প্রতীক ইজাজ ও উম্মুল ওয়ারা সুইটি
যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করার পর থেকেই জামায়াত তাদের সহযোগী সংগঠন ছাত্রশিবির ও নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে আঁতাত করে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালানোর চেষ্টা করছে। গত এক মাসে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এসব সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে বৈঠক হয়েছে। সেসব বৈঠকে যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো উড়িয়ে দেওয়া, জাতীয় সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সমাবেশ অনুষ্ঠানস্থলে নাশকতা চালানো, যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নামে উড়োচিঠি পাঠানো এবং দেশব্যাপী আতঙ্ক সৃষ্টি করা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি বিশেষ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, প্রধানমন্ত্রী গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন আমলে নিয়ে দেশব্যাপী নিরাপত্তা জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছেন। যুদ্ধাপরাধ বিচারের কাজ বিঘি্নত করতে স্বাধীনতাবিরোধী অপরাধীচক্র দেশে যাতে কোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে কঠোর নজরদারি বাড়াতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি বিশেষ বৈঠক করেছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'স্বাধীনতাবিরোধীচক্র নাশকতা চালাতে তৎপরতা শুরু করেছে। সে কারণেই সরকারের পক্ষ থেকে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার
ঠেকাতে তারা বড় ধরনের কোনো বিশৃঙ্খলা ঘটাতে পারে_তাদের এমন প্রস্তুতির কথা আমাদের কাছে এসেছে। কিন্তু সেটা তারা করতে পারবে না। আমরাও কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।'
গত এক মাসে দেশব্যাপী একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারিতে বেরিয়ে এসেছে খোদ রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকাগুলোতে জামায়াত-শিবিরের ৫০টিরও বেশি আস্তানার সন্ধান। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেওয়া সেসব গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব আস্তানা ২০-২৫ বছরের পুরনো। বেশির ভাগ আস্তানা জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের আবাসিক মেস।
বিভিন্ন সময়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, আশির দশকে জামায়াত পূর্ণোদ্যমে দেশে রাজনীতি করতে থাকলে প্রথমেই স্কুল-কলেজের মেধাবী ছাত্রদের দলে ভেড়ানোর কৌশল নেয়। এ জন্য তারা বিভাগীয় শহর এবং ভালো বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজপড়ুয়া আর্থিকভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল মেধাবী ছাত্রদের আর্থিক সুবিধা দেওয়া শুরু করে। এ ক্ষেত্রে তারা প্রথমেই গ্রাম থেকে আসা ছাত্রদের আবাসন ও পড়ার খরচ চালানোর পরিকল্পনা নেয় এবং সেটি এখনো চালিয়ে যাচ্ছে। এভাবে ধীরে ধীরে তারা দলে সদস্য সংগ্রহ শুরু করে। এর জন্য তারা জামায়াতের বড় নেতা বা প্রভাবশালী সমর্থকের পাড়া-মহল্লায় বাড়ি ভাড়া নেয়।
জানা গেছে, এসব বাড়ি ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রেও তাদের কৌশল রয়েছে। ওই এলাকার পাশাপাশি তিন-চারটা বাড়ি বা অন্তত পুরো বাড়িটা তারা ভাড়া নিয়ে নেয়। তবে এখন বেশির ভাগ বাড়িই তাদের নিজস্ব। ফলে যে কেউ চাইলে ওসব বাড়িতে ঢুকতে পারবে না। প্রতিটি বাড়িতেই তাদের দলীয় ক্যাডারদের দারোয়ান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া রয়েছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে এসব বাড়িতেই বিভিন্ন সময়ে তাদের গোপন বৈঠক হচ্ছে। নাশকতা চালানোর উদ্দেশ্যে সম্প্রতি রাজধানী এবং আশপাশের এলাকায় জামায়াত-শিবির ও জঙ্গিদের বড় একটি অংশ অবস্থান করছে। ঢাকার বাইরের সব ক্যাডারকেও ঢাকায় তলব করা হয়েছে। যেকোনো ধরনের নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছে তারা।
জামায়াত-শিবিরের আস্তানাগুলো : গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ঢাকায় যেসব স্থানে জামায়াত-শিবিরের আস্তানা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়, সেগুলো হলো নিউ মার্কেট কাঁটাবন ঢালের ২৬৬ নম্বর বাড়ি, নিউ মার্কেটের পাশে এলিফ্যান্ট রোডের ২৬৪ নম্বর বাড়ি, এলিফ্যান্ট রোডের ৫১ নম্বর পাঁচতলা ভবন, এলিফ্যান্ট রোডের ৬৬ নম্বর পাঁচতলা বাড়ি ও একটি টিনশেড মেস, কলাবাগান বশির উদ্দিন রোড মসজিদের পাশে পাঁচতলা ভবন, আজিমপুর ৪৪/এইচ নম্বর চায়না বিল্ডিং, শাহবাগ থানার চৌমুহনী বিল্ডিংয়ের পাশের ফোকাস কোচিং ভবন, পল্টনের গ্র্যান্ড আজাদ হোটেলের পেছনের মেস, মগবাজার জামায়াত অফিসসংলগ্ন মেসগুলো, শাহজাহানপুর বাজারের সামনে গ্যারেজের পাশের মেস ও রেলওয়ে কলোনির কয়েকটি বাড়ি, শাহজাহানপুরের বেনজীরবাগের লন্ডনী বাড়ি, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার মধ্য কুনিপাড়ার নুর ফার্মেসির গলির হাবিব মিয়ার চারতলা বাড়ি ও মধ্যকুনিপাড়ার পাটোয়ারী ভবন, মিরপুর ১৩ নম্বর কাফরুলের কমিশনার অফিসের পেছনের মেস, মিরপুর-২ সেনপাড়া পর্বতার ৩৯ নম্বর সমাজকল্যাণ মসজিদের দ্বিতীয় তলার মেস, শেরে বাংলানগরের হোটেল নিদমহলের পেছনের শুক্রাবাদের ১০১ ও ১০১/এ নম্বর বাড়ি, গেণ্ডারিয়ার ৫২ নম্বর সতীশ সরকার রোডের বাড়ি, সতীশ সরকার রোডের ১৫/১ নম্বর বাড়ি, গেণ্ডারিয়া শশীভূষণ চ্যাটার্জি লেনের ১২/১/এ নম্বর বাড়ি, সতীশ সরকার রোডের আদর্শ একাডেমীর উত্তর দিকের বাড়ি, ২৫ নম্বর সিরিশদাস লেনের আধুনিক প্রেস ও প্রকাশনীর ছয়তলা বাড়ি, সূত্রাপুরের বানিয়ানগর ৪৫/২ নম্বর বাড়ি, সূত্রাপুর পাতলা খান লেনের ৬, ১১/১ ও ৩০ নম্বর বাড়ি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরা ও ধানমণ্ডি ক্যাম্পাসের আশপাশের ছয়টি মেস, বাড্ডার এ/১৬৭/৫ নম্বর বাড়ির ইসলামি সমাজকল্যাণ ট্রাস্ট, আশুলিয়ার সিন্দুরিয়া এলাকার সিন্দুুরিয়া মাদ্রাসা, কামরাঙ্গীরচর থানার আল-আমিন মাদ্রাসা ও এর পাশের একাধিক মেস, উত্তরা ও তুরাগ থানা এলাকার ৫ নম্বর সেকশনের ৬/এ নম্বর রোডের ইসলামিক এডুকেশন সোসাইটি হোস্টেল (আইইএস), উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরের ১৮ নম্বর রোডের ৪৫ নম্বর বাড়িতে অবস্থিত আইডিয়াল হোম, উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরের ১ নম্বর রোডের ১ নম্বর বাড়ি, উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরের ১৩ নম্বর রোডের ১১ নম্বর বাড়ি, দক্ষিণখান থানার গাওয়াইরের ৬৭২ নম্বর বাড়ি, কোতোয়ালির কবিরাজ গলির ২/১ নম্বর বাড়ি ইত্যাদি।
জানা গেছে, জামায়াত-শিবিরের ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত এসব বাড়ির ওপর গোয়েন্দা নজরদারি রয়েছে। এখানে কখন কারা আসছে এবং কে কোথায় যাচ্ছে, সবই নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে।
এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মানবতাবিরোধীচক্রটি যে নাশকতা করে দেশে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করছে, এটার যথেষ্ট প্রমাণ আমাদের কাছে রয়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ করতে চক্রটি মরিয়া হয়ে উঠেছে।' প্রতিমন্ত্রী বলেন, এ জন্য সরকারও সজাগ রয়েছে এবং জনগণকেও সজাগ থাকতে হবে।
খবরের লিংক
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন