24 June 2010

জামায়াতের সম্পৃক্ততায় ব্রিটিশ পার্লামেন্টে যুদ্ধাপরাধ সেমিনার আয়োজন!

কালের কণ্ঠ ডেস্ক

যুক্তরাজ্যের মানবাধিকার-বিষয়ক একটি পার্লামেন্টারি কমিটি স্বীকার করেছে, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে এমন একটি গ্রুপের সহায়তায় তারা বাংলাদেশে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার বিষয়ে হাউস অব লর্ডসে একটি সেমিনারের আয়োজন করেছে।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত ও তার তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

ওই সেমিনারে আন্তর্জাতিক আইনি মানদণ্ডের সঙ্গে ১৯৭৩-এর আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন সংগতিপূর্ণ কি না, তা নিয়ে আলোচনা করা হবে। এর আয়োজক লর্ড অ্যাভেবারি। সেমিনারে বক্তব্য দেবেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও ইন্টারন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশনের বক্তারা। তবে কবে সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হবে সে কথা জানায়নি বিডিনিউজ।

গত মার্চে ইন্টারন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশনের ওয়ার ক্রাইমস কমিটি ১৯৭৩-এর আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনে কিছু পরিবর্তনের সুপারিশ করে বাংলাদেশ সরকারের কাছে আইনি মতামত পাঠায়। তাদের মতে, এটি করা হলে যুদ্ধাপরাধের বিচার আন্তর্জাতিক আইনের মানদণ্ড অনুযায়ী হবে।

তাদের এই সুপারিশে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ইতিপূর্বেকার উদ্বেগেরই প্রতিফলন ঘটেছে। ২০০৯ সালের জুলাইয়ে মানবাধিকার সংস্থাটি এক চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তাদের এই উদ্বেগের কথা জানিয়েছিল।

বাংলাদেশ সরকার বরাবর বলে আসছে, যুদ্ধাপরাধের বিচার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী হবে। কিন্তু কিভাবে তা নিশ্চিত করা হবে সে ব্যাপারে সরকার এখনো স্পষ্ট করে কিছু বলেনি।

পার্লামেন্টারি হিউম্যান রাইটস গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান লর্ড অ্যাভেবারি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারবিষয়ক সেমিনারের আমন্ত্রণপত্র আমার নামে সবার কাছে পাঠানো হলেও এ ব্যাপারে করণিক সহায়তা দিয়েছে 'জাস্টিস কনসার্ন' নামের একটি সংগঠন। তারা চিঠির উত্তরও রেকর্ড করেছে, যাতে কারা সেমিনারে উপস্থিত থাকবেন, বক্তব্য দেবেন তাঁদের তালিকা আমাদের কাছে থাকে।'

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানিয়েছে, মাত্র দুই মাস আগে 'জাস্টিস কনসার্ন' আত্দপ্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইংল্যান্ডে এর অঙ্গসংগঠনের সঙ্গে সংগঠনটির সম্পৃক্ততা রয়েছে।
জাস্টিস কনসার্নের ওয়েবসাইটটি নিবন্ধিত হয়েছে জনৈক এম কে এ শিকদারের নামে। তিনি কামাল শিকদার নামেও পরিচিত। কামাল শিকদার যুক্তরাজ্যভিত্তিক জামায়াতপন্থী সাময়িকী 'ইউরো বাংলা'র নির্বাহী পরিচালক।

যুক্তরাজ্যপ্রবাসী কামাল শিকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে স্বীকার করেছেন, ১০ বছর আগে ছাত্রাবস্থায় তিনি জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন। তবে তিনি নিজের নামে 'জাস্টিস কনসার্ন'-এর ওয়েবসাইট নিবন্ধন করানোর কথা অস্বীকার করে বলেন, কামাল শিকদার খুবই প্রচলিত একটি নাম। এটা যে কারোর নাম হতে পারে।

ওয়েবসাইট নিবন্ধনের নথিপত্রে দেওয়া ই-মেইল ঠিকানাটি তাঁর_এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'জাস্টিস কনসার্ন আমার নাম ব্যবহার করেছে কি না, সেটা তাদের জিজ্ঞেস করতে হবে।' তিনি ওই সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করে বলেন, 'জাস্টিস কনসার্ন সম্পর্কে শুধু এটুকুই জানি যে, আমি একটি অনুষ্ঠানে যোগদানের আমন্ত্রণপত্র পেয়েছি।'

জাস্টিস কনসার্নের চেয়ারপারসন ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ভূঁইয়া ফুয়াদ। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তাঁরও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তিনি লন্ডনের ইস্ট এন্ডে সুপরিচিত 'বাংলাদেশ ফোরাম ইউরোপ'-এরও নির্বাহী সমন্বয়কারী। 'ইসলামিক ফোরাম ইউরোপ'-এর মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জাস্টিস কনসার্নের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এর ওয়েবসাইটে একটি সেমিনারে অতিথি বক্তা হিসেবে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ছবি রয়েছে।

ইসলামিক ফোরাম ইউরোপের প্রতিষ্ঠাতা যুক্তরাজ্যপ্রবাসী চৌধুরী মঈনউদ্দীন। ১৫ বছর আগে ব্রিটেনের চ্যানেল ফোর টেলিভিশনে প্রচারিত একটি প্রামাণ্যচিত্রে বাংলাদেশে ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডে মঈনউদ্দীনের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্য ছিলেন। মঈনউদ্দীন অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

জাস্টিস কনসার্নের চেয়ারপারসন আসাদুজ্জামান ভূঁইয়া বিডিনিউজকে জানান, প্রাথমিকভাবে লর্ড অ্যাভেবারি সম্মত হন যে, সর্বদলীয় পার্লামেন্টারি কমিটি এবং জাস্টিস কনসার্ন যৌথভাবে এই সেমিনারের আয়োজন করবে। তবে সেমিনারের আমন্ত্রণপত্র পাঠানোর ব্যাপারে লর্ড অ্যাভেবারির বক্তব্য নাকচ করে দিয়ে তিনি বলেন, 'আমরা কোনো আমন্ত্রণপত্র পাঠাইনি। এমনকি আমি জানি না, কারা এই সেমিনারে উপস্থিত থাকছে।'

জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে জাস্টিস কনসার্ন বা বাংলাদেশ ফোরাম ইউরোপের সংশ্লিষ্টতার কথাও অস্বীকার করেন তিনি। জাস্টিস কনসার্নের ওয়েবসাইট নিবন্ধনকারী কামাল শিকদারকেও তিনি চেনেন না বলে জানান। তবে কামাল শিকদার বলেছেন, তাঁরা পরস্পরের পরিচিত।

সেমিনার আয়োজনের ব্যাপারে লর্ড অ্যাভেবারি বলেন, 'জামায়াতের সঙ্গে জাস্টিস কনসার্নের কথিত সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি আমার জানা নেই। আমাকে জানানো হয়েছে, এই কারণে কিছু সংগঠন সেমিনারে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।'

এই সেমিনার আয়োজনে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠন জড়িত থাকায় যুদ্ধাপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিতের বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইনজীবীদের উদ্বেগকে বাংলাদেশ সরকার আমলে নেবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে।

১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে কাজ করছেন এমন নিরপেক্ষ কর্মীদের কোয়ালিশন 'ওয়ার ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম'-এর রায়হান রশিদ বিডিনিউজকে বলেন, বাংলাদেশ সরকার বা সে দেশের অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য জামায়াত-সংশ্লিষ্ট সংগঠনের সঙ্গ নিয়ে সেমিনার আয়োজন সঠিক উপায় নয়।

লন্ডনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদুর রহমান খানকে সেমিনারে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। আয়োজকদের জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতির লন্ডন সফরের কারণে তিনি ব্যস্ত আছেন।

সেমিনারে আমন্ত্রিত অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আইনবিষয়ক উপদেষ্টা ক্রিস হল বিডিনিউজকে জানান, সেমিনার আয়োজনে জাস্টিস কনসার্নের সম্পৃক্ততার বিষয়টি তাঁর জানা নেই। শুধু লর্ড অ্যাভেবারির সঙ্গেই তাঁর কথা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য বাংলাদেশ সরকার গত মার্চের শেষ দিকে ট্রাইব্যুনাল, তদন্ত সংস্থা এবং আইনজীবী প্যানেল নিয়োগ করেছে।

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন