ফজলুল বারী
সিডনি থেকে
গোলাম আযম পালিয়ে যাবেন বিলাতে! বা যাবেন বৈধ পথে! ওখানে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইবেন! তিনি পালিয়ে গেলে, সরকার আর যুদ্ধাপরাধ-মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের কারণে তাঁকে গ্রেপ্তার-বিচারের সম্মুখীন করতে পারবে না! লন্ডন নকশার পুরো বিষয়টি এখন মোটামুটি প্রকাশিত। কিন্তু সরকার বিষয়টি নিয়ে এখন পর্যন্ত চুপ। লন্ডনে হাউস অব কমন্সে যুদ্ধাপরাধ আইনকে চ্যালেঞ্জ করে সেমিনারের আয়োজন করেছে জামায়াতের ছায়া সংগঠন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যুক্তরাজ্যে আশ্রয় নেওয়া আত্দস্বীকৃত যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মইনুদ্দিন আছেন এর নেপথ্যে। জাস্টিস কনসার্ন নামের একটি জামায়াতী ছদ্মবেশী সংগঠন, ইউরো বাংলা নামের একটি জামায়াতী পত্রিকাও নেপথ্যে থেকে সেমিনারের কাজকর্ম করে যাচ্ছে। এ বিষয় নিয়েও রহস্যজনকভাবে মুখে কলুপ এঁটে বসে আছে সরকার। পুরো বিষয়টি অনেকের কাছেই মনে হচ্ছে বিশেষ তালগোলে।
জনগণের কাছে পরিচিত চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের কুলশিরোমণি গোলাম আযম। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে পাকিস্তানের পক্ষে রাজাকার-আলবদরদের নিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রধান নেতা ছিলেন। তাঁর জামায়াত নামের দল, ইসলামী ছাত্রসংঘ নামের ছাত্র সংগঠন দেশের ভেতরে লাখ লাখ নিরীহ মানুষ খুন-জেনোসাইড, বুদ্ধিজীবী হত্যা, ধর্ষণ, অগি্নসংযোগ, রাহাজানির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় টের পেয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যান গোলাম আযম। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার আগ পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের দেশে ঘুরে তদ্বির চালিয়েছেন, যাতে দেশগুলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়। যুদ্ধাপরাধী রাষ্ট্রদ্রোহী এমন একজন ব্যক্তি জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর দেশে ফিরে আসেন। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব না থাকলেও তাঁকে আর পাকিস্তান ফিরে যেতে হয়নি। এরপর বাংলাদেশের আদালতকে ব্যবহার করে তাঁর নাগরিকত্বের ব্যবস্থা করা হয়েছে। '৯০-এর স্বৈরাচার এরশাদের পতন-পরবর্তী সময়ে ডামাডোলের ভেতর নিজেকে ঘোষণা করেন জামায়াতের আমির। যে দেশ তিনি চাননি, সেই দেশের রাজনীতিতেই ফিরে আসেন আনুষ্ঠানিকভাবে।
কিন্তু এর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ নয়, প্রথম প্রতিবাদ করেন মুক্তিযুদ্ধের শহীদ রুমির মা। লেখিকা, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের মধ্যে নতুন ঘৃণা প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে দেন। তাঁর আন্দোলনে নতুন স্বপ্ন দেখায় মুক্তিযোদ্ধাদের। নতুন প্রজন্মকে চিনতে শেখায় যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম, তাঁর দোসরদের। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গোলাম আযমসহ চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের প্রতীকী বিচারে ফাঁসির রায় দেয় শহীদ জননীর নেতৃত্বাধীন গণ-আদালত। এর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার। গণ-আদালতের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দেয় শহীদ জননীসহ ২৪ বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে। খালেদা জিয়ার দেওয়া সেই রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ মাথায় নিয়ে মরতে হয়েছে ক্যান্সার আক্রান্ত শহীদ জননীকে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আজকের বিশেষ ট্রাইব্যুনালসহ সব সরকারি আয়োজন তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনের ফসল।
সরকার আসলে কী চায়
সরকারের পক্ষ হতে বারবার বলা হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতেই হবে। কোনো শক্তি এ বিচার ঠেকাতে বা যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে পারবে না। এখন হাতের মুঠোয় থাকা গোলাম আযমই যদি না থাকে তাহলে কী বিচারের পুরো আয়োজনটিই হাস্যকর-প্রশ্নবিদ্ধ হবে না? প্রশ্নটি মুখে মুখে সবার। চলতি পরিস্থিতির পেছনে সরকারের দায়দায়িত্বই বা কী? গোলাম আযমের পাসপোর্টের মেয়াদ ছিল না। সরকার যেখানে তাঁর বিচারের কথা বলছে, সেখানে প্রশাসনের কারা কিভাবে উদ্যোগী হয়ে তাঁর পাসপোর্টটি নবায়ন করে দিয়েছে? ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশন প্রথম প্রত্যাখ্যান করে গোলাম আযমের ভিসার আবেদন। তাঁর লন্ডনপ্রবাসী ছেলেরা সেখানে আপিলে জিতে ব্যবস্থা করে ভিসার। যতটা জানা যায়, ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশনের পক্ষে এ ব্যাপারে সরকারি পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। জানতে চাওয়া হয়েছিল যুদ্ধাপরাধী, যাদের বিচারের কথা চলছে তাদের কোনো তালিকা আছে কি না।
পররাষ্ট্র দপ্তরের তরফে তাদের কোনো সহায়তা দেওয়া হয়নি। এ কারণে খুব স্বাভাবিকভাবে লন্ডনের আপিলে বলা হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ সরকারই কিছু বলছে না, সেখানে কেন ভিসা দেবে না ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশন? এর আগে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করে সৌদি আরবের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে গিয়েছিলেন জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলী। এ নিয়ে মিডিয়ায় হৈচৈ হলে সরকারের তরফে বলা হয়, সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধীদের তালিকাটি বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের হাতে পেঁৗছতে দেরি হওয়ায় ঘটনাটি ঘটেছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে আদৌ কী তৈরি করা হয়েছে এমন কোনো তালিকা? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এমন কোনো তালিকা করে থাকলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘুরে তা ঢাকার দূতাবাসগুলোতে পেঁৗছাতে বাধা কোথায়? সরকারের কিছু বাকবাকুম মন্ত্রী নানা ইস্যুতে কারণে-অকারণে বিস্তর কথা বলেন। এসব কথাবার্তায় মাঝেমধ্যেই থাকে সমন্বয়ের অভাব। যেমন_এক প্রতিমন্ত্রী এর মধ্যে বলেছেন, সন্দেহজনক যুদ্ধাপরাধীদের তালিকায় নাম নেই মীর কাশেম আলীর। ভিত্তি কি এ ধরনের কথাবার্তার? মীর কাশিম আলীর একাত্তরের ভূমিকা কি জানে না দেশের মানুষ?
ফাঁস লন্ডন ষড়যন্ত্র!
লন্ডনে বাংলাদেশের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হাইকমিশন আছে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচারকে চ্যালেঞ্জ, প্রশ্নবিদ্ধ করতে জামায়াত যে হাউস অব কমন্সের মতো জায়গায় গোপনে একটি সেমিনার আয়োজনের কাজ এগিয়ে নিয়েছে_সেটি প্রকাশ-ফাঁস করেছেন ডেভিড বার্গম্যানের মতো একজন সাংবাদিক। বিডিনিউজের মাধ্যমে প্রকাশিত ডেভিডের রিপোর্টে আবার প্রমাণ আছে, লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশন সেমিনারটির কথা জানে। বাংলাদেশ হাইকমিশনারকে সেমিনারে দাওয়াত করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতির সফর নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন বলে তিনি সেখানে যেতে রাজি হননি। হাইকমিশনার কী যথাসময়ে বিষয়টি সরকারকে জানিয়েছেন? জানানোরই কথা। মানুষের ঘাড়ে তো মাথা একটাই থাকে। কিন্তু সরকার কেন বিষয়টি গোপন রাখতে অথবা চেপে যেতে চেয়েছে? এ বিষয়টির খোলাসা হওয়া দরকার।
ডেভিড বার্গম্যানের রিপোর্টে প্রকাশ পেয়ে গেছে, কথিত সেমিনার নিয়ে জামায়াতের ছদ্মবেশী সংগঠন জাস্টিস কনসার্নের লুকোচুরির বৃত্তান্ত। নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় আনুগত্য গোপন করে হাউস অব কমন্সের বেশ কিছু সদস্যকে তারা বিভ্রান্ত করতে চেয়েছে। ডেভিড যখন কনসার্নের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন তখন তারা আমতা আমতা করেছে। তারা দিয়েছে 'চিনি না', 'জানি না', 'আমি না', জাতীয় উত্তর। একাত্তরে পালিয়ে যাওয়া যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মইনুদ্দিন ছাড়াও গত কয়েক বছরে লন্ডনে জামায়াত-শিবিরের বিশেষ একটি সংঘবদ্ধ অবস্থান গড়ে উঠেছে। গোলাম আযমের যেমন চার ছেলে সেখানে থাকেন, তেমনি মতিউর রহমান নিজামীসহ অনেক জামায়াতী নেতাও সাংগঠনিক-অর্থনৈতিক ভিত্তির মতো সেখানে গড়ে তুলেছেন আশ্রয় নেওয়ার পর পারিবারিক সম্পর্ক। লন্ডনভিত্তিক প্রবাসী বাঙালিদের অর্থায়নে যে বেসরকারি বিমান সংস্থা কাজ শুরু করেছে ঢাকায়, সেটির সঙ্গেও জামায়াতের লোকজন সক্রিয়ভাবে জড়িত। সেখানকার প্রবাসী বাঙালি মিডিয়া সাংবাদিকদের মধ্যেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আছেন, যাঁরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে। ডেভিডের রিপোর্টে শুধু এসেছে এক ইউরো বাংলা পত্রিকার কথা।
সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর এক রকম গর্তে ঢুকে গিয়েছিল জামায়াতে ইসলামী। যুদ্ধাপরাধের বিচারে পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাসসহ নানা প্রস্তুতির সঙ্গে নীরবে চলতে থাকে তাদের আত্দরক্ষার ক্রিয়াকৌশল। কিন্তু পুরো বিষয়টি নিয়ে সরকারের প্রশ্নবিদ্ধ ধীরে চল নীতি এর মধ্যে তাদের আবার মাথা তুলে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে। তাদের রক্ষার আনুষ্ঠানিক দায়দায়িত্বও নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে সক্রিয় মাঠে ছিল জামায়াত। ২৭ জুনের হরতালও তাদের রাজধানীসহ সারা দেশে রাজনৈতিক পুনর্বাসনের নতুন সুযোগ করে দিয়েছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সর্বশেষ বলেছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রধান বাধা বিএনপি। কিন্তু কোনো শক্তিই বিচার আটকাতে পারবে না_এমন ঘোষণার পরও এ নিয়ে সরকারি কর্মকাণ্ডে সৃষ্ট সংশয় কাটছে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন করে আসছিল শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সংগঠন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। গত নির্বাচনের আগে সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের ভূমিকাটিও ছিল বিশেষ সরব-সক্রিয়। কিন্তু এ সংগঠনগুলো কেন এখন পুরো বিষয়টি নিয়ে আশ্চর্য নীরব? যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে তহবিল সংগ্রহ, আন্তর্জাতিক মতামত গঠনসহ জামায়াতের নানা প্রস্তুতির খবর আগেই জানা যাচ্ছিল। লন্ডনের সেমিনার ষড়যন্ত্রটি ছিল তাদের প্রস্তুতির বড় একটি ধাপ। ডেভিডের রিপোর্টে অসৎ উদ্দেশ্যটি প্রকাশ-ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর বিলাতপ্রবাসী সচেতন মানুষ তা প্রতিরোধে এগিয়ে এসেছেন। পুরো বিষয়টি নিয়ে এখন পর্যন্ত সরকারি নীরবতার কারণ সরকারকেই বলতে হবে।
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন