তৌফিক মারুফ
পঁচিশ বছর পর এবার সমুদ্রপথে হজযাত্রার উদ্যোগ নেয় সরকারের নৌ-মন্ত্রণালয়। তবে শুরু থেকেই এ নিয়ে বিতর্ক ছিল। হজ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ধর্ম মন্ত্রণালয় এবং ওই মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি বারবার উদ্যোগের বিরোধিতা করে। তবু নৌ-মন্ত্রণালয় থেকে উদ্যোগ বাস্তবায়নে চলে জোর তৎপরতা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, একটি প্রতিষ্ঠানের নামে সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলী ও জামায়াতে ইসলামীই সরকারকে এ টোপ দিয়েছিল। আর তাদের প েকাজ করছিলেন সরকারি কয়েকজন কর্মকর্তা।
গত ১৭ জানুয়ারি মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবটি দেয় 'ইডেন শিপিং লাইনস লিমিটেড' নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এর মাত্র কয়েক মাস আগে ১৪ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ সরকার থেকে নিবন্ধন নেয়। তবে লোগোতে তারা শুধু ইডেন লাইন নামটি ব্যবহার করছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, 'ইডেন লাইনের সঙ্গে বিতর্কিত রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর সম্পৃক্ততা রয়েছে গভীরভাবে। প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় রয়েছে সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলী।
অভিযোগ উঠেছে, মীর কাসেম আলী নৌপরিবহন মন্ত্র্ত্রণালয়ের জামায়াতপন্থী একটি গ্রুপের যোগসাজশে সরকারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। এ েেত্র মুখ্য ভূমিকা পালন করেন ওই মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন এবং সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা।
যোগাযোগ করা হলে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রস্তাবকারী প্রতিষ্ঠানটি যে যুদ্ধাপরাধীর তালিকাভুক্ত মীর কাসেম আলীর সেটা আমার জানা নেই। এ ছাড়া ধর্ম মন্ত্রণালয় উদ্যোগটি নিয়ে এগুচ্ছে না, ফলে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়নি। প্রকাশ্য টেন্ডার আহ্বানের মাধ্যমে কাজ দেওয়া হবে। অনেকেই আবেদন করবে, বিধি অনুসারে যারা ওই কাজ পাওয়ার তারাই পাবে।'
ইডেন শিপিং লাইনস লিমিটেডের চেয়ারম্যান এয়ার কমোডর (অব.) সৈয়দ জিলানী মাহবুবুর রহমান ওই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, 'আমাদের প্রতিষ্ঠানে জামায়াতের কেউ নেই। বরং আওয়ামী লীগের কেউ কেউ আছেন।' সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর সঙ্গে ইডেন লাইনের সম্পর্কের কথা জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় বিষয়টি দেখা ঠিক নয়।
মীর কাসেম আলীর ছেলে ডা. মীর মুহাম্মদ বিন কাসেম ইডেন শিপিং লাইনস লিমিটেডের উপনির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি কালের কণ্ঠের কাছে স্বীকার করে বলেন, তাঁর বাবা ইডেন শিপিং লাইনস লিমিটেডের একজন অংশীদার। এ সময় তিনি নিজেদের প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে এলোমেলো ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি একবার বলেন, "আমাদের প্রতিষ্ঠানের নাম 'ইডেন লাইন'। এ ছাড়া 'ইডেন শিপিং লাইনস লিমিটেড' নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান আছে।" ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আবার পরে বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম 'ইডেন শিপিং লাইনস লিমিটেড'; কিন্তু 'ইডেন লাইন' আরেকটি প্রতিষ্ঠান আছে সেটির সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রতিষ্ঠানটির দুটো ওয়েবসাইট (যঃঃঢ়://িি.িবফবহংযরঢ়ঢ়রহমষরহবং.পড়স, এবং িি.িবফবহষরহব.হবঃ) ঘেঁটে দেখা যায়, এগুলো এখনো নির্মাণাধীন। কপিরাইট ২০১০। ওয়েবসাইটে বলা হয়, তারা শিগগিরই বিভিন্ন সমুদ্রপরিবহন সেবা নিয়ে আসছে। এ থেকেও কেউ কেউ মনে করছেন, সরকারকে এ প্রস্তাবটি দেওয়ার উদ্দেশ্য সামনে রেখেই প্রতিষ্ঠানটি তড়িঘড়ি নিবন্ধন নেয়।
জাহাজে হজযাত্রী পরিবহনের বিষয়ে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক সভায় প্রথমে মৌখিকভাবে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এর ভিত্তিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান 'ইডেন শিপিং লাইনস লিমিটেড' বিশদ একটি লিখিত প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে দাখিল করে। প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা দেওয়া হয় আলরাজি কমপ্লেক্স ১৬তলা, ১৬৬ শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণি, পুরানা পল্টন ঢাকা।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র থেকে জানা যায়, প্রস্তাবনার ভিত্তিতে গত ৭ ফেব্রুয়ারি নৌ-মন্ত্রণালয়ের সভাক েএকটি আন্ত মন্ত্রণালয় সভা হয়। নৌপরিবহনমন্ত্রীর সভাপতিত্বে সভায় অনান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব আব্দুর রব হাওলাদার, চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান কমোডর রিয়াজউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর মোকসুমুল কাদির, সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমোডর বজলুর রহমান প্রমুখ। প্রস্তাবক প্রতিষ্ঠানের প েমীর কাসেম আলীর পুত্র মীর মুহাম্মদ বিন কাসেমসহ একাধিক কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন। ওই সভায় জাহাজে হজযাত্রী পরিবহনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (বাণিজ্যিক) মো. আব্দুল কুদ্দুসকে আহ্বায়ক করে ১১ সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
ইডেনের প্রস্তাব অনুসারে এ বছরের পয়লা অক্টোবর থেকে দুটি জাহাজে করে তিনটি আপ-ডাউন ট্রিপের মাধ্যমে মোট ১৮ হাজার হাজিকে চট্টগ্রাম থেকে জেদ্দা এবং জেদ্দা থেকে চট্টগ্রামে আনা-নেওয়া করার কথা ছিল। প্রস্তাবে বলা হয়, জাহাজের প্রতিটি ট্রিপে তিন হাজার করে যাত্রী বহন করা যাবে। চট্টগ্রাম থেকে জেদ্দা যেতে ছয় থেকে সাত দিন সময় লাগবে। জাহাজে হাজিপ্রতি ৮৫০ ডলার খরচ হবে। তবে ইডেন এ েেত্র নিজেদের কোনো জাহাজ ব্যবহার করবে না, তারা ইতালি বা ইউরোপের কোনো দেশ থেকে ওই জাহাজ ভাড়ায় এনে দেবে।
ইডেন লাইনের চেয়ারম্যান এয়ার কমোডর (অব.) সৈয়দ জিলানী মাহবুবুর রহমান বলেন, ধর্ম মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যেই সৌদি সরকারের সঙ্গে এবারের হজযাত্রী প্রেরনের বিষয়টি চূড়ান্ত করে এসেছে। ফলে এ বছর আর জাহাজে হজযাত্রী পাঠানোর কোনো সুযোগ হয়তো নেই। তবে আগামীবার আমরা আবার চেষ্টা করব। কারণ এ উদ্যোগটি একটি যুগান্তকারী পদপে।
মীর কাসেম আলীর আরেক ছেলে আইনজীবী মীর আহম্মদ বিন কাসেম এ প্রতিষ্ঠানের আইন উপদেষ্টা। এ ছাড়া তাঁদের পরিবারের আরো একাধিক সদস্য এ প্রতিষ্ঠানের অংশীদার।
খবরের লিংক
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন