নিজস্ব ও আদালত প্রতিবেদক | তারিখ: ৩০-০৬-২০১০
জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী গতকাল মঙ্গলবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। পুলিশ জানায়, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। আদালতে হাজির না হওয়ায় গতকালই আদালত জামায়াতের এই তিন নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
গতকাল বিকেলে রাজধানীর প্রেসক্লাবের সামনে থেকে নিজামীকে, সাভারের নবীনগর এলাকা থেকে মুজাহিদকে এবং শহীদবাগের বাসা থেকে সাঈদীকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর সন্ধ্যায় তাঁদের মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে নেওয়া হয়।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক রাতে প্রথম আলোর প্রশ্নের উত্তরে জানান, জামায়াতের নেতাদের যুদ্ধাপরাধ-সংক্রান্ত মামলাতেও গ্রেপ্তার দেখানো হতে পারে। অন্য একটি সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরের তাণ্ডবে ছাত্র ফারুক হোসেনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এই মামলায়ও তাঁদের গ্রেপ্তার দেখানো হতে পারে।
এ ছাড়া নিজামী ও মুজাহিদের বিরুদ্ধে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি ও নাইকো দুর্নীতি, পল্লবী থানায় মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যার অভিযোগে এবং কেরানীগঞ্জ থানাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, নির্যাতন, লুটপাটের অভিযোগে মামলা রয়েছে।
পুলিশ জানায়, একই মামলায় জামায়াতের ঢাকা মহানগরের আমির রফিকুল ইসলাম খান পলাতক আছেন। তবে সাঈদীকে পিরোজপুরের অন্য একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। জামায়াতের এই তিন নেতাকে গ্রেপ্তারের পরপরই মগবাজারে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও পল্টনে মহানগর কার্যালয় পুলিশ ঘিরে রাখে।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে গত ২১ মার্চ জামায়াত-শিবিরের পাঁচ নেতার বিরুদ্ধে মামলা করেন তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব রেজাউল হক চাঁদপুরী। মামলায় বলা হয়, গত ১৭ মার্চ সিরাতুন্নবী (সা.) উপলক্ষে ছাত্রশিবিরের আলোচনা সভায় রফিকুল ইসলাম খান মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর আমির নিজামীকে তুলনা করেন, যা ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতিতে আঘাত করেছে। ওই সভায় নিজামীসহ অন্য আসামিরা উপস্থিত ছিলেন। পরদিন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তা প্রকাশিত হয়। মহানগর হাকিম বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে আসামিদের বিরুদ্ধে সমন জারি করেন।
ওই মামলায় গতকাল মতিউর রহমান নিজামীসহ পাঁচ আসামির হাজির হওয়ার জন্য দিন ধার্য ছিল। অপর আসামি ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) ছাত্রশিবিরের সভাপতি আ স ম ইয়াহিয়া সকালে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। আদালত তাঁর জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন। নিজামীসহ অন্য চার আসামি হাজির না হওয়ায় মহানগর হাকিম মেহেদী হাসান তালুকদার তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। একই সঙ্গে আদালত রমনা থানা পুলিশকে আগামী ৩ আগস্টের মধ্যে গ্রেপ্তার-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেন।
সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীর আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, আদালত আসামিদের হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু একজন ছাড়া অন্য কোনো আসামি হাজির না হওয়ায় আদালত তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
গ্রেপ্তারের পর সন্ধ্যায় জামায়াতের তিন নেতাকে ডিবির কার্যালয়ে নেওয়া হয়। সেখানে উপস্থিত জামায়াতের নেতারা জানান, বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে জামায়াতপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরামের (এনডিএফ) একটি সভা শেষে বের হওয়ার পথে নিজামীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
সাভার থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, আশুলিয়া থানা পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাড়ি যাওয়ার পথে পুলিশ আমাকে থানায় নিয়ে এসেছে। সংবাদমাধ্যমে জানতে পেরেছি, আদালত থেকে আমার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। কিন্তু যে ধরনের বক্তব্যের জন্য দায়ের করা মামলায় আমার নামে পরোয়ানা জারি করা হয়েছে, আমি সে ধরনের কোনো বক্তব্য দিইনি।’
মুজাহিদের ছেলে আলী আহাম্মদ জানান, তাঁরা পারিবারিক কাজে ফরিদপুরে যাচ্ছিলেন। পথে নবীনগর জাতীয় স্মৃতিসৌধের সামনে গাড়ি থামায় পুলিশ। এরপর তাঁদের গাড়িসহ আশুলিয়া থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কিছুক্ষণ রাখার পর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল মুজাহিদকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসে। পুরো বিষয়টিকে সাজানো হিসেবে অভিহিত করেন তিনি। গাড়িতে মুজাহিদ, তাঁর স্ত্রী ও ছেলে ছিলেন। পেছনের একটি গাড়িতে জামায়াতের কয়েকজন কর্মী ছিলেন।
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বড় ছেলে রাফীক বিন সাঈদী প্রথম আলোকে বলেন, বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে সাদা পোশাকে ও পোশাকধারী পুলিশ তাঁদের শহীদবাগের বাসায় যায়। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, তাঁরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে এসেছেন। তাঁরা সাঈদীকে তাঁদের সঙ্গে যেতে বলেন। এ সময় সাঈদী গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেখতে চাইলে তাঁরা পরোয়ানা দেখাতে পারেননি।
জামায়াতের তিন নেতাকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল করেছে জামায়াতের কর্মীরা। যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ জানায়, যাত্রাবাড়ী এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করার সময় পুলিশ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
মুজাহিদকে গ্রেপ্তারের পরপর জামায়াতের অর্ধশত নেতা-কর্মী আশুলিয়া থানায় ভিড় করেন। গোয়েন্দা পুলিশ তাঁকে মাইক্রোবাসে তুলে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেওয়ার পরপর এই কর্মীরা ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে প্রতিবাদ মিছিল করেন। এর পরপরই পুলিশ তাঁদের লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
বিএনপির নিন্দা: রাতে বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন এক বিবৃতিতে বলেন, ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে বিরোধী দলগুলোকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। তিনি জামায়াতের তিন নেতাকে গ্রেপ্তারের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান এবং অবিলম্বে তাঁদের মুক্তি দাবি করেন।
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন