6 July 2010

যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকাতে ১০ সদস্যের কমিটি!রিমান্ডে জামায়াতের তিন নেতার তথ্য

মাসুদ কার্জন

বহুল আলোচিত যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকাতে ১০ সদস্যের একটি কমিটি গঠনের কথা স্বীকার করেছেন পুলিশের রিমান্ডে থাকা জামায়াতের স্থানীয় তিন নেতা। তাঁরা জানান, ব্যারিস্টার রাজ্জাকের নেতৃত্বে এই কমিটির কাজ তাদের (জামায়াত) পক্ষে জনমত গড়ে তোলা। প্রাথমিকভাবে এ কাজের জন্য ৬৬ লাখ টাকার তহবিলও বরাদ্দ আছে। এ ছাড়া যুদ্ধাপরাধ ইস্যু নিয়ে জামায়াতের মধ্যে বিদ্যমান নানা বিরোধের কথাও স্বীকার করেছেন জামায়াত নেতারা। তাঁরা তিনজনই দাবি করেন, গ্রেপ্তারের পর এ বিরোধ আরো মাথাচাড়া দিতে পারে।

জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে রিমান্ডে নিয়ে মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। গতকাল সোমবারও তাঁদের কখনো একা, কখনো একসঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ।

'জেএমবি, জঙ্গি বা বাংলা ভাই সম্পর্কে আমার কিছুই জানা নেই।' পুলিশ জামায়াতের সঙ্গে জেএমবির যোগাযোগের প্রসঙ্গ উত্থাপন করতেই অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গে এমন মন্তব্য করেন রিমান্ডে থাকা জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী। পরে 'বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি'_মন্ত্রী থাকাকালীন নিজামীর বক্তব্যসংবলিত পত্রিকার কাটিং ও ভিডিও ক্লিপিংস উপস্থাপন করে পরবর্তী সময়ের ঘটনাপ্রবাহের প্রসঙ্গ তুললে তিনি বিব্রত বোধ করেন। জিজ্ঞাসাবাদকারীরা তখন জানতে চান, সরকারের মন্ত্রী থেকে এ রকম মন্তব্য বাংলা ভাইকে বাঁচানোর জন্য কি না। এ প্রশ্ন শুনে নীরব হয়ে যান নিজামী। এ প্রসঙ্গে আর কথা বলতে চাননি তিনি। সংশ্লিষ্ট একজন পুলিশ কর্মকর্তা নিজামীকে জিজ্ঞাসাবাদের ঘটনা এভাবেই বর্ণনা করলেন। বাংলা ভাই, জেএমবি ছাড়াও চারদলীয় জোট সরকারের আমলে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় টিএসপি কারখানা থেকে এক হাজার ১৮২ টন রক-সালফার (এক ধরনের বিস্ফোরক) গায়েব হওয়ার ঘটনায় নিজামীকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এসব বিস্ফোরক পরে জেএমবির হাতে যায়। তা দিয়ে জেএমবি বোমা তৈরি করেছিল বলে এর আগে জিজ্ঞাসাবাদে জেএমবির প্রধান সাইদুর গোয়েন্দাদের জানিয়েছে।
এদিকে রিমান্ডে থাকা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশিষ্ট লেখক ড. হুমায়ুন আজাদকে হত্যাচেষ্টার প্ররোচনার অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হতে পারে। এ ব্যাপারে তাঁকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে সংশ্লিষ্টতা মিলেছে বলে সূত্রগুলো দাবি করেছে। পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, রবিবার রাত ২টা পর্যন্ত নিজামীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে সোমবার সকালে তিনজনকে পাশাপাশি বসিয়ে কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পুলিশের একাধিক দল তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে। একেক দল একেকটি বিষয় নিয়ে তাঁদের আলাদা আলাদা জিজ্ঞাসাবাদ করছে।

সূত্রমতে, মতিউর রহমান নিজামী শিল্পমন্ত্রী থাকাকালে পতেঙ্গার টিএসপি কারখানা থেকে রক-সালফার গায়েব হওয়ার ঘটনা ঘটে। ওই সময় কারখানাটির স্টোর ইন-চার্জ ছিলেন আহলে হাদিস নেতা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আসাদুল্লাহ আল গালিবের ভাতিজা জেএমবির এহসার সদস্য সালাফি। বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক গায়েব হওয়ার ঘটনায় মামলা হয় এবং সালাফি গ্রেপ্তার হয়। কিন্তু ওই মামলাটি বেশি দূর এগোয়নি।

গতকাল জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে মতিউর রহমান নিজামীর কাছে কেন এই মামলাটির এ রকম পরিণতি হয়েছিল, জানতে চাওয়া হয়। জবাবে তিনি বলেন, মামলা দেখভালের দায়িত্ব তো পুলিশের। জিজ্ঞাসাবাদকারীরা পাল্টা প্রশ্ন করেন, 'আপনার মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা কারখানা থেকে এত বড় একটি চুরির ঘটনা ঘটল, আপনি তা ছাড় দিলেন কেন?' নিজামী জবাব দেন, 'ব্যস্ততার কারণে সবকিছুর খোঁজ রাখা সম্ভব ছিল না।' জিজ্ঞাসাবাদকারীরা প্রশ্ন করেন, 'ব্যস্ততা, না ইচ্ছাকৃত?' তখন অনেকটা চুপ হয়ে যান নিজামী। তাঁকে জানানো হয়, বিপুল পরিমাণ এসব বিস্ফোরক পরে জেএমবির হাতে যায়। জেএমবি প্রধান সাইদুর রহমানও জিজ্ঞাসাবাদে এ ব্যাপারে অনেক কথা জানিয়েছেন। সাইদুর বিস্ফোরকের কিছু অংশ বস্তায় ভরে নদীতে ফেলে দেওয়ার কথাও গোয়েন্দাদের জানিয়েছে।

পুলিশ জানায়, সালাফিকে মতিউর রহমান নিজামীই চাকরি দিয়েছিলেন। কেন তাকে ওই কারখানায় চাকরি দিয়েছিলেন_এমন প্রশ্নেরও সঠিক জবাব দিতে পারেননি নিজামী।

জামায়াতের শীর্ষ কোনো নেতার সুপারিশ ছাড়া বাংলাদেশের কেউ মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না। কিন্তু জেএমবির অনেক সদস্যই মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ধরা পড়ার পর জেএমবির একাধিক সদস্য জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকেও এ তথ্য দিয়েছে। বর্তমানে জেএমবির শুরা সদস্য শাহেদ মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। সে এখন জেএমবির আমির পদের দাবিদার। মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব জঙ্গিদের ভর্তির বিষয়ে জামায়াত নেতারা কেন সুপারিশ করেছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে নিজামী বলেন, 'বিষয়টি আমার জানা নেই।'

সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর কাছে হুমায়ুন আজাদ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু কোনো কথা বলেননি তিনি। জিজ্ঞাসাবাদকারীরা তখন সাঈদীকে উদ্দেশ করে বলেন, 'হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলায় তো আপনি খুশি হয়েছিলেন।' সাঈদী বলেন, 'তা কি হয় নাকি?' তখন তাঁর একটি 'ওয়াজ'-এর ক্যাসেট বের করা হয়। ক্যাসেটটিতে হুমায়ুন আজাদকে কাফের, ইসলামের শত্রু বলে আখ্যা দিয়েছিলেন সাঈদী। এর কিছু দিন পরই একুশে বইমেলা চলাকালে বাংলা একাডেমীর সামনে তাঁর ওপর হামলা হয়। হামলার পর সাঈদী তাঁর ওয়াজে বলেছিলেন, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কাফের ছিল, তার শাস্তি হয়েছে।' ক্যাসেট শুনে সাঈদী পরক্ষণে বলেন, 'ওয়াজের সময় কথা প্রসঙ্গে অনেক কিছুই বলতে হয়।' জিজ্ঞাসাবাদকারীরা বলেন, 'তাহলে কি ওয়াজ মাহফিলের নামে আপনি রাজনীতি করেন?' পরে সাঈদীকে শোনানো হয় তাঁর ওয়াজ মাহফিলের আরেকটি ক্যাসেট। যেখানে তিনি বলছেন_'ইসলামের জন্য সশস্ত্র জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।' কেন এই কথা তিনি প্রচার করেন জানতে চাইলে সাঈদী কোরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদকারী কর্মকর্তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন।

হাজতে কথাকাটাকাটি : সূত্র জানায়, ডিবির হাজতখানায় রেখে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে জেএমবির এহসার সদস্য সৈকতকে। রবিবার এই এহসার সাঈদীকে দেখেই ক্ষেপে যান। সাঈদীকে উদ্দেশ করে গালিগালাজ শুরু করেন। তাঁকে কাফের আখ্যা দেয়। সৈকত বলে, 'আপনি ওয়াজ করেন একরকম আর কাজ করেন নিজের সুবিধামতো।' এ ছাড়া সৈকত নিজামীর পেছনে নামাজ পড়তেও অস্বীকৃতি জানায়। এক কর্মকর্তা জানান, রবিবার রাতে নামাজের সময় হলে নিজামী নামাজে দাঁড়ান। অন্য আসামিরা নিজামীর পেছনে নামাজে দাঁড়ালেও সৈকত নিজামীকে ইসলামের লেবাসধারী আখ্যা দিয়ে তাঁর পেছনে নামাজ না পড়ে আলাদাভাবে নামাজ আদায় করে।

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন