে বলাবলি হচ্ছে বলে তিনি জানান।
অধ্যাপক ফজলুল হক জামায়াতে ইসলামীর পরামর্শকদের অন্যতম। তিনি জামায়াতের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আমির।
বিএনপির অন্যতম চিন্তাবিদ সাবেক সচিব সাবিহ উদ্দিন আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে কালের কণ্ঠকে তিনি সরাসরি কোনো মন্তব্য না দিয়ে বলেন, 'এ ব্যাপারে আপনি বিএনপি নেতাদের কমেন্টস নিতে পারেন। আমি এ বিষয়ে কথা বলব না।'
কিন্তু বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা জামায়াতের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধের ব্যাপারে মুখ ফুটে কিছু বলতে নারাজ। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বক্তব্য হচ্ছে, জামায়াত কর্মসূচি নিয়ে মাঠে না থাকায় সরকার তাদের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেপ্তারে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। জামায়াত মাঠে তৎপর থাকলে বিএনপি তাতে নৈতিক সমর্থন দেবে।
আর জামায়াতের পক্ষ থেকে বিএনপির সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধের বিষয় স্বীকার না করে বলা হচ্ছে, এ ধরনের চিন্তা জোটে ফাটল ধরানোর চেষ্টা।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগকর্মী ফারুক হোসেন হত্যার পর টানা পাঁচ মাস সরকারি খৰ ঝুলে থাকে জামায়াতের ওপর। তখন থেকে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ এবং সর্বশেষ দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেপ্তারে জামায়াত এখন কার্যত পর্যুদস্ত। আরো বিপর্যস্ত হলে জামায়াতের পেশাজীবী গোষ্ঠী এবং 'মডারেট' গ্রুপকে কৌশলে বিএনপির সঙ্গে একীভূত করার একটি গোপন মিশন নিয়ে বেশ কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও চিকিৎসক কাজ করছেন বলে জানা গেছে।
আরো জানা গেছে, যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতে জামায়াতের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার বিষয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মধ্যেও মতপার্থক্য আছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি, বিএনপির একজন প্রভাবশালী আইনজীবী নেতা যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে দলের স্থায়ী কমিটির প্রথম বৈঠকেই বিএনপির অবস্থান যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষে রাখার প্রস্তাব করেন। পরে ওই নেতা একটি জাতীয় দৈনিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যুদ্ধাপরাধীদের (সম্ভাব্য) আইনি সহায়তা দিতে বিএনপির কোনো দলীয় সিদ্ধান্ত নেই বলে জানান। যদিও বিএনপি চেয়ারপারসন দলের সিনিয়র আইনজীবীদের ডেকে যুদ্ধাপরাধের মামলায় জামায়াত নেতাদের জড়ানো হলে তাঁদের পক্ষে কাজ করার নির্দেশ দেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির ওই নেতার ভূমিকা জানার পর জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা এ প্রতিবেদকের কাছে আক্ষেপ করেছিলেন।
২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী বিএনপি জামায়াতসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে জোট করে আন্দোলন, নির্বাচন ও পরে সরকার গঠন করেছিল। বিগত সংসদ নির্বাচনেও তারা ক্ষমতাসীন মহাজোটের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয়ে অংশ নেয়।
জানা গেছে, বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা, যাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে; তিনি সম্প্রতি দলীয় প্রধানকে আশ্বস্ত করেছেন যে সাংবিধানিকভাবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বাধাপ্রাপ্ত হলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যেসব ইসলামী দলের সম্পর্ক ছিন্ন হবে, বিএনপি তাদের সঙ্গে সহানুভূতিশীল আচরণ করলে জামায়াতসহ সেসব দল বিএনপির দিকেই ঝুঁকবে। চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনের পর দলীয় প্রধানের সবুজ সংকেত পেয়ে তিনি এসব ইসলামী দলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।
চারদলীয় জোটের শরিক দল ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী মনে করেন, ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ হলে আওয়ামী লীগ লাভবান হবে না। তিনি বলেন, 'ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করে আওয়ামী লীগের কী লাভ আমি বুঝি না। এতে বরং বিএনপিরই সুবিধা হবে বেশি।' তাঁর হিসাবে, এতে বিএনপি দলে এবং ভোটে আরো সমৃদ্ধ হবে।
যুদ্ধাপরাধের বিচার সামনে রেখে জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেপ্তারের পর ধারণা করা হচ্ছে, তাঁরা কঠিন পরিণতির দিকেই এগোচ্ছেন। বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যেতে '১৫ সদস্যের সাংবিধানিক কমিটি' গঠনের পর দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী সেই পরিণতির দিকে যাচ্ছে বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে সরকার বাহাত্তরের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলে জামায়াতসহ সব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠন নিষিদ্ধ হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। আর জামায়াতে ইসলামীই দেশের প্রধান ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল।
আওয়ামী লীগের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'জামায়াতের সঙ্গে গলায় গলায় ভাব, আবার রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধ, প্রগতি এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের খোলস গায়ে চড়িয়ে বিএনপি বারবার রাজনৈতিক ফায়দা লুটেছে। সাংবিধানিকভাবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অবসান হলে তাদের ফায়দা লোটার পথ চিরতরে রুদ্ধ হবে।'
এ অবস্থায় যুদ্ধাপরাধের বিচার ও বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরতে সরকারি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিএনপি কার্যত কতটা আন্তরিক এবং মাঠে কী ভূমিকা পালন করে, সেটা বোঝার জন্য জামায়াত বিষয়টি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছে। জামায়াতের বিভিন্ন স্তরে কথা বলে জানা গেছে, যদিও সংবিধান সংশোধনে গঠিত সর্বদলীয় কমিটিতে বিএনপির অংশগ্রহণে অনীহা প্রকারান্তরে জামায়াতের প্রতি সমর্থনই প্রকাশ করে, তার পরও দলীয় রাজনীতির চরম সংকটে বিএনপির দিকে তাকিয়ে আছে জামায়াত। তবে এটাও জানা গেছে, বিএনপি জামায়াতের এই সংকটকে পুঁজি করছে, নাকি ভেতরে ভেতরে অন্য 'কূটনীতি' করছে_তা নিয়ে জামায়াতের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অল্পবিস্তর সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু দলটির নীতিনির্ধারকরা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতে সরকারের প্রচারণা ও জনমত সৃষ্টির তৎপরতা জামায়াতের কর্মীদের যেমন নৈতিকভাবে দুর্বল করছে, তেমনি বিএনপির সঙ্গে দলের দূরত্বও সৃষ্টি হচ্ছে। কারণ দুঃসময়ে বিএনপিকে তারা যেভাবে কাছে পাওয়ার প্রত্যাশা করেছিল, তা না পেয়ে জামায়াতের ভেতরে নানা সংশয় ও বিভক্তির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত দলের সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান বিএনপির সঙ্গে সংযোগ রক্ষায় তৎপর ছিলেন।
শীর্ষস্থানীয় পাঁচ নেতা গ্রেপ্তারের পরও রাজনীতির মাঠে জামায়াতের কার্যকর কোনো কর্মসূচি না থাকায় দলটির মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে একধরনের হতাশা ও ভীতি বিরাজ করছে। মূল নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত নেতৃত্ব সাবধানী আচরণ করছে এবং সাধারণ গোছের কর্মসূচি দিয়ে কর্মীদের চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা বিএনপির সঙ্গে সমন্বয় রেখেই কাজ করছেন বলে দাবি করেন।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও সংসদ সদস্য হামিদুর রহমান আযাদ জামায়াতের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপির ভূমিকা সম্পর্কে নেতিবাচক চিন্তাকে 'দূরভিসন্ধিমূলক' মন্তব্য করে বলেন, 'জোটে ফাটল ধরানোর জন্য কেউ এ ধরনের কথা বলতে পারে।' তাঁর বক্তব্য, 'ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করার ক্ষমতা এ সরকারের নেই। আমরা সে চিন্তা করতেই রাজি না।'
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন