সেলিম জাহিদ
নতুন নতুন পুস্তিকা ছাপিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিপক্ষে জনমত গঠনের পরিকল্পিত অভিযানে নেমেছে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামী। গত মার্চ ও এপ্রিল মাসেই যুদ্ধাপরাধবিষয়ক ছয়টি পুস্তিকা প্রকাশ করে বাজারে ছেড়েছে জামায়াত। এর আগে এক বছরে আরো চারটি পুস্তিকা প্রকাশ করে তারা। সব কটি প্রকাশনায় জামায়াত নেতাদের নির্দোষ দাবি করা হয়।
অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধের বিচার বর্তমান সরকারের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার হলেও, প্রামাণ্য দলিলসাপেক্ষে যুদ্ধাপরাধীদের চিহ্নিত করা, সর্বোপরি যুদ্ধাপরাধের বিচার বিষয়ে জনমত গঠনের লক্ষ্যে কোনো প্রকাশনাই নেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনের। এ ক্ষেত্রে সরকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি এবং কয়েকজন নির্দলীয় গবেষকের প্রকাশনার ওপরই পুরোমাত্রায় নির্ভরশীল।
ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক ডা. এম এ হাসান বিষয়টিকে সরকারের বড় দুর্বলতা ও ব্যর্থতা বলে মনে করেন। তিনি বলেন, 'যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে সরকার বা ক্ষমতাসীনদের তো কোনো প্রকাশনা দেখি না। গণমাধ্যম এবং আমাদেরটাই মূল।' যুদ্ধাপরাধের বিচারের যৌক্তিকতা এবং এর আদর্শিক লক্ষ্যের ক্ষেত্রে সরকারের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নেই বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক নূহ-উল আলম লেনিন স্বীকার করেছেন, যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে তাঁদের দলীয় কোনো প্রকাশনা নেই। তবে তিনি বলেন, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন কাজ করছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাদের সহযোগিতা ও উৎসাহিত করা হচ্ছে।' যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে জামায়াতের প্রপাগাণ্ডার বিষয়ে নূহ-উল আলম লেনিন বলেন, 'জামায়াত নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিএনপির সহযোগিতায় প্রপাগাণ্ডা চালাচ্ছে।'
জামায়াতে ইসলামী প্রথম দিকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধিতা করলেও এখন বিচারিক আইনটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দলটি শুরুতে একঘরে থাকলেও বর্তমানে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের কাছে পেয়ে জোরেশোরে মাঠে নেমেছে। গত ১৬ এপ্রিল হোটেল শেরাটনে 'দ্য ন্যাশনাল ফোরাম ফর প্রটেকশন অব হিউম্যান রাইটস'-এর নামে নেপথ্যে জামায়াতই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালবিষয়ক সম্মেলনের আয়োজন করে। সম্মেলনে বিএনপি-জামায়াতপন্থী ১১ আইনজীবী ও এক বুদ্ধিজীবীর বক্তব্যের সংকলন নিয়ে গত এপ্রিল মাসের শেষ দিকে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। পুস্তিকার প্রচ্ছদে বিচারপতি টি এইচ খানের ছবি দিয়ে সংশোধিত ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং মানবাধিকার পরিপন্থী বলে উল্লেখ করা হয়। রাজধানীর সবুজবাগ থানার ৩৮/৪ মায়াকানন ঠিকানার 'সোসাইটি ওয়াচ' নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক আবু মুসআব এটি প্রকাশ করেন। তবে এটি মুদ্রিত হয় বড় মগবাজারের আল-ফালাহ প্রিন্টিং প্রেস থেকে।
জেলা আমির সম্মেলন, ওলামা সমাবেশ, বাংলাদেশ ইসলামিক ল' ইয়ার্স কাউন্সিলের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সম্মেলনে দলীয় আমির মতিউর রহমান নিজামীর বক্তব্য নিয়েও তিনটি পুস্তিকা প্রকাশ করে জামায়াত। জামায়াত সেক্রেটারি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ৩১ মার্চের সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্য নিয়ে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। এর শিরোনাম 'যুদ্ধাপরাধ মীমাংসিত ইস্যু'। উপশিরোনাম 'মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জিগির আরেকটি ধোঁকা, ব্যর্থতা ঢাকতে সরকার এ ইস্যুকে কাজে লাগাচ্ছে'।
সংগঠনের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীও 'খোলা চিঠি' নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন গত মার্চ মাসে। এতে সাঈদীকে রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধী বলার বিরোধিতা করে পিরোজপুরের ১০ জন কথিত মুক্তিযোদ্ধার বক্তব্য প্রকাশ করা হয়। সাঈদীর বড় ছেলে রাফিক বিন সাঈদী বইটি প্রকাশে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন। ৬৬, প্যারিদাস রোডের গ্লোবাল পাবলিশিং নেটওয়ার্ক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে আবদুস সালাম মিতুল এটি প্রকাশ করেন। তবে এটি প্রচার করছে জামায়াত।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রকাশনা বিভাগ থেকে যুদ্ধাপরাধবিষয়ক প্রথম পুস্তিকা প্রকাশ করা হয় ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। 'জামায়াত এবং জামায়াত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ বানোয়াট মিথ্যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত' শীর্ষক পুস্তিকাটির লক্ষাধিক কপি সারা দেশে বিতরণ করা হয়েছে। একই সময়ে 'এলিগেশনস অব ওয়ার ক্রাইমস এগেইনস্ট দ্য লিডার্স অব বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী-এ ট্রাভেস্টি ও অব ট্রুথ' শিরোনামে ১৫ পৃষ্ঠার আরেকটি ইংরেজি পুস্তিকা প্রকাশ করে বিভিন্ন দূতাবাসে দেওয়া হয়।
'মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা প্রকল্প' নামে আসাদ বিন হাফিজের 'দৃশ্যপট একাত্তর, একুশ শতকের রাজনীতি ও আওয়ামী লীগ' এবং 'মুক্তিযুদ্ধ যুদ্ধাপরাধী রাষ্ট্রদ্রোহী' শিরোনামে দুটি বই বাজারে ছেড়েছে জামায়াত। প্রথম বইটি ২০০৮ সালের নভেম্বর এবং দ্বিতীয়টি ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয়।
যুদ্ধাপরাধবিষয়ক প্রকাশনা সম্পর্কে জামায়াতে ইসলামীর প্রকাশনা বিভাগের চেয়ারম্যান আবু তাহের মুহাম্মদ মাছুম বলেন, 'মানুষ প্রকৃত তথ্য জানতে চায়, সে কারণে আমাদের প্রকাশনা নিয়ে জনমনে ব্যাপক আগ্রহ আছে এবং এর চাহিদাও ব্যাপক।'
খবরের লিংক
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন