19 July 2010

আনোয়ারুল যেভাবে ভাগ্নে শহীদ

মাসুদ কার্জন

'জিহাদের প্রথম চেতনা লাভ করি ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলার চৌরঙ্গি দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীতে পড়াকালে। শিবির থেকেই জিহাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হই। ওই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করি। বাবা আবদুল কাইয়ুম স্থানীয় একটি মাদ্রাসার শিক্ষক। ১৯৯৮ সালে দূরসম্পর্কের এক মামার কাছ থেকে জেএমবিতে যোগ দেওয়ার ডাক পাই। প্রথমে গায়েরি এহসার, পরে ২০০১ সালে জেএমবির এহসার সদস্য পদে পদোন্নতি পাই। চলে যাই রংপুর শহরে। ওইখানে কখনো চা বিক্রেতা বা ফেরিওয়ালা আবার কখনো সাইকেল মেকারের ছদ্মবেশ নিয়ে সংগঠনের জন্য কাজ করেছি। সর্বশেষ ২০০৯ সালে জেএমবির শুরা সদস্য ও উত্তরাঞ্চলের দায়িত্ব পাই।'

জেএমবিতে যোগ দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এভাবেই নিজের সম্পর্কে বলে জেএমবির সামরিক বা অপারেশনাল কমান্ডার আনোয়ারুল আলম ওরফে নাজমুল ওরফে ভাগ্নে শহীদ।

বাবার দেওয়া নাম আনোয়ারুল থেকে ভাগ্নে শহীদ হয়ে ওঠার কাহিনী, বাংলা ভাইয়ের সংস্পর্শে আসা, ক্রমে ভয়ংকর হয়ে ওঠার কাহিনী ছাড়াও সর্বশেষ জেএমবির আমির সাইদুরের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার নানা কাহিনী বর্ণনা করেছে নাজমুল ওরফে ভাগ্নে শহীদ। বগুড়া থেকে ঢাকায় আনার পর মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে জেএমবির আমির সাইদুর রহমান ও জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় তিন নেতার মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাকে। রবিবার সকালে আবার তাকে বগুড়ায় পাঠানো হয়। বগুড়া গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক আবদুর রশিদ সরকার জানান, ভাগ্নে শহীদকে ঢাকার কোনো মামলার জন্য রিমান্ডের আবেদন করা হবে। পরে আবারও ঢাকায় পাঠানো হবে তাকে।

সূত্র জানায়, আনোয়ারুল আলম বাদ দিয়ে তার নাম কেন ভাগ্নে শহীদ হয়_এ রকম প্রশ্নের জবাবে তার দাবি, প্রথম দাওয়াত আসে জেএমবির তৎকালীন এহসার সদস্য মামা তরিকুলের মাধ্যমে। ফলে জেএমবির পুরনো সদস্যরা তাকে ভাগ্নে বলে সম্বোধন করত। পরে বাংলা ভাইও তাকে ভাগ্নে বলে সম্বোধন করত। ফলে আনোয়ারুল পাল্টে ভাগ্নে শহীদ বনে যায় সে। এমনকি জেএমবির আমির সাইদুর রহমান তার আপন ভায়রা হলেও তিনিও তাকে মাঝেমধ্যে ভাগ্নে শহীদ বলে সম্বোধন করতেন। শহীদের দাবি, দীর্ঘদিন তার মামা তরিকুলের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। তার ধারণা, তরিকুল দেশে নেই। থাকলেও জেএমবিতে সক্রিয় নয়।
গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, সাম্প্রতিক সময়ে ভাগ্নে শহীদ জেএমবির মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ও সাহসী বলে পরিচিত। সাইদুর দাওয়াতি কার্যক্রমে বিশ্বাসী হলেও শহীদ অপারেশনাল কর্মকান্ডে বিশ্বাসী। সাহসের কারণেই বাংলা ভাইয়ের কাছাকাছি আসা বা জেএমবিতে তার উত্থান হয় দ্রুত।

২০০১ সালে এহসার সদস্য হওয়ার পর প্রথমে রংপুর জেলার দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। ২০০২ সালে ওই শহরের আলমনগরের একটি মেসে বাংলা ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম দেখা হয় তার। ১০ জন এহসার সদস্যের উদ্দেশে বাংলা ভাই বক্তৃতা করেছিল সেখানে। কিছুদিন পর তার দায়িত্ব পড়ে দিনাজপুর জেলায়। ২০০৩ সালে পার্বতীপুর থানার পুলিশ জেএমবির কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। ওই সময় বাংলা ভাই, শায়খ আবদুর রহমানসহ জেএমবির শীর্ষস্থানীয় নেতারা সেখানে যায়। পুলিশের হাতে আটক জেএমবির সদস্যদের জামিন করানোর দায়িত্ব পড়ে ভাগ্নে শহীদের ওপর। তাকে দেওয়া দায়িত্ব পালনে খুশি হয়ে বাংলা ভাই তাকে সঙ্গে নিয়ে নেয়। ২০০৪ সালে রাজশাহীর বাগমারায় বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে কথিত সর্বহারানিধন শুরু হলেও পুরো সময়টি সে বাংলা ভাইয়ের সঙ্গে ছিল। ওই সময় বাংলা ভাইয়ের স্পোকসম্যানের দায়িত্ব পালন করেছিল সে। এ ছাড়া বাগমারার 'হামিরকুৎসা' ক্যাম্পের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। বাগমারায় গাছে ঝুলিয়ে মানুষ হত্যাসহ সব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও বাংলা ভাইয়ের সহযোগী হিসেবে সে কাজ করে। এর মধ্যে বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে টাঙ্গাইলে ব্র্যাক অফিস ও পাবনার চাটমোহরে গ্রামীণ ব্যাংকের অফিসে ডাকাতিতে অংশ নেয় সে।

বাংলা ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে কথা বা বক্তৃতা ছাড়াও রাজশাহী শহরের আলোচিত মোটরসাইকেল শোডাউনে উপস্থিত থেকে ওই ঘটনার পুরো সমন্বয় করেছিল ভাগ্নে শহীদ। তরিকুলের ভাগ্নের সাহসিকতার জন্য বাংলা ভাইও তাকে আদর করে ভাগ্নে বলে ডাকত। শহীদ নামটিও বাংলা ভাইয়ের দেওয়া। পরিস্থিতি খারাপ হলে রাজশাহী এলাকা ছেড়ে পালিয়ে আসে তারা।

বাংলা ভাই, শায়খ রহমানসহ ছয় জঙ্গির ফাঁসির পর ভাগ্নে শহীদের পরিচয় ঘটে সাইদুর রহমানের সঙ্গে। সাইদুর তার সাহস দেখে ২০০৯ সালে শুরা কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করেন। এ ছাড়া সাইদুর তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী লুৎফুন্নাহারের ছোট বোনকে ভাগ্নে শহীদের সঙ্গে বিয়ে দেন। ভাগ্নে শহীদ বরাবর আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন যাপন করলেও ৩০ বছর বয়সেই তিনটি বিয়ে করে। তিন স্ত্রীর তিনটি সন্তানও আছে।

বোমা বা বিস্ফোরক সম্পর্কে কিভাবে ধারণা হলো জানতে চাইলে সে দাবি করে, রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় একটি মেসে মোল্লা ওমরের (কুমিল্লায় নিহত) কাছে বোমা বানানোর প্রাথমিক প্রশিক্ষণ হয়েছিল তার। ২০০৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার ঘটনার দায় স্বীকার করে সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে সে। তার দাবি, ঘটনার আগে সংগঠনের কাজে দিনাজপুরে ছিল সে। আতাউর রহমান সানির ফোন পেয়ে সে ঢাকায় আসে। রাতে এসে খিলগাঁও জেএমবির একটি মেসে উঠে। ওই রাতেই সানিই প্রথম হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার পরিকল্পনার কথা তাকে জানায়। সকালে নামাজ শেষে বাজার থেকে রামদা কিনে আনে তারা। আগে থেকেই ছোট কয়েকটি বোমা বানানো ছিল। পুরো ঘটনার তদারকি করেছিল সানি। সন্ধ্যার আগে থেকেই তারা বাংলা একাডেমী চত্বরে গিয়ে থাকে। ড. হুমায়ুন আজাদ কোথায় বসেন, কখন বের হন_এসব বিষয় সানি আগেই রেকি করে রেখেছিল। ঘটনার দিন শুধু দায়িত্ব ছিল হুমায়ুন আজাদ কখন বের হন তা অনুসরণ করা। ওই সময় সানি ছাড়াও তার সঙ্গে নরুল্লাহ, শামীম, মিনহাজও উপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে শামীমই প্রথম হুমায়ুন আজাদকে আঘাত করে। তার কাজ ছিল শুধু বোমা ফাটানো।

পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ভাগ্নে শহীদ ময়মনসিংহে চারটি সিনেমা হলে একযোগে বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গেও জড়িত। জেএমবির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে ভাগ্নে শহীদ দাবি করে, বর্তমানে কোনো শুরা কমিটি নেই তাদের। মাত্র দুজন শুরা সদস্য বাইরে আছেন। এর মধ্যে মাহফুজ বা হাতকাটা মাহফুজকে সংগঠনবিরোধী কাজে জড়িত থাকায় সাইদুর রহমান আগেই পদাবনতি দিয়েছিলেন। শহীদের ধারণা, মাহফুজ দেশে নেই। এ ছাড়া আরেক সদস্য শাহেদ মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে। দাওয়াতি কার্যক্রম না চালানোয় সদস্যসংখ্যাও কমে আসছে।

ডিবির এক কর্মকর্তা জানান, সাইদুরের ধারণা, তার গ্রেপ্তারের পেছনে ভাগ্নে শহীদের হাত ছিল। এ ছাড়া গত ছয় মাস উত্তরাঞ্চল থেকে আসা চাঁদার টাকা তাকে দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল শহীদ। আমির হওয়ার ইচ্ছা নিয়েই শহীদ এসব করেছিল। এসব নিয়ে তাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। শনিবার রাতে সাইদুর ও ভাগ্নে শহীদকে মুখোমুখি করা হলে ভাগ্নে শহীদকে উদ্দেশ করে সাইদুর বলেন, 'তোমার কাছে যা আছে ওনাদের দিয়ে দাও।' উত্তরে শহীদ বলে, 'আপনার নির্দেশে আগেই তো সব ফেলে দিয়েছি।' এ সময় ভাগ্নে শহীদকে সাইদুর বলেন, 'তোমার তো ইলেম নাই, আমির হবা কিভাবে?' এ কথা শুনে ভাগ্নে শহীদ বলে, 'এসব ভুল ধারণা_আপনি এখনো দলের আমির।

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন