নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম | তারিখ: ০৫-০৭-২০১০
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীসহ কেন্দ্রীয় তিন নেতার মুক্তির দাবিতে গতকাল রোববার বিকেলে চট্টগ্রামে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা হঠাৎ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ মিছিল ও চোরাগোপ্তা হামলা-ভাঙচুর করেন। এ সময় প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় তাঁরা ৫০-৬০টি গাড়ি ও দোকানপাট ভাঙচুর করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, হামলাকারীদের প্রতিরোধ করতে গেলে পুলিশ ও এলাকাবাসীর সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ সাতটি ফাঁকা গুলি ছোড়ে। জবাবে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা গুলি চালান ও বোমা ফাটান। এ ঘটনায় অন্তত ২০ জন আহত হন। স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ অস্ত্র ও ছয়টি গুলিসহ প্রায় ৪১ জনকে আটক করে। রাতে এ প্রতিবেদন লেখার সময় পুলিশ অস্ত্র, বিস্ফোরক ও জননিরাপত্তা আইনে তিনটি মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, মতিউর রহমান নিজামী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের মুক্তির দাবিতে গতকাল বিকেলে হালিশহরের পিসিপুল এলাকা থেকে জামায়াত-শিবিরের ৪০-৫০ জন নেতা-কর্মী হঠাৎ লাঠিসোঁটা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। একপর্যায়ে তাঁরা স্লোগান দিয়ে পিসিপুল এলাকায় একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাঙচুর করেন। এরপর বড়পুল পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় রাস্তার উভয় পাশে অটোরিকশা, মোটরগাড়ি, ট্রাক, বাস, টেম্পো, মালবোঝাই ট্রাক-লরিসহ সামনে যা পড়েছে, তা-ই ভাঙচুর করা হয়েছে। সড়কের উভয় পাশের দোকানপাট ও প্রতিষ্ঠানেও হামলা-ভাঙচুর চালানো হয়।
বড়পুল মোড় এলাকার রয়েল হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক মো. ইয়াছিন জানান, ‘ওয়াপদা এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে ৩৫-৪০ জন যুবক স্লোগান দিয়ে আমার দোকানে হামলা চালায়। হোটেলের সামনে থাকা বিভিন্ন ধরনের ১৮টি যানবাহন ভাঙচুর করে তারা। এর মধ্যে আটটি টেম্পো ছিল। এই দোকানের সামনেই টেম্পোস্ট্যান্ড।’
হালিশহর কে-ব্লকের একজন বাসিন্দা বলেন, ‘আমার বাসার সামনে ছয়টি প্রাইভেট কার পার্কিং করা ছিল। হামলাকারীরা সবগুলো গাড়ির কাচ ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে।’ হালিশহরের আরেক বাসিন্দা বলেন, হামলাকারীদের হাতে গজারি লাঠি ছিল। পুলিশ ঘটনাস্থলে এলে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে আসে। এ সময় পুলিশ ও এলাকাবাসীর সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা স্থানীয় রাজমুকুট কমিউনিটি সেন্টারেও হামলা ও ভাঙচুর চালান। এ সময় কমিউনিটি সেন্টারে একটি সামাজিক অনুষ্ঠান চলছিল। সেখানে তিনটি প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাস ভাঙচুর করে তারা। অনুষ্ঠানে আসা লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। পরে পাশের তাসফিয়া মোটর ওয়ার্কশপে মেরামতের জন্য রাখা চারটি যানবাহনও ভাঙচুর করা হয়। এরপর বড়পুল এলাকায় আসতে আসতে রাস্তার পাশে থাকা ট্রাক, লরি ও অন্যান্য যানবাহন ভাঙচুর করে।
এ ছাড়া শাহজালাল কমিউনিটি সেন্টার, হেলথ অ্যান্ড হোম ক্লিনিকসহ অন্তত ২০টি দোকান ও প্রতিষ্ঠানে পাথর, ঢিল ছুড়ে কাচ ভাঙচুর করে। এ সময় এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনার পর পিসিপোল থেকে বড়পুল পর্যন্ত রাস্তায় ভাঙা যানবাহন আর কাচ পড়ে থাকতে দেখা যায়।
নগর পুলিশের কমিশনারের দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আসাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ঘটনাস্থল এবং আশপাশের এলাকা থেকে ৪১ জনকে আটক করা হয়েছে। সিঙ্গাপুর মার্কেটের পানির একটি ট্যাংক থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ছয়টি গুলিসহ একটি শাটারগান উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি বলেন, লোকজনের সহযোগিতার কারণে হামলাকারীদের আটক করা সম্ভব হয়েছে। নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল জলিল মণ্ডল বলেন, যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত দোষীদের গ্রেপ্তার করে অন্যদের ছেড়ে দেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, জামায়াত-সমর্থিত ব্যবসায়ীরা আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের ছোটপুল এলাকায় (বড়পুলের কাছে) সিঙ্গাপুর মার্কেটটি গড়ে তোলেন। পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের প্রতিরোধের মুখে জামায়াত-শিবিরের অনেক নেতা-কর্মী এই মার্কেটে আশ্রয় নেন।
মহানগর জামায়াতের আমির ও সাংসদ শামসুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কেন্দ্রীয় নেতাদের মুক্তির দাবিতে একটি মিছিল বের হয়। এরপর বড়পুল এলাকায় কী সব ঝামেলা নাকি হয়েছে। পুলিশ আমাদের অনেক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। এ ব্যাপারে আমরা খোঁজ নিচ্ছি। পরে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাব।’
পুলিশের বাধা: ভাঙচুর চলার সময় বড়পোল মোড়ে হালিশহর থানার একটি টহল দল মিছিলকারীদের বাধা দেয়। উপপরিদর্শক (এসআই) জাকির হোসেন বলেন, ‘হঠাৎ মিছিল ও ভাঙচুর দেখে আমি তাঁদের বাধা দিই। তখন তাঁরা আমার দিকে তেড়ে আসে। এ সময় আমি তিনটি ফাঁকা গুলি ছুড়ি।’
পরে উপকমিশনার (উত্তর) বনজ কুমার মজুমদার, সহকারী কমিশনার (এসি) ডবলমুরিং এস এম তানভির আরাফাতের নেতৃত্বে পুলিশ ও র্যাব ঘটনাস্থলে যায়। এর পরই পুলিশ হামলাকারীদের লাঠিপেটা করে। এ সময় স্থানীয় বাসিন্দারাও হামলাকারীদের প্রতিরোধে এগিয়ে আসে। পুলিশের উপকমিশনার বলেন, ‘আচমকা মিছিল বের করে যানবাহন ভাঙচুর করা হয়। পুলিশ বিভিন্ন বিপণিবিতান ও দোকানপাটে লুকিয়ে থাকা জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু করে।
আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ সভা: জামায়াত-শিবিরের হামলা ভাঙচুরের খবর পেয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বিকেলে পিসি রোডের বড়পুল এলাকায় জড়ো হন। সেখানে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সমাবেশে নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী বক্তব্য দেন। তিনি হামলা ভাঙচুরের নিন্দা জানিয়ে বলেন, পাড়ায় পাড়ায় সংগ্রাম কমিটি গঠন করে জামায়াত-শিবিরকে প্রতিরোধ করতে হবে। আজ সোমবার বিকেলেও বড়পুল এলাকায় সমাবেশ করার ঘোষণা দেওয়া হয়।
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন