30 June 2010

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলায় জামিন, আট মামলায় গ্রেপ্তার: নিজামী মুজাহিদ সাঈদীর ১৬ দিনের রিমান্ড

নিজস্ব ও আদালত প্রতিবেদক | তারিখ: ০১-০৭-২০১০


জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে পাঁচ মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১৬ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার একটি মামলায় গত মঙ্গলবার তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। গতকাল বিকেলে অন্য পাঁচ মামলায় রিমান্ডের আবেদন জানানো হলে আদালত তা মঞ্জুর করেন। রাতেই তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয়। তবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার মামলায় তাঁরা জামিন পেয়েছেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, জামায়াতের ওই তিন নেতাকে দেশের বিভিন্ন স্থানে দায়ের করা যুদ্ধাপরাধ-সংক্রান্ত ২৫টি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হতে পারে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, যুদ্ধাপরাধসহ অন্য সব মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার দেখানো হবে।

আদালত সূত্র জানায়, জামায়াতের তিন নেতাকে গতকাল পর্যন্ত আটটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। মামলাগুলো হচ্ছে রাজধানীর পল্লবী ও কেরানীগঞ্জে ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধা হত্যার দুটি মামলা, উত্তরার গোপন বৈঠক-সংক্রান্ত রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফারুক হোসেন হত্যা মামলা, গত ফেব্রুয়ারিতে পল্টন এলাকায় রাষ্ট্রপতির গাড়িবহর প্রতিরোধ ও পুলিশের ওপর হামলা-সংক্রান্ত তিনটি মামলা এবং হরতালের আগের রাতে রমনা থানায় দায়ের করা গাড়িতে অগ্নিসংযোগের মামলা। এ ছাড়া ১৯৭১ সালে পিরোজপুর থানায় মুক্তিযোদ্ধা হত্যা মামলায় সাঈদীকে পৃথকভাবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

গতকাল আদালত পল্টনের তিন মামলায় নয় দিন, উত্তরার মামলায় তিন দিন ও রমনার মামলায় চার দিন—এই ১৬ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

গ্রেপ্তার করা তিন নেতাকে গতকাল বিকেল পর্যন্ত মিন্টো রোডের গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে রাখা হয়। এ সময় কয়েকজন কর্মকর্তা তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। বিকেল পৌনে চারটার দিকে কড়া নিরাপত্তায় তাঁদের আদালতে নেওয়া হয়। বিকেল চারটার দিকে প্রথমে তাঁদের ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম মোহাম্মদ আলী হোসাইনের আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় আদালত প্রাঙ্গণে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। অনেকে এ সময় মারমুখী হয়ে ওঠেন। সন্ধ্যার পর তিন নেতাকে আদালতের হাজত থেকে বের করা হয়।

পল্টনে তিন মামলা: প্রথমে রাষ্ট্রপতির গাড়িবহরে হামলা ও পুলিশের কর্তব্যকাজে বাধা দেওয়ার মামলায় আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। একই আদালতে পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে আরও দুই মামলায় ১০ দিন করে রিমান্ড চায় পুলিশ।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ আবু আদালতকে বলেন, গত ফেব্রুয়ারি মাসে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবভন থেকে বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে পল্টন এলাকায় তাঁর গাড়ি প্রতিরোধ ও পুলিশের কাজে বাধার সৃষ্টি করেন জামায়াতের নেতা-কর্মীরা। এ প্রসঙ্গে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।

আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার ও সানাউল্লাহ মিয়া নিজামীসহ তিন আসামির জামিনের আবেদন করে আদালতকে বলেন, মামলার এজাহারে মতিউর রহমান নিজামী, মুজাহিদ ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নাম নেই। এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করা হয়েছে। আসামিরা এ ঘটনার বিষয়ে কিছু জানেন না। উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাঁদের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। শুনানি শেষে আদালত প্রত্যেকের তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এরপর আদালত পল্টন থানার পৃথক দুই মামলায়ও তাঁদের তিন দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দেন।

আইনজীবী মশিউর রহমান আদালতকে বলেন, নিজামীসহ জামায়াত নেতাদের রাজনৈতিকভাবে হয়রানির উদ্দেশ্যে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করা হয়েছে। পরে একই এজলাসে মহানগর হাকিম ইসমাইল হোসেন ওঠেন। উত্তরা থানার পুলিশ রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী খন্দকার আবদুল মান্নান আদালতকে বলেন, আসামিদের নির্দেশ ও পরামর্শে পরিকল্পিতভাবে দেশে নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটানো এবং দেশের বাইরে বন্ধুভাবাপন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। রাষ্ট্রবিরোধী কাজের সঙ্গে জড়িত অন্য আসামিদের অবস্থান জানতে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। শুনানি শেষে আদালত তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

এরপর মহানগর হাকিম এস কে তোফায়েল হাসানের আদালতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার মামলায় জামিনের আবেদন করা হয়। আদালত তাঁদের জামিন মঞ্জুর করেন।

রমনার মামলা: রমনা থানার মামলায় সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন জানান দারোগা জাফর আলী। তিনি আদালতে বলেন, হরতালের আগের রাতে ছাত্রশিবির, ছাত্রদল ও যুবদলের নেতা-কর্মীরা টঙ্গী ডাইভারশন রোডে একটি ও মগবাজারের ডাক্তারের গলির মুখে একটি গাড়িতে আগুন দেয়। এতে ১০ লাখ টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়। একই আদালতে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। পুলিশের অপরাধ তদন্ত ও প্রসিকিউশন বিভাগের সহকারী কমিশনার মকবুল হোসেন আদালতকে বলেন, ২৭ জুনের হরতালের আগের দিন আসামিরা একটি সভা করেন। সভায় বলা হয়, যে ব্যক্তি একটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করবে, তাকে তিন হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। এ সংক্রান্ত তথ্যপ্রমাণ পুলিশের কাছে আছে। তা ছাড়া আসামিদের উসকানি ও নির্দেশনায় জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে রমনা এলাকায় গাড়ি পুড়িয়ে চালক সুজন ও ফারুক নামের এক ব্যক্তিকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্য আসামিদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।

আসামিপক্ষের আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক এর বিরোধিতা করে বলেন, নিজামী, মুজাহিদ ও সাঈদীর নাম এজাহারে নেই। সন্দেহজনকভাবে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আসামিরা সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি ও রাজনীতিবিদ। তাঁদের রাজনৈতিকভাবে হয়রানির উদ্দেশে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শুনানি শেষে আদালত চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

উত্তরার মামলা: উত্তরা থানায় দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় ১০ দিনের পুলিশি হেফাজতে নেওয়ার আবেদন করেন উপপরিদর্শক শফিকুল ইসলাম। মামলায় বলা হয়, তিন আসামির সবাই মিলে গত ১২ ফেব্রুয়ারি উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরের ১৮ নম্বর সড়কের ৪৫ নম্বর বাসায় বসে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করাসহ দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করেন।

আসামিপক্ষে শুনানিতে অংশ নেন আবদুর রাজ্জাক, এস এম কামাল উদ্দিনসহ প্রায় ৩০ আইনজীবী। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন আবদুল্লাহ আবু, খন্দকার আবদুল মান্নান, কাজী নজিবুল্লাহ, আবদুর রহমান হাওলাদার, মাহফুজুর রহমানসহ শতাধিক আইনজীবী।

মতিহারের মামলা: রমনা থানার পুলিশের মাধ্যমে রাজশাহী মহানগরের মতিহার থানার দারোগা সোহেল রানা তিন নেতাকে গ্রেপ্তারের আবেদন জানান। তিনি আবেদনে বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতা ফারুক হত্যার সঙ্গে এই তিন নেতার সংশ্লিষ্টতা আছে। এ মামলায় গ্রেপ্তার করা আসামিদের ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে তাঁদের নাম আছে।

কারাগারে: বিকেল সাড়ে ছয়টার দিকে তিন আসামিকে আদালত থেকে নামিয়ে আবার হাজতখানায় নেওয়া হয়। সন্ধ্যা সোয়া সাতটার দিকে তাঁদের নিয়ে আদালত থেকে গাড়িবহর রওনা হয়। রাত পৌনে আটটার দিকে তাঁদের কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢোকানো হয়।

নিরাপত্তা ও ক্ষোভ: আদালত এলাকায় অতিরিক্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মোতায়েন ছিল অতিরিক্ত পুলিশ ও র‌্যাব। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-জামায়াতপন্থী আইনজীবীরাও সেখানে জড়ো হন। আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সকাল থেকেই আদালত এলাকায় দফায় দফায় মিছিল করেন। বিকেল চারটার দিকে জামায়াতের তিন নেতাকে আদালতে আনার পর ছাত্রলীগ পর পর কয়েকটি মিছিল বের করে। ঢাকা জেলা পরিষদের বারান্দায় বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যা সোয়া সাতটার দিকে তিন নেতাকে বহনকারী প্রিজনভ্যানটি আদালত চত্বর ত্যাগের সময় জুতা প্রদর্শন করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার ওয়ালিদ হোসেন জানান, আদালতপাড়ায় বিক্ষোভকালে গতকাল মোট ৩০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন