আজাদুর রহমান চন্দন
একাত্তরে 'আলবদর ও আলশামস কাজ করত সেনাবাহিনীর ডেথ স্কোয়াড হিসেবে। প্রগতিশীল অধ্যাপক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও চিকিৎসক তথা বুদ্ধিজীবীদের হত্যার জন্য এদের দায়ী করা হয়।' এ মন্তব্য বাংলাদেশের কারোর নয়, পাকিস্তানের একজন গবেষকের। তাঁর নাম হসাইন হাক্কানি। তিনি একজন নামকরা কূটনীতিকও।
হুসাইন হাক্কানি তাঁর 'পাকিস্তান : বিটুইন মস্ক অ্যান্ড মিলিটারি' গ্রন্থের ৭৯ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত অবাঙালি ও পাকিস্তানপন্থী ইসলামী সংগঠনগুলোর কর্মীদের নিয়ে এক লাখ সদস্যের একটি রাজাকার বাহিনী গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেনাবাহিনী। দুটি আধাসামরিক কাউন্টার ইনসারজেন্সি ইউনিট গড়ার লক্ষ্যে জামায়াতে ইসলামী এবং বিশেষ করে এর ছাত্র সংগঠনটি ১৯৭১ সালের মে মাসে সামরিক বাহিনীর ওই উদ্যোগে শরিক হয়। জামায়াতের ছাত্র সংগঠন তাদের অনেক কর্মী-সমর্থককে এসব বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করায়। একই বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ রাজাকারের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০ হাজারে।
২০০৫ সালে প্রকাশিত এ বইয়ে হাক্কানি আরো লিখেছেন, 'আলবদর ও আলশামস নামে দুটি আলাদা বিশেষ ব্রিগেডও গড়ে তোলা হয়েছিল ওই (জামায়াতের) ছাত্র ক্যাডারদের নিয়ে। আলবদরদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল বিশেষ অভিযানের জন্য। আর ব্রিজসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হতো আলশামস বাহিনীর ওপর।'
বইটিতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, আলবদর ও আলশামস কাজ করত সেনাবাহিনীর ডেথ স্কোয়াড হিসেবে। আলবদর বাহিনী যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন অধ্যাপক, প্রথিতযশা পাঁচজন সাংবাদিকসহ অনেক বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে সে তথ্যও উল্লেখ আছে বইটিতে।
একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা, অগি্নসংযোগ, ধ্বংসযজ্ঞ, নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো জঘন্যতম অপরাধের সঙ্গী হয়েছিল এ দেশেরই কিছুসংখ্যক নরপিশাচ। জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি জনবিচ্ছিন্ন ডানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল মিলে বর্বর পাকিস্তানিদের সহায়তায় গড়ে তুলেছিল শান্তি কমিটি নামের এমন এক সংগঠন, যা মূলত অশান্তির আগুনে পোড়ায় গোটা দেশকে। শান্তি কমিটিরই পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছিল ঘাতক রাজাকার বাহিনী, যা ছিল পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অধীনে ন্যস্ত। তবে এ রাজাকার বাহিনী নিয়ে দালাল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কিছু মতভেদও দেখা দিয়েছিল। কারণ এ ঘাতক বাহিনীটি ছিল পুরোপুরি জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্রসংগঠন তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের নিয়ন্ত্রণে। রাজাকার বাহিনীর ছিল দুটি বিশেষ খুনি ব্রিগেড_ আলবদর ও আলশামস।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই রাজাকার-আলবদর বাহিনীর সদস্যদের অপকর্মের বিবরণ পাওয়া যায় পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা ও রাজনীতিকদের লেখা ও বক্তব্যেও।
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরের রাস্তাঘাট, অলিগলি এবং মানুষের চেহারা চিনত না পাকিস্তানি সেনারা। বাংলা লেখা বাড়ির নম্বরও বুঝত না তারা। সাধারণ মানুষ তাদের কোনো সহযোগিতা করত না। ওই সময় পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগিতা করতে 'যারা এগিয়ে আসেন, তারা ছিলেন দক্ষিণপন্থী; যেমন_কাউন্সিল মুসলিম লীগের খাজা খয়ের উদ্দিন, কনভেনশন মুসলিম লীগের খান ফজলুল কাদের চৌধুরী, কাইয়ুম মুসলিম লীগের খান এ সবুর খান, জামায়াতে ইসলামীর অধ্যাপক গোলাম আযম ও নেজামী ইসলামী পার্টির মৌলভী ফরিদ আহমাদ।' একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর (পরে ব্রিগেডিয়ার) সিদ্দিক সালিক তাঁর 'উইটনেস টু সারেন্ডার' বইয়ে এভাবেই দালালদের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, 'এদের সবাইকে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পরাজিত করে আওয়ামী লীগ। বাঙালিদের ওপর এদের প্রভাবও ছিল সামান্যই। সাধারণ মানুষের অনুভূতি ছিল_এরা সবাই অচল মুদ্রা।'
বইয়ে আরো বলা হয়েছে, 'বাঙালিরা আগে থেকেই আমাদের পছন্দ করত না। অপারেশনের সময় কিছু সৈনিকের লুট, হত্যা ও ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই আমাদের বাঙালি জনগণ থেকে আরো দূরে সরিয়ে দেয়।...সেইসব ব্যক্তিই আমাদের হাতে হাত মেলাল_যারা ইসলাম ও পাকিস্তানের নামে তাদের সব কিছুরই ঝুঁকি নিতে তৈরি ছিল। এ ব্যক্তিদের দুটি গ্রুপে সংগঠিত করা হয়। বয়স্ক ও নামী ব্যক্তিদের নিয়ে গঠন করা হলো শান্তি কমিটি, আর যারা তরুণ ও সুঠাম দেহের অধিকারী, তাদের রিক্রুট করা হলো রাজাকার বাহিনীতে।'
সিদ্দিক সালিক আরো লিখেছেন, 'এদের কেউ কেউ অবশ্য আওয়ামী লীগপন্থীদের সঙ্গে নিজেদের পুরনো বিরোধের প্রতিশোধ নিতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে নিজেদের যোগাযোগকে ব্যবহার করত।' মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দালালরা কিভাবে উদ্দেশ্যমূলক বানোয়াট তথ্য সরবরাহ করে হানাদার বাহিনীকে দিয়ে দেশের বিভিন্ন জনপদ ছারখার করিয়েছে, সে বিবরণও আছে বইটিতে।
একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী ও রাজাকার বাহিনীর ভূমিকার সমালোচনায় মুখর ছিলেন পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো, দলের তথ্য সম্পাদক মাওলানা কাওসার নিয়াজি, পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার মার্শাল আসগর খান প্রমুখ। রাজাকারদের নৃশংসতার প্রতি ইঙ্গিত করে ভুট্টো বলেছিলেন, 'পাকিস্তানি কর্তৃক পাকিস্তানি হত্যা বন্ধ করতে হবে।' এতে ক্ষুব্ধ হয়ে গোলাম আযম বলেন, 'ভুট্টো কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করে পূর্ব পাকিস্তানিদের বোকা বানাতে পারবেন না।' আর জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম-এ আসগর খানকে 'কাণ্ডজ্ঞানহীন' এবং 'হিন্দুস্তানের দালাল' আখ্যা দেওয়া হয়।
অন্যদিকে কাওসার নিয়াজি অভিযোগ করেন, 'গোলাম আযমকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।' তিনি বলেন, 'জামায়াতে ইসলামীকে একটি দেশপ্রেমিক জাতীয় দল বলে আখ্যায়িত করা হয় অথচ এটা বাস্তব অবস্থার বিপরীত।' (দৈনিক সংগ্রাম, ৯ নভেম্বর ১৯৭১)
খবরের লিংক
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন