27 March 2010

ওরা ৩৬ জন

মাসুদুল আলম তুষার ও মাসুদ কার্জন

যুদ্ধাপরাধী চিহ্নিত করতে গোয়েন্দা উপাত্ত বিচার-বিশ্লেষণ করে প্রাথমিকভাবে ৩৬ জনের একটি তালিকা করা হয়েছে। এদের ব্যাপারে গোয়েন্দা নজরদারি চলছে। তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি তারা যাতে দেশত্যাগের সুযোগ না পায়, সে ব্যাপারেও লক্ষ রাখা হচ্ছে। ইতিমধ্যে এসব ব্যক্তির দেশত্যাগের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা পেঁৗছেছে বিমানবন্দরে। স্থলবন্দরেও একাধিক টিম মোতায়েন রয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন গতকাল শুক্রবার ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের পালানোর কোনো সুযোগ নেই। তাদের ব্যাপারে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। সীমান্ত, স্থলবন্দর ও বিমানবন্দরে সতর্ক বার্তা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হবে।

আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, তদন্ত সংস্থা যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ পেলে তদন্তের সময়ই অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করতে পারবে।

পুলিশের মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ কালের কণ্ঠকে বলেন, যুদ্ধাপরাধী কারা, তা মোটামুটি সবাই জানে। তারপরও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে কাজ করছে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মূলত সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটিকে সহায়তা করতেই তাঁরা এসব সন্দেহভাজনদের যুদ্ধাপরাধের ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছেন। গোয়েন্দা সংস্থার বিভিন্ন টিম আগে থেকেই নজরদারির মাধ্যমে নিশ্চিত করেছে তালিকায় থাকা ৩৩ জনের অবস্থান। বাকি তিন জনের সর্বশেষ অবস্থান এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই ৩৬ জনের কর্মকাণ্ড অনুসন্ধানে কাজ করছে বেশ কয়েকটি টিম। বেশিরভাগের অপরাধ সংঘটনের স্থান ঢাকার বাইরে হওয়ায় সেখানকার প্রশাসনের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। গোয়েন্দারা তালিকাভুক্তদের অপরাধ প্রমাণে সাক্ষ্য সংগ্রহের কাজও করছেন। চূড়ান্ত অনুসন্ধানে যুদ্ধাপরাধীদের সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়বে বলে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

কর্মকর্তারা বলেন, হানাদার বাহিনীর পক্ষাবলম্বন করে যারা হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণসহ গুরুতর অপরাধে জড়িত ছিল বলে দালিলিক প্রমাণ রয়েছে, তাদেরই যুদ্ধাপরাধীর প্রাথমিক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে তালিকাভুক্তদের মধ্যে দুজন রয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ দলের তিনজন নেতা প্রথম তালিকায় রয়েছেন। জাতীয় পার্টির রয়েছেন একজন। এ ছাড়া তালিকাভুক্তদের বেশির ভাগই জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের নেতা বলে জানা গেছে। অন্যরা রাজনৈতিকভাবে ততটা পরিচিত নন। আরো জানা গেছে, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম তাদের অনুসন্ধানের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে দুই বছর আগে যে ৫০ জনের নাম প্রকাশ করেছিল, তাদের অনেকে গোয়েন্দাদের প্রথম তালিকায় নেই।

গোয়েন্দারা যে ৩৬ জনের তথ্য-প্রমাণ অনুসন্ধান-বিশ্লেষণ করছেন তাঁরা হলেন_ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, চট্টগ্রাম (উত্তর) জেলা বিএনপির সভাপতি গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী, ভোলা সদর উপজেলার বিএনপি সভাপতি ও বিগত চারদলীয় জোট সরকারের ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন শাজাহান, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক নেতা ও বর্তমানে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির নেতা মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম, জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজাহারুল ইসলাম, নায়েবে আমির মাওলানা আবদুস সুবহান, নায়েবে আমির আবদুল কাদের মোল্লা, নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাশেম আলী, চট্টগ্রামের মহানগর আমির মাওলানা শামসুল ইসলাম এমপি, সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য মো. রিয়াফাত আলী বিশ্বাস, জয়পুরহাটের আব্দুল আলীম, খুলনার শাহ মোহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস, ঠাকুরগাঁওয়ের মাওলানা আব্দুল হাকীম, চুয়াডাঙ্গার মাওলানা হাবিবুর রহমান, সিলেটের হাবিবুর রহমান ও মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী, সাতক্ষীরার গাজী নজরুল ইসলাম, খুলনা মহানগর জামায়াতের আমির অধ্যাপক গোলাম পরওয়ার, দিনাজপুরের আফতাব উদ্দীন মোল্লা, গাইবান্ধার আবু সালেহ মো. আজিজ মিয়া ওরফে ঘোড়া আজিজ, সিরাজগঞ্জের রফিকুল ইসলাম খান, ময়মনসিংহের ফজলুর রহমান সুলতান, ফরিদপুরের ভাঙ্গার ডা. কাজী এমদাদুল হক, সাতক্ষীরার ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বার, নোয়াখালীর আমির আলী, ফরিদপুরের মাওলানা আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার ও হাজীগঞ্জের জামায়াতের রুকন এ বি এম খালেক মজুমদার।

এ তালিকায় থাকা জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর শাখার সাবেক আমির গোলাম সরোয়ার এবং ময়মনসিংহের নান্দাইলের এ কে এম মোশারফ হোসেন ও মাওলানা নুরুজ্জামানের সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হতে পারেননি। মৌলভীবাজারের এ এন এম ইউসুফ ইতিমধ্যে মারা গেছেন বলে গোয়েন্দারা জেনেছেন।

যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থার তালিকা প্রকাশ নিয়ে জামায়াত নেতারা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তাঁরা এই তালিকাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বেআইনি বলেও আখ্যায়িত করেছেন।

গত রাতে যোগাযোগ করা হলে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ বলেন, 'এটি যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে তা এখন পরিষ্কার। কারণ সবেমাত্র তদন্ত সংস্থা গঠিত হয়েছে, তারা এখনো কাজই শুরু করেনি। তা সত্ত্বেও যুদ্ধাপরাধীদের নাম প্রকাশ করা তদন্ত কাজে বাধা বা প্রভাবিত করার চেষ্টা। এটি বেআইনি ও অনৈতিক।'

দলের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলামের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি উল্টো জানতে চান, এ তালিকায় ক্ষমতাসীন দলের অমুক অমুকের নাম আছে কি না। এদের নাম নেই জানার পর আজহার হাসতে হাসতে বলেন, 'এটা তো যুদ্ধাপরাধীর বিচার নয়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির চেষ্টা। তারা (সরকার) না তদন্ত সংস্থা করল, না আইনজীবী প্যানেল করল। কাজ শুরুর আগেই এই তালিকা প্রকাশের মানে কী?'

ঢাকা মহানগর জামায়াত আমির রফিকুল ইসলাম খান বলেন, 'পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ কাজ হচ্ছে তালিকা তৈরি করা। যুদ্ধাপরাধীর তালিকায় আমার নাম থাকায় বোঝা যাচ্ছে, আসলে তাদের টার্গেট যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নয়, তাদের টার্গেট ইসলামকে বিতাড়িত করা।'

'তালিকায় আমার নাম থাকায় খুশি হয়েছি'_মন্তব্য করে খুলনা মহানগর জামায়াত আমির মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, 'তালিকাটি ভুয়া প্রমাণ করার জন্য আমিই যথেষ্ট। আমি চাই এই তালিকা শেষ পর্যন্ত থাকুক। কারণ ১৯৭১ সালে আমার বয়স ছিল ১২ বছর।'


খবরের লিংক

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন