5 July 2010

নিজামীর রিমান্ড শুরু ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হবে, হুজিসহ ৩৬ সংগঠনকে অর্থসহায়তা দেয় জামায়াত

মাসুদ কার্জন

জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে পুলিশ। নিজামীকে বহুল আলোচিত দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর প্রস্তুতি চলছে। পাশাপাশি জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে 'উত্তরা ষড়যন্ত্র'-এর ঘটনায় দায়েরকৃত রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় (মাহমুদুর রহমানের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠিত গোপন বৈঠক) গ্রেপ্তার দেখানো হবে বলে জানা গেছে। দু-এক দিনের মধ্যে এসব মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তারা জামায়াত নেতাদের গ্রেপ্তারের আবেদন জানাবেন। চট্টগ্রামের দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা এবং এ ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে জামায়াতের আমির নিজামীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে বলে সূত্র জানিয়েছে।

পুলিশ সূত্র জানায়, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে এক মামলায় (মামলা নম্বর-৩৭) জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়েছে। এখন গত ফেব্রুয়ারি মাসে পল্টন এলাকায় রাষ্ট্রপতির গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় (মামলা নম্বর-২০) জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শামসুর রহমান। তবে মতিউর রহমান নিজামীকে প্রথম মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ চলবে। এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পল্টন থানার এসআই জিল্লুর রহমান জানান, আজ (গতকাল) রবিবার বিকেলেই মতিউর রহমান নিজামীকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়েছে। বিকেলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে আনার পরই নিজামীকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হয়। তবে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি।

তার আগে মুজাহিদ ও সাঈদীকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্কের কথা স্বীকার করেছেন তাঁরা। শুধু জেএমবি বা হরকাতুল জিহাদ (হুজি) নয়, ছোট-বড় ৩৬টি ইসলামী সংগঠনকে অর্থ সহায়তা করে তাঁদের দল জামায়াত। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই এসব করে আসছে তাঁদের দল। বিদেশ থেকে আসা অর্থ ছাড়াও দেশের অভ্যন্তরে তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে তাঁদের দল এই সহায়তা করছিল।

আরো জানা গেছে, জেএমবির আমির সাইদুর রহমানের সঙ্গে একই মামলায় আসামি করা হচ্ছে জামায়াতের এই তিন শীর্ষ নেতাকে। গ্রেপ্তারের পর সাইদুরের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন এবং অস্ত্র ও বিস্ফোরক আইনে পৃথক দুটি মামলা হয়েছিল।

একটি সূত্র জানায়, জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে জেএমবি প্রধান সাইদুরের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। মুজাহিদ ও সাঈদীকে পৃথকভাবে জেএমবি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রথমে তাঁরা দুজনই তা চেপে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পরে সাইদুরের ব্যবহৃত মোবাইল সিমের কললিস্ট তাঁদের সামনে তুলে ধরা হয়। গোয়েন্দারা মোবাইল নম্বর, কোত্থেকে কত সময় ধরে কথা বলা হয়েছিল_তার বিস্তারিত তথ্য-প্রমাণ তাঁদের সামনে হাজির করেন। পরে একপর্যায়ে জেএমবির সঙ্গে যোগাযোগের কথা স্বীকার করেন জামায়াত নেতারা। তাঁরা জানান, ছোট-বড় ৩৬টি ইসলামী সংগঠনের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ আছে। এসব সংগঠনকে অর্থও দেন তাঁরা। দেশে ইসলামী আন্দোলন জোরদার ও ইসলামী শাসন কায়েম করতেই তাঁরা এসব ইসলামী দলকে সাহায্য-সহযোগিতা করছেন।

সূত্র মতে, শনিবার রাতে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে মুজাহিদের কাছে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রসঙ্গ তুললে তিনি বিরক্ত হন। এ সময় তাঁদের দলীয় পত্রিকা 'দৈনিক সংগ্রাম'-এর কিছু কাটিং উপস্থাপন করা হয়। তখন মুজাহিদ বিব্রতবোধ করেন। একপর্যায়ে জিজ্ঞাসাবাদকারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, 'আপনারাও দেখি সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে উঠেপড়ে লেগেছেন।' উত্তরায় সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমানের নেতৃত্বে গোপন বৈঠকের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে মুজাহিদ প্রথমে মাহমুদুর রহমানের ওপর দোষ চাপান। তখন তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী সাবেক শিবির নেতা ড. আব্দুস সবুরের ওই বৈঠকে যোগ দেওয়ার কারণ কী ছিল জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি মুজাহিদ।

সূত্রটি জানায়, কথা বলার সময় কোনো বিষয়ে তাঁরা অনাগ্রহ প্রকাশ করলে সে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যান জিজ্ঞাসাবাদকারীরা। পরে সংগৃহীত তথ্য-প্রমাণ তাঁদের সামনে তুলে ধরা হয়। হরতালের আগের রাতে মগবাজারে গাড়িতে অগি্নসংযোগের বিষয়টি তুললে মুজাহিদ ও সাঈদী দুজনই প্রথমে এড়িয়ে যান। পরে ওই সংশ্লিষ্ট তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়। কেন বা কার নির্দেশে গত ১২ ফেব্রুয়ারি পল্টনে রাষ্ট্রপতির গাড়িবহরে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা হামলা করেছিল, তা জানতে চাওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদকারীরা তাঁদের কাছে জানতে চান, দেশের প্রধান ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির গাড়িবহর আটকে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে দেশে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টির কোনো পাঁয়তারা ছিল কি না। এ ঘটনায় মুজাহিদ ও সাঈদী জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন। পরে ওই ঘটনার ভিডিওচিত্র তুলে ধরলে তাঁরা আর কোনো কথা বলেননি। ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, ওই ঘটনায় জামায়াত শিবিরের একাধিক নেতা জড়িত রয়েছে।

মুজাহিদের সঙ্গে থাকতে অস্বীকৃতি : মুজাহিদ ও সাঈদীকে ডিবির পৃথক দুটি হাজতে রাখা হয়। গত শনিবার রাতে মুজাহিদের সঙ্গে রাখা হয় একজন হত্যা মামলার আসামিকে। হাজতখানার মধ্যে ওই আসামি মুজাহিদকে রাজাকার-আলবদর বলে গাল দেয়। মুজাহিদও তাকে খুনি বলে গাল দেন। এমন পরিস্থিতিতে ওই আসামি মুজাহিদের সঙ্গে এক হাজতখানায় থাকবে না বলে পুলিশ কর্মকর্তাদের জানায়। পরে তাকে ওই হাজতখানা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।

এদিকে গতকাল রবিবার নিজামী রিমান্ডে আসার পর ডিবি কার্যালয়ের হাজতখানা নিয়ে সমস্যায় পড়ে কর্তৃপক্ষ। পরে সাঈদীকে রমনা থানায় স্থানান্তর করা হয়েছে। রাতে ওখানেই তাঁর থাকার কথা।

আমাদের আদালত প্রতিবেদক জানান, সহোদর দুই মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার অভিযোগে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় দায়ের করা হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী দুই আগস্ট দিন ধার্য করা হয়েছে। গতকাল রবিবার ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতের বিচারক প্রতিবেদন দাখিল না করায় নতুন এ তারিখ নির্ধারণ করা হয়।

ঢাকা জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার মোজাফফর আহমেদ খান বাদী হয়ে ২০০৭ সালের ৩১ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নিজামী, মুজাহিদসহ ৬০-৭০ জনকে আসামি করে এ মামলাটি দায়ের করেন। আদালত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কেরানীগঞ্জ থানাকে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গ্রহণ করার আদেশ দেন। একই বছরের ৩১ ডিসেম্বর থানা অভিযোগটি এজাহার হিসেবে থানা রেজিস্ট্রারে অন্তর্ভুক্ত করে তদন্ত শুরু করে।

গত ৩০ জুন এ মামলায় নিজামী ও মুজাহিদকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

মামলার ঘটনায় জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর কেরানীগঞ্জের ভাওয়াল খানবাড়িতে বাদীর আত্মীয় মুক্তিযোদ্ধা ওসমান গণি ও গোলাম মোস্তফাকে এজাহার নামীয় আসামিদের নির্দেশে আলবদর বাহিনী হত্যা করে। এ সময় তারা পাকিস্তানি বাহিনীকে নিয়ে আসে।

গতকাল সকালে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে কারাগার থেকে জামায়াতের আমির নিজামীকে আদালতে হাজির করা হলেও মুজাহিদ অন্য মামলায় রিমান্ডে থাকায় তাঁকে আদালতে হাজির করা হয়নি।

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন