7 April 2010

আলবদর : এ কিলিং স্কোয়াড অব পাকিস্তান (পর্ব-১)জামালপুরে সাত ক্যাম্প শেরপুরে কামারুজ্জামানের ক্যাম্প ছিল বিভীষিকা

প্রতীক ইজাজ ও উম্মুল ওয়ারা সুইটি

জামালপুরে ছিল কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর সাতটি ক্যাম্প। ক্যাম্পগুলো গড়ে ওঠে আলবদর বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ও ময়মনসিংহ জেলা আলবদর বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ আশরাফ হোসেনের নেতৃত্বে। এর মধ্যে শেরপুরের সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়ির ক্যাম্পটি ছিল সবচেয়ে বিভীষিকাময়। ক্যাম্পটির তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান।

৮০-৯০ জন মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের সহযোগীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে এ ক্যাম্পেই। দিনের পর দিন ক্যাম্পের অন্ধকার কুঠুরিতে আটকে রেখে চালানো হয়েছে অমানুষিক নির্যাতন। এসব নির্যাতন আর হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষ সহযোগী ছিলেন আলবদর বাহিনীর জামালপুর সাবডিভিশনের প্রধান আব্দুল বারী এবং সদস্য নাসির ও কামরান।

টানা সাত মাস সুরেন্দ্র মোহন সাহার ক্যাম্পের ফটকরক্ষক ছিলেন আলবদর সদস্য মোহন মুন্সি। খুব কাছে থেকে তিনি দেখেছেন নির্মম নির্যাতন। হত্যার পর দেয়ালে লেগে থাকা ছোপ ছোপ রক্তের দাগ এখনো চোখে ভাসে আর অসহায় মানুষগুলোর গগনবিদারী চিৎকার এখনো কানে বাজে বৃদ্ধ লোকটির।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কিলিং স্কোয়াড 'আলবদর'-এর মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার চাঞ্চল্যকর সব তথ্য নিয়ে নির্মিত 'আলবদর : এ কিলিং স্কোয়াড অব পাকিস্তান আর্মি, ১৯৭১' নামক প্রামাণ্যচিত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর গত ৩০ মার্চ যুদ্ধাপরাধের বিচারে সরকার গঠিত তদন্ত সংস্থার কাছে প্রামাণ্যচিত্রটি জমা দিয়েছে। এটি নির্মাণ করেছেন ফখরুল আরেফিন খান এবং প্রযোজনা করেছে ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি ও ১৯৭১ ফাউন্ডেশন।

প্রামাণ্যচিত্রে বলা হয়, জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলা সভাপতি মোহাম্মদ আশরাফ হোসেনের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়। এ বাহিনী অল্প সময়েই জামালপুরের পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তায় গঠন করে সাতটি ক্যাম্প।

একাত্তরে আলবদর বাহিনীর হাতে বন্দি হয়েছিলেন শেরপুরের সাদু চেয়ারম্যান। হত্যার জন্য লাইনে দাঁড় করানোও হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসতে সক্ষম হন তিনি। প্রামাণ্যচিত্রের এক দৃশ্যে সাক্ষাৎকারে সাদু চেয়ারম্যান বলেন, 'আমারে বাঁধছে। আর আমার শালার হ্যান্ডকাফের সঙ্গে আরো তিনজনরে বাঁধছে। আমাদের নদীর কিনারে নিয়ে গেছে। যেহেতু হ্যান্ডকাফটা লুজ আছিল, তাই হেডা খুইলা নদীতে ঝাঁপ দেই।' তিনি আরো বলেন, 'ক্যাম্পে থাকার সময় আশরাফরে ডেইলি দেখছি। ১০ তারিখে ঘর থিকা বাইর করছে, হেহানেও আশরাফ আছিল। তবে ক্যাম্প থাইকা ভাগাডা (গ্রুপ ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য) করছে সুবেদার মেজর ইউসুফ আর সামসাদ। সামসাদ খুব ব্রুট আছিল। অগো সঙ্গে আশরাফ আর বারী সব সময় লাইগা থাকত।'

আলবদরের হাত থেকে জামালপুর সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক শহীদুর রহমানও অল্পের জন্য বেঁচে যান। প্রামাণ্যচিত্রে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ''হঠাৎ করেই একটি মোটরসাইকেল দরজার সামনে এসে থামল। গিয়ে দেখি স্টেন গানসহ আশরাফ হাজির। আশরাফ গটগট করে ভেতরে ঢুকে আমাকে বলল, 'স্যার আমার সঙ্গে আসেন।' তখন আমার গায়ে গেঞ্জি। ভয় পেয়ে গেলাম। বের হয়ে এলাম। বললাম, বলো। 'না স্যার, আমার সঙ্গে আগায় যেতে হবে।' তার সঙ্গে এগোতে থাকলাম। যখন আমাকে দরজা পার করে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন আমার স্ত্রী বলে, 'আশরাফ, তুমি তোমার স্যারকে কোথায় নিয়া যাও?'"

একই কলেজের শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক শহীদুর রহমানের স্ত্রীও। আশরাফ ছিল তাঁর সরাসরি ছাত্র। তিনি বলেন, 'আমি কলেজের ডেমনস্ট্রেটর ছিলাম। ও (আশরাফ) ছিল আমার সরাসরি ছাত্র। ওকে (শহীদুর) যখন নিয়ে যায়, আমি সামনে গিয়ে দাঁড়াই। বলি, আশরাফ তুমি এ কাজটা করো না। তুমি নিয়ো না। ও কথাটা রক্ষা করছে। নেয় নাই।'

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আশরাফের সহযোগী আব্দুল বারীর একটি ডায়েরি পাওয়া যায়। সেখানে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের হত্যা, বন্দি ও হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণের সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে।

এই আশরাফেরই আরেক সহযোগী ছিলেন জামায়াতের বর্তমান সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান। ময়মনসিংহ জেলা আলবদরের প্রধান সংগঠক কামারুজ্জামানই শেরপুরে সুরেন্দ্র সাহার বাড়িতে গড়ে তোলেন কুখ্যাত আলবদর ক্যাম্প। ক্যাম্পে বন্দি মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা তালুকদারকে গুলি করে হত্যা করা হয় তাঁরই নির্দেশে।

প্রামাণ্যচিত্রে সে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শহীদ গোলাম মোস্তফা তালুকদারের ছোট ভাই মোশাররফ হোসেন বলেন, ''আমার বড় ভাই শহীদ গোলাম মোস্তফা তালুকদার স্বাধীনতার ডাকে প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলে যান। প্রশিক্ষণ শেষে দেশের ভেতর গোয়েন্দা বিভাগের কাজে নিয়োজিত হন এবং তাঁর সহযোগীদের যুদ্ধক্ষেত্রে সহযোগিতা করেন। ২৩ আগস্ট (১৯৭১) তিনি শেরপুরে আসেন এবং শেরপুর কলেজ মোড়ে একটি দোকান থেকে ব্যাটারি কেনেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রোগ্রামগুলো শোনার জন্য। পরে জানতে পারি, ওই দোকানের সামনে থেকেই কুখ্যাত কামারুজ্জামানের নির্দেশে তাঁক অ্যারেস্ট করা হয়।

সেই কলেজের পাশেই ছিল সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়ি। সে বাড়িতেই নাৎসি ক্যাম্প খোলা হয় এবং শেরপুরের মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের সহযোগীদের নিয়ে এসে অমানুষিক অত্যাচার করা হয়। সেদিন পাকিস্তানি মেজর রিয়াজ শেরপুরে ছিল। কামারুজ্জামান তাকে বলেন, 'আমরা একজন মুক্তিবাহিনী, জয়বাংলার লোক পেয়েছি। এরা সব কুখ্যাত এবং সবাই জয়বাংলার লোক।' তখন মেজর রিয়াজ বলে, 'ঠিক আছে তাকে রেখে দাও। আমরা আসতেছি।' এরপর তারা চলে যায় নকশী ক্যাম্পে। যাওয়ার আগে কামারুজ্জামান নাসির ও কামরানকে, যে কামরানের দোহাই দিয়ে কামারুজ্জামান বলতে চাইছেন, তখন আমি ছিলাম না, ছিল কামরান, তাদের নির্দেশ দিয়ে যায় মোস্তফাকে শুট করার।''

তখন শেরপুরের মোহন মুন্সি ছিলেন আলবদর বাহিনীর সদস্য। শেরপুরের সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়িতে আলবদরের যে ক্যাম্প ছিল, দীর্ঘ সাত মাস সেই ক্যাম্পের পাহারাদার ছিলেন তিনি। প্রামাণ্যচিত্রে মোহন মুন্সি তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেন, 'কামারুজ্জামান নাসিম ও কামরানকে কী জানি কইয়া চইলা গেল। এর আধা ঘণ্টা পর নাসির আর কলসবাড়িয়ার কামরান তাঁকে (গোলাম মোস্তফা তালুকদার) নিয়া যায়।'

পরদিন গোলাম মোস্তফার লাশ পাওয়া যায় শেরপুরের শের ব্রিজের নিচে। প্রামাণ্যচিত্রে এ প্রসঙ্গে তাঁর ছোট ভাই মোশাররফ হোসেন বলেন, 'আমরা পরের দিন সকালে তাঁর লাশ পেয়েছি শের ব্রিজের নিচে। সে সময় লাশের বাম পায়ের মাংস ছিল না। ডান পায়েও তাই। বুকে গুলি লেগে পেছন দিয়ে বের হয়ে গেছে। এ অবস্থায় লাশ গ্রামের বাড়িতে দাফন করি।'

গোলাম মোস্তফার মতো এ রকম ৮০-৯০ জন মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষকে হত্যার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় এ ক্যাম্পে। এ প্রসঙ্গে মোহন মুন্সি বলেন, 'অন্তত ১০০ জনকে ধইরা আনা হইছিল। আমি অন্তত তাই জানি। এর মধ্যে ধরেন ৮০-৯০ জনই গেছে গা।'

সুরেন্দ্র মোহন সাহার দোতলা বাড়ির সেই ক্যাম্পটি ধারণ করা হয়েছে প্রামাণ্যচিত্রে। ঘুরে ঘুরে সেই ক্যাম্পটি দেখান মোশাররফ হোসেন। তাঁর দেওয়া বর্ণনামতে, প্রথমে আলবদর ও রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের সহযোগীদের ধরে এনে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির নিচে রাখত। সিঁড়ির নিচে একটা গর্ত ছিল। তাতে হাত-চোখ বাঁধা মানুষগুলোকে ফেলে নির্যাতন করা হতো। তারপর নিয়ে যাওয়া হতো দোতলায়। সেখানে একটি অফিস রুম ছিল। সেখানেও নির্যাতন করা হতো। নির্যাতনের পর চোখ বেঁধে রেখে দেওয়া হতো।

মোশাররফ হোসেন বলেন, 'দেশ স্বাধীনের পর আমরা টর্চারের ছুরি, কাঁচি ও হকিস্টিক পেয়েছি। চারপাশের দেয়ালজুড়ে রক্ত পেয়েছি। রুমের ভেতর রক্ত লেগে ছিল। এসব দেখে শেরপুরের মানুষ হতভম্ব হয়ে গেছে।'

নির্যাতনের বর্ণনা দেন মোহন মুন্সিও। তিনি সিঁড়ির নিচের একটি ঘর দেখিয়ে বলেন, 'আমি এ ঘরটাতেই থাকতাম। তয় বেশির ভাগ সময়ই সিঁড়ির ওখানেই থাকতাম। মুক্তিযোদ্ধাগো আইনা ওই সিঁড়ির নিচে থুইত। মাইরা মাইরা রাখত আর আমি ওখান থাইকা চিৎকার হুনতাম। মোস্তফা খুব পানি খাইতে চাইছিল। খাওয়াইছে, না খাওয়াইছে আমি কইতে পারুম না। তয় চিৎকার পারছে।'


খবরের লিংক

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন