9 March 2010

হল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাড়া শিবিরের, সিট বাণিজ্যে বছরে আয় ৪০ লাখ টাকা!

আনু মোস্তফা ও আসাদুর রহমান, রাজশাহী

'সোহরাওয়ার্দী হল; তারিখ: ০৩/০৬/০৯; ক্রমিক নং ২৫১২৩; জনাব সাইদুর রহমানের নিকট হতে মাসিক সিট ভাড়া বাবদ ৪০০ টাকা ধন্যবাদের সহিত গৃহীত হলো।'_এ রকম রসিদ দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আবাসিক হলগুলো থেকে সিট ভাড়া আদায় করে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ড. বেলায়েত হোসেন হাওলাদার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শিবিরের আসন বাণিজ্যের যে হিসাব পাওয়া যাচ্ছে, তাতে দেখা যায়, এভাবে বছরে তারা ৪০ লাখ টাকার বেশি আয় করেছে।'

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক ছাত্র হত্যার ঘটনার পর হল প্রশাসন ও পুলিশ বিভিন্ন হলে শিবির নিয়ন্ত্রিত কক্ষগুলো তল্লাশি করে। এ সময় তারা প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের যেসব নেতা-কর্মীকে আক্রমণ করা হবে, তাদের নামের তালিকা এবং শিবিরের বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনার পাশাপাশি হলগুলো থেকে সিট ভাড়া আদায়ের বিপুলসংখ্যক রসিদও উদ্ধার করে। সঙ্গে উদ্ধার করা হয় আদায় করা ভাড়ার হিসাব সংরক্ষণের খতিয়ান বই, উদ্বৃত্তপত্র (ব্যালান্স শিট), চূড়ান্ত হিসাব ও আয়-ব্যয় বিবরণী। এসব আয়ের নিয়মিত নিরীক্ষা প্রতিবেদনও তল্লাশির সময় পাওয়া যায়। বিভিন্ন হলের প্রভোস্ট ও প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা সম্মিলিতভাবে শিবিরের সিট বাণিজ্যের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করছেন।

শিবিরের নথিপত্র বিশ্লেষণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, ছাত্রদের ১১টি হলেই শিবিরের একক আধিপত্য বজায় ছিল ২০০১ থেকে ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এ ৯ বছরে শিবির সিট বাণিজ্যের মাধ্যমে আয় করেছে কয়েক কোটি টাকা। বছরে এর পরিমাণ ৪০ লাখ টাকার বেশি।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের ২৬১, ২৬৬, ২৬৮, ২৭৪, ৩৭৪ ও ১১৪ নম্বর কক্ষ থেকে উদ্ধার করা হয় শিবিরের বেশ কিছু নথি। এতে দেখা যায়, এ হল থেকে মাসে ২৮-৩০ হাজার টাকা সিট ভাড়া আদায় করেছে শিবির। ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে হলটির ৩৩টি কক্ষের ৫৫টি সিট থেকে শিবির ছাপানো রসিদের মাধ্যমে আদায় করেছে ২৮ হাজার ৩২০ টাকা। মাসিক সর্বনিম্ন ২২০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ এক হাজার ৪০ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়েছে।

শিবিরের সিট ভাড়া আদায়ের খতিয়ান বইতে দেখা যায়, শুধু সোহরাওয়ার্দী হলের দক্ষিণের তিনটি ব্লক থেকে ২০০৭ সালে আট মাসে ৭৮ হাজার ৪৫৫ টাকা এবং ২০০৮ সালে ৯ মাসে ৮০ হাজার ৮৮২ টাকা আদায় করা হয়েছে। হল প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, ২০০৮ সালে শিবির হলের উত্তরের তিনটি ব্লক থেকে আরো ৭৩ হাজার ৭১৫ টাকা আয় করেছে।

সোহরাওয়ার্দী হলের সহকারী রেজিস্ট্রার সফিকুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন হল থেকে উদ্ধার হওয়া শিবিরের গোপন নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১১টি হল থেকে শিবির ২০০৫ সালে সিট ভাড়া থেকে আয় করেছে ৩২ লাখ টাকার বেশি। ২০০৬ সালে আয়ের পরিমাণ আরো বেশি ছিল। তবে পরের দুই বছর কিছুটা কম ছিল।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, সিট ভাড়া থেকে আয়ের টাকা ইসলামী ব্যাংক রাজশাহী শাখা ও অগ্রণী ব্যাংক বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় খোলা হিসাবে রাখা হতো।

শিবিরের নথিপত্রে দেখা গেছে, সিট ভাড়া থেকে আদায় করা টাকার একটি অংশ তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের মেসের ছাত্র ও ছোট দোকানিদের কাছে বিভিন্ন সময়ে ঋণ দিয়েছে। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের হিসাব থেকে দেখা গেছে, ওই মাসে ৪৪ ছাত্রকে ২৮ হাজার টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। বিনোদপুরের মহানন্দা ছাত্রাবাসের ২৭ জন ছাত্রকে ঋণ দেওয়ার কথা এ বইতে উল্লেখ করা হয়েছে। ছাত্রদের এক থেকে দেড় হাজার টাকা এবং ছোট ব্যবসায়ীদের এক থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হয়েছে।

সিট বাণিজ্যের হিসাব নিরীক্ষা
সিট ভাড়া থেকে আয়ের হিসাব রাখতে শিবির প্রতিটি হলেই তৈরি করে খতিয়ান ও আয়-ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণ বই। হিসাব বইগুলো আবার দায়িত্বপ্রাপ্ত শিবির নেতারা প্রতি মাসে নিরীক্ষাও করেছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনও উদ্ধার করা হয়েছে হলগুলো থেকে। কোনো মাসে ভাড়া বাবদ টাকা কম আদায় হলে সেখানে নিরীক্ষক পরের মাসে বেশি আদায়ের পরামর্শ দিয়েছে। সোহরাওয়ার্দী হলে ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে আগের মাসের তুলনায় টাকা কম আদায় হওয়ায় নিরীক্ষক আনিসুর রহমান মন্তব্য লিখেছেন, 'আদায়ের গতি বাড়ানো প্রয়োজন, কম আদায়ের কারণ উল্লেখ করা দরকার ছিল।' ভাড়া আদায়ের রসিদের প্রতি পাতায় নিরীক্ষকের স্বাক্ষর রয়েছে।

সিট দখলের কৌশল
হল প্রভোস্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিবির ছয়টি উপায়ে হলগুলোর সিট দখলে নেয়। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়_এমন ছাত্রদের ভয় দেখিয়ে হল থেকে বিতাড়ন, সিট ফাঁকা হলে সেটিতে নিজেদের ক্যাডারদের উঠিয়ে দখলে নেওয়া, যারা হলে সিট নিতে অনাগ্রহী তাদের কাগজপত্র দিয়ে বরাদ্দ নেওয়া, হল পরিবর্তনের সময় ফাঁকা হওয়া সিট দখলে নেওয়া এবং হল প্রশাসনকে হাত করে বেশি সিট দখলে নেওয়া।

সোহরাওয়ার্দী হলের প্রভোস্ট ড. আখতার ফারুক জানান, কোনো ছাত্র মাস্টার্সে উঠলেই তাকে সিট বরাদ্দের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু অনেক ছাত্র এক বছর বা ছয় মাসের জন্য হলে উঠতে আগ্রহী হয় না। ওই ছাত্রদের কাগজপত্র সংগ্রহ করে শিবির সিটগুলো নিজেদের দখলে নেয়। আবার হল প্রশাসনের আনুকূল্য নিয়েও তারা নেতা-কর্মীদের নামে অবৈধভাবে অনেক সিট বরাদ্দ নেয়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের এক ছাত্র নাম প্রকাশ না করে বলেন, 'জোহা হলে আমার আসন থাকলেও আমি সেখানে মাত্র ২১ দিন থাকতে পেরেছিলাম। এক সময় আমি হল ছেড়ে মেসে উঠি। আমার মতো অসংখ্য ছাত্র হলে থাকতে পারেনি। এভাবে শিবির হলের আসন দখলে নেয়।'

উপাচার্যের কথা
শিবিরের সিট বাণিজ্য প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এম সোবহান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'হলগুলোর সাবেক প্রশাসন এসব বিষয়ে সচেতন ও সতর্ক থাকলে এমন কিছু হওয়ার সুযোগ ছিল না। আমরা এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন দিক খতিয়ে দেখছি।'

শিবিরের বক্তব্য
ছাত্রশিবিরের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি শামসুল আলম, সাধারণ সম্পাদক মোবারক হোসেনসহ কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কাউকেই পাওয়া যায়নি। তাদের সবার ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁর ফোন ধরেন শান্ত নামে নির্বাহী কমিটির এক সদস্য। তিনি বলেন, সভাপতি ব্যস্ত আছেন। প্রচার সম্পাদকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।

টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে শিবিরের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক আতাউর রহমান সরকার বলেন, 'আমরা অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের মতো নই। হিসাব রাখার সুবিধার্থে আমরা কাগজপত্র সংরক্ষণ করি। তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যে নথিপত্রের কথা বলছেন, তা প্রশাসনের সাজানো নাটক। এসব শিবিরের বিরুদ্ধে অপপ্রচার।'


http://174.133.126.18/~dailykal/index.php?view=details&type=single&pub_no=99&cat_id=1&menu_id=13&news_type_id=1&news_id=38155

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন