নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকায় ব্যাপক ভাঙচুরের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে আরো ১০২ জন শিবিরকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। রবিবার সারা রাত নগরীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে এদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ নিয়ে গত দুই দিনে মোট ১৪৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হলো। এ ঘটনায় ডবলমুরিং ও হালিশহর থানায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃত শিবিরকর্মীদের গতকাল সোমবার বিকেলে আদালতে হাজির করার পর পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডের আবেদন জানায়। কিন্তু রিমান্ড শুনানি অনুষ্ঠিত না হওয়ায় মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ওসমান গণি তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এদের মধ্যে হালিশহর থানার মামলায় ১৬ জনকে ১০ দিন ও ডবলমুরিং থানার মামলায় ১০৩ জনের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানানো হয়েছিল।
এদিকে পুলিশ প্রশাসন দাবি করছে, জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা এ ধরনের অতর্কিত হামলা চালাতে পারে বলে তারা আগে থেকেই জানত। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও জানানো হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের কাছে তথ্য ছিল, জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা অতর্কিত হামলা চালাতে পারে। সেই অনুযায়ী প্রতিরোধের জন্য আমরা প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম।' তাহলে এই হামলা হলো কী করে_এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমরা চেষ্টা করেছি ওদের প্রতিহত করতে।'
পুলিশ জানায়, হামলার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশের বেশ কয়েকটি দল নগরীর বিভিন্ন স্থানে একযোগে অভিযান শুরু করে। পাড়া-মহল্লায় গিয়ে পুলিশ জামায়াতের কর্মী-সমর্থকদের বাসায় তল্লাশি চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে নিজ নিজ থানায় নিয়ে আসে। পরে ভোররাতের দিকে সবাইকে নিয়ে আসা হয় ডবলমুরিং থানায়। এদের মধ্যে কোতোয়ালি থানা ২০ জন, খুলশী থানা ১০ জন, পাঁচলাইশ থানা দুজন, চান্দগাঁও থানা দুজন, বায়েজীদ থানা তিনজন, হালিশহর থানা আটজন, ডবলমুরিং দুজন, বন্দর থানা ২০ জন, পতেঙ্গা থানা ১০ জন, কর্ণফুলী থানা পাঁচজন, পাহাড়তলী থানা চারজন ও বাঁকলিয়া থানা ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করে। এর আগে রবিবার সন্ধ্যায় ঘটনার পর ডবলমুরিং থানা পুলিশ ১১ ও হালিশহর থানা ৩০ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল।
তবে গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের পাশাপাশি বেশ কয়েকজন নিরীহ লোক রয়েছে বলে জানা গেছে। সোর্সদের ভুল তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে। এ প্রসঙ্গে সিএমপি কমিশনার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'গ্রেপ্তারকৃতদের ব্যাপারে যাছাই-বাছাই চলছে। যদি কেউ নিরীহ থাকে তাহলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে।'
তাণ্ডবের ঘটনায় দুটি মামলা
জামায়াত শিবিরের ভাঙচুর ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনায় গতকাল নগরীর ডবলমুরিং থানার এসআই নাজিম উদ্দিন ও হালিশহর থানায় এসআই জাকির হোসেন বাদী হয়ে পৃথক দুটি মামলা করেছেন। ডবলমুরিং থানার মামলায় ১৫৮ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতনামা ২০০ থেকে ৩০০ জনকে আসামি করা হয়। এ মামলায় ১২ নম্বর পাহাড়তলী সরাইপাড়া ওয়ার্ড জামায়াতের আমির হারুন মিস্ত্রি ও শিবির সভাপতি মোহাম্মদ জাফরকে আসামি করা হয়। দণ্ডবিধির ১৪৮/১৪৭/১৪৯/৩৩২/৩৫৩/৪২৭ ধারাসহ বিস্ফোরক দ্রব্যাদি আইনের ৩ এবং ১৯৭১ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৬(২) ধারায় এ মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ মামলায় বর্তমানে ১০৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আইনুল হক জানান।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই কাজী রাকিব উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'রিমান্ডে আসামিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মূল হোতাদের শনাক্ত করা হবে।' অপরদিকে হালিশহর থানায় দায়ের করা মামলায় সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯-এর ৬/১০/১২/১৩/১১/১৪ ধারা উল্লেখ করা হয়। এ মামলায় এজাহারভুক্ত ১০৮ জন এবং অজ্ঞাতনামা ১০০ থেকে ১৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই এস এম দিদারুল ইসলাম জানান, মামলার তদন্ত চলছে। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, পরিকল্পিতভাবে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা এ তাণ্ডব চালিয়েছে। পরিকল্পনাকারী ও দায়ী ব্যক্তিদের খোঁজা হচ্ছে। তবে তাদের শনাক্ত করা যায়নি এখনো।
থানার বাইরে স্বজনদের ভিড়
রবিবার রাতে নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হওয়া জামায়াত-শিবিরের কর্মী-সমর্থকদের ডবলমুরিং থানায় রাখা হয়। পরদিন সকাল থেকে থানার সামনে তাদের স্বজনরা ভিড় জমায়। তবে নিরাপত্তার জন্য কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গতকাল সকাল থেকে ডবলমুরিং ও হালিশহর থানায় দায়ের করা মামলার এজাহার তদারকি করেছেন। বিকেলে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে দুই মামলার আসামিদের আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। থানা গেটের বাইরে অপেক্ষায় থাকা একাধিক আসামির স্বজন কালের কণ্ঠের কাছে দাবি করেছে, অনেক নিরীহ লোকজনকে ধরে এনে পুলিশ কোর্টে চালান করেছে। ডবলমুরিং থানায় অবস্থানরত চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান মিয়া এ প্রসঙ্গে বলেন, 'কোনো নিরীহ লোককে হয়রানি করা হবে না।'
অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি
নগরীর ছোটপুল এলাকার সমবায় সিঙ্গাপুর মার্কেটের পানির ট্যাঙ্ক থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় একটি এলজি ও সাতটি কার্তুজ উদ্ধারের ঘটনায় ডবলমুরিং থানায় জিডি করা হয়েছে। গত রবিবার রাতে থানার সহকারী উপপুলিশ পরিদর্শক আবদুস সালাম বাদী হয়ে এ জিডি করেন। সিএমপির সহকারী কমিশনার (ডবলমুরিং জোন) এস এম তানভীর আরাফাত কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ভাঙচুর ও হামলা মামলার আসামিদের কাছ থেকে রিমান্ডে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় মামলা করা হবে। এখন জিডি করা হয়েছে।' উল্লেখ্য, রবিবার ভাঙচুরের সময় ঘটনাস্থল থেকে আবু বক্কর নামে এক শিবিরকর্মীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী পরিত্যক্ত অবস্থায় অস্ত্রটি উদ্ধার করা হয়। এ প্রসঙ্গে আবু বক্করের কাছে জানতে চাইলে রবিবার রাতে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, 'গত বৃহস্পতিবার কুমিল্লার দেবীদ্বার থেকে এসেছি। রিকশা থেকে যাত্রী নামিয়ে দাঁড়ালে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।' অস্ত্রটি কে বা কারা রেখেছে তা জানাতে অস্বীকৃতি জানান আবু বক্কর। তিনি দেবীদ্বারের ফরিদ আলীর ছেলে।
উল্লেখ্য, ঢাকায় গ্রেপ্তারকৃত জামায়াতের তিন শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুক্তির দাবিতে গত রবিবার বিকেলে আয়োজিত মিছিল থেকে নগরীর হালিশহর এলাকায় ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়।
ভাঙচুর নিয়ে শিবিরের বিবৃতি
হালিশহর এলাকায় ভাঙচুরের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেছে শিবির নেতারা। এমনকি অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার আবু বক্করকেও তারা চেনে না। গতকাল সোমবার শিবির নেতাদের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে এই দাবি করা হয়। এ ছাড়া এ ঘটনার জন্য তাঁরা পুলিশ ও ছাত্রলীগকে দায়ী করেন।
ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম মহানগরীর উত্তর, দক্ষিণ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তর জেলা ও দক্ষিণ জেলার নেতা আবদুল জব্বার, মিজানুর রহমান, ইসমাইল হোসেন, দেলোয়ার হোসেইন, শামসুদ্দিন আহম্মদ, নূর মোহাম্মদ ও নুরুল হক বিবৃতিতে জানান, হামলা-ভাঙচুর ও অস্ত্রের সঙ্গে শিবিরের নেতা-কর্মীরা জড়িত নয়। পুলিশ প্রকৃত ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সাজানো মামলা দিয়ে শিবিরকর্মীদের ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। গ্রেপ্তারকৃত আবু বক্করকে নিরীহ রিকশাচালক উল্লেখ করে শিবিরের নেতারা জানান, পুলিশ তার হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে নাটক সাজিয়েছে। এসব অপকৌশলের মাধ্যমে শিবিরের অগ্রযাত্রা বন্ধ করা যাবে না।
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন