9 April 2010

আলবদর : এ কিলিং স্কোয়াড অব পাকিস্তান (পর্ব-২)ফকিরেরপুলে মুজাহিদের ক্যাম্পে হয় হত্যা-নির্যাতনের নীলনকশা

প্রতীক ইজাজ ও উম্মুল ওয়ারা সুইটি


কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর 'নাজিম-ই আলা' অর্থাৎ সুপ্রিম হেড ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী। তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্যরাই ছিলেন আলবদরের শীর্ষ সদস্য। ঢাকার ফকিরেরপুলের ফিরু মেম্বারের বাড়িতে আলবদরের একটি ক্যাম্প ছিল। ফিরু মেম্বার সেটি পরিচালনা করলেও ক্যাম্পের প্রধান দায়িত্বে ছিলেন বর্তমান জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ। তখন তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আলবদরের প্রধান। দেশ স্বাধীনের পর এই ক্যাম্পেই পাওয়া যায় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের হত্যা ও নির্যাতনের নীলনকশা। এমনকি খোদ পাকিস্তানি গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও মিলেছে আলবদরের নৃশংসতার নানা তথ্য।

একাত্তরে আলবদর বাহিনীর নির্যাতনের শিকার মানুষের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে নির্মিত 'আলবদর : এ কিলিং স্কোয়াড অব পাকিস্তান আর্মি, ১৯৭১' প্রামাণ্যচিত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রামাণ্যচিত্রের এই অংশে উপস্থাপন করা হয়েছে যুদ্ধাপরাধের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিল ও সাক্ষ্য।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি প্রকাশিত 'একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়' বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে ছবিতে আলবদরের নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিদের পরিচয় দেওয়া হয়েছে। তাঁদের নাম ও পদ হলো : আলবদরের পাকিস্তানের প্রধান মতিউর রহমান নিজামী, পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, প্রধান সংগঠক মোহাম্মাদ কামারুজ্জামান, প্রতিষ্ঠাতা ও ময়মনসিংহ জেলার প্রধান আশরাফ হোসেন, জামালপুর সাব-ডিভিশনের প্রধান আবদুল বারী, হাইকমান্ড সদস্য আশরাফুজ্জামান খান এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার অপারেশন ইনচার্জ চৌধুরী মইনুদ্দীন।

প্রামাণ্যচিত্রে সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা সংস্থা 'ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি'র আহ্বায়ক ডা. এম এ হাসান বলেন, '১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে আলবদর বাহিনী গঠিত হয়। অধিকাংশ ছাত্রই ছিল জামায়াতে ইসলামীর স্টুডেন্ট ফ্রন্ট ইসলামী ছাত্রসংঘের সঙ্গে জড়িত। এটি শুধু আমাদের গবেষণার কথা নয়। ওই সময় যাঁরা সরাসরি জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, যাঁরা পরবর্তী সময়ে জামায়াত নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং তাঁদেরই লেখা বই, যেগুলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত_তাতেও এ তথ্য উঠে এসেছে। এমনকি পাকিস্তানের গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও এটি প্রমাণিত। তিনি বলেন, 'আমেরিকা থেকে প্রকাশিত সায়ীদ ভ্যালি রেজা তাঁর বই 'ভ্যানগার্ড অব ইসলামিক রেভল্যুশন'-এ উল্লেখ করেছেন, নিজামী ছিলেন সেই বদর বাহিনীর 'নাজিম-ই আলা' অর্থাৎ সুপ্রিম হেড।'

অধ্যাপক কবীর চৌধুরী সাক্ষাৎকারে বলেন, শুধু তথ্য সংগ্রহকারীই ছিল না। নৃশংস হত্যাকাণ্ড কিভাবে সংঘটিত করতে হয় তারও মহড়া এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বদর বাহিনীর যুবকদের। এই আলবদর বাহিনীর সক্রিয় সহযোগিতা না পেলে বুদ্ধিজীবী নিধন এত সহজ হতো না।

প্রামাণ্যচিত্রে সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আলবদর বাহিনীর নির্দিষ্ট কাজ ছিল বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা এবং বাহিনীর সদস্যরা এসেছিল তখনকার ইসলামী ছাত্রসংঘ থেকে। এই সংঘই পরে ইসলামী ছাত্রশিবির হয়েছে। এমনকি যারা আলবদরের নেতা ছিলেন পরে তাঁদেরই দেখা গেছে জামায়াতে ইসলামীর নেতা হিসেবে। যে রাষ্ট্র আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি, সেই রাষ্ট্রের বিরোধী ছিলেন তাঁরা।

আলবদরের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সম্পৃক্ততার প্রমাণ হিসেবে প্রামাণ্যচিত্রে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর ইসলামী ছাত্রসংঘ দেশব্যাপী বদর দিবস পালন করে। ওই দিন ঢাকার বায়তুল মোকাররম থেকে যে মিছিল বের হয় তার নেতৃত্ব দেন ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান সভাপতি আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ। প্রামাণ্যচিত্রে এর দলিলও উপস্থাপন করা হয়েছে।

ঢাকার ফকিরেরপুলের ফিরু মেম্বারের বাড়িতে রাজাকারদের ক্যাম্পটির প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক মাহবুব কামাল। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধ শব্দটা এলে মুজাহিদের (আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ) নাম অবশ্যই আসবে। কারণ 'হি ওয়াজ ওয়ান অব দ্য পাইওনিয়ার আর্কিটেক্টস অব বদর বাহিনী'। তাঁদের অন্যতম ওয়ার্কিং এরিয়া ছিল আমার এলাকা ফকিরেরপুল। আলবদরদের যে ক্যাম্পটা ফিরোজ মেম্বারের দ্বারা পরিচালিত হতো, আমরা তাকে বলতাম ফিরু মেম্বার। তাঁর বাসাটা আমাদের বাসা থেকে ১০০ গজের মতো হবে। ওটা আরেকটা গলি। সেই বাড়িটাই ছিল একই সঙ্গে রাজাকার ক্যাম্প ও একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। অবশ্য সেটাকে কনভারশন ক্যাম্পও বলা চলে। আলবদরের যেসব সদস্য পাকিস্তানের প্রতি বেশি কমিটেড ছিলেন, এই বাড়িতেই তাঁদের বাছাই করে বদর বাহিনীতে শিফট করা হতো। মুজাহিদ (আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ) ওই বাসায় আসতেন এবং ওখান থেকে তিনি একটা রিক্রুটমেন্ট করতেন বদর বাহিনীর জন্য। দেশ স্বাধীনের পর আমরা যখন ওই বাড়িটা দখল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প করলাম, তখন ওখানে যে কাগজপত্রগুলো আমরা পেলাম, যে ডকুমেন্ট পেলাম, সেটা ছিল ভয়াবহ। কিভাবে মানুষ হত্যা করা যায়, লুট করা যায়, কিভাবে মানুষের ওপর নির্যাতন করা যায়_তারই মাস্টারপ্লান-ব্লুপ্রিন্ট ছিল সেগুলো।

আলবদরের সঙ্গে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর সম্পৃক্ততার তথ্যও উঠে এসেছে ছবিতে। বলা হয়েছে, '৭১ সালের ১৪ নভেম্বর মতিউর রহমান নিজামীর একটা প্রবন্ধ দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত হয়। তাতে উলি্লখিত হয় 'ওই দিন আর বেশি দূরে নয়, যখন আলবদর বাহিনীর তরুণ যুবকরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হিন্দু বাহিনীকে পরাস্ত করে হিন্দুস্তানের অস্তিত্বকে খতম করে সারা বিশ্বে ইসলামের বিজয়পতাকা উড্ডীন করবে।'

আর পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে আলবদরের সম্পৃক্ততার প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন ডা. এম এ হাসান। প্রামাণ্যচিত্রে তিনি বলেন, এই বদর বাহিনী গঠনের পেছনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এবং পূর্ব পাকিস্তান গভর্নরের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খান নিজে এই বাহিনীর একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি অর্থ, বুদ্ধি, ট্রান্সপোর্ট ও অস্ত্র দিয়ে সর্বতোভাবে এই বদর বাহিনীকে সাহায্য করেছেন। একইভাবে তাদের সাহায্য করেছেন পূর্ব পাকিস্তানের সিভিল আর্মড ফোর্সের প্রধান জেনারেল জামসেদ। একইভাবে সিভিল আর্মড ফোর্সের অন্যান্য সদস্য, মিলিশিয়া ও আলমুজাহিদ (বিহারি) দিয়ে তাদের বিভিন্ন অপকর্মে সহায়তা করেছে। পুরো যুদ্ধের নয় মাসে তারা একসঙ্গে কাজ করেছে। একটি ইউনিট হিসেবে কাজ করেছে তারা।


খবরের লিংক

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন