9 March 2010

১০ আসামির সবাই জামিনে, আবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে সিআইডির আবেদনঃ বিডি ফুডের হেরোইন পাচার মামলা তিন বছর পর সক্রিয়



কামরুল হাসান | তারিখ: ০৯-০৩-২০১০


প্রায় চার বছর ফাইলবন্দী থাকার পর বিডি ফুডের ৭৫ কেজি হেরোইন পাচারের মামলাটি আবার নড়েচড়ে উঠেছে। পণ্য রপ্তানির আড়ালে লন্ডনে এই হেরোইন পাচার করা হয়েছিল। তদন্তকারী কর্মকর্তা নতুন করে বিডি ফুডের চেয়ারম্যান বদরুদ্দোজা মোমিনসহ ছয় আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের অনুমতি চেয়েছেন।

সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, তদন্ত থেমে থাকায় বদরুদ্দোজা মোমিনসহ ১০ আসামির সবাই জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। চার দফা তদন্তকারী বদলের পর এখন পঞ্চম কর্মকর্তা এ মামলার তদন্ত করছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মামলার আলামত হিসেবে লন্ডনে আটক হেরোইন পরীক্ষাসহ অন্যান্য সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহের জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তার যুক্তরাজ্য যাওয়ার অনুমতি না মেলায় তদন্ত প্রায় বন্ধ হয়ে য়ায়। এরপর মামলাটি ফাইলবন্দী অবস্থায় পড়ে ছিল। এ কারণে বারবার তারিখ পড়লেও তদন্তের প্রতিবেদন আর জমা পড়েনি আদালতে। এই ফাঁকে সব আসামিই জামিন পেয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে যান। এতে করে চোরাচালানের ঘটনায় বিডি ফুডের বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে করা দুটি মামলার ভবিষ্যত্ অনিশ্চয়তায় পড়ে। এ অবস্থায় সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ মামলাটি সক্রিয় রাখতে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন।

তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার এরশাদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, মামলাটি দীর্ঘদিন ফাইলবন্দী ছিল। এ কারণে আসামিদের নতুন করে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন। এ জন্য আদালতের অনুমতি চেয়ে ১ মার্চ তিনি আবেদন করেছেন। মহানগর হাকিম সাহাদত হোসাইন শুনানির জন্য ২৪ মার্চ দিন ধার্য করেছেন। যাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চাওয়া হয়েছে, তাঁরা হলেন বদরুদ্দোজা মোমিন, ব্যবস্থাপক মো. মাইনুদ্দিন ও আবু বকর সিদ্দিক, কর্মচারী নাজমুল হায়দার, অভিযুক্তদের আরেক কোম্পানি গ্রিন হ্যাভেনের মালিক আবুল বাশার ও তাঁর সহযোগী কাজী জাফর রেজা।

বিডি ফুডের চেয়ারম্যান বদরুদ্দোজা মোমিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো কথা বলতে চাননি। তাঁর আইনজীবী আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও কোনো কিছু বলতে রাজি হননি।
সূত্র জানায়, লন্ডনের দুটি সমুদ্রবন্দর দিয়ে সবজি ও টাইলস রপ্তানির আড়ালে ৭৫ কেজি হেরোইন পাচারের ঘটনাটি ধরা পড়ে। দিল্লির ব্রিটিশ হাইকমিশন বিষয়টি জানানোর পর ২০০৬ সালের ২১ এপ্রিল সিআইডির সহকারী সুপার দীপক গুপ্ত বাদী হয়ে রাজধানীর মতিঝিল ও সূত্রাপুর থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা করেন। এর পর থেকে সিআইডির কর্মকর্তারা মামলাটি তদন্ত করছেন। এতে জড়িত অভিযোগে বিডি ফুডের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আগের তদন্তকারীদের মধ্যে একজন ছাড়া আর কেউ মামলাটি তদন্তের ব্যাপারে কোনো কিছুই করেননি। তাঁরা শুধু নির্ধারিত তারিখে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য আবেদন পাঠিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছেন।

সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, হেরোইন পাচারের আসামি এখানে গ্রেপ্তার হলেও এ মামলার ঘটনাস্থল যুক্তরাজ্যে। হেরোইন উদ্ধার করাও হয়েছে যুক্তরাজ্যে। সিআইডি শুধু যুক্তরাজ্য সরকারের অনুরোধের ভিত্তিতেই মামলা তদন্ত করছে। কিন্তু মামলার আলামত ও ঘটনাস্থল কোনো কিছুই তাঁরা দেখেননি বা জানেন না। এ অবস্থায় তাঁদের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে হবে। সেটা সম্ভব না হলেও উদ্ধার করা হেরোইনের নমুনা, রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদন ও জব্দ তালিকাসহ মামলার ক্ষেত্রে জরুরি নথিপত্র যুক্তরাজ্য সরকারকে সরবরাহ করতে হবে। প্রয়োজনে যুক্তরাজ্যের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে আদালতে সাক্ষী দিতে হতে পারে। এ জন্য সিআইডির পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চিঠি দিয়ে যুক্তরাজ্য সরকারের সহযোগিতা চাওয়া হয়।

সূত্র জানায়, কিন্তু হেরোইন পাচারের মামলায় আসামিদের ‘মৃত্যুদণ্ড’ দেওয়া যাবে না—এমন শর্তে তদন্তে সহায়তা করতে চায় যুক্তরাজ্য সরকার। যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ রকম শর্ত দিয়ে চিঠিও পাঠানো হয় বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে। জানা যায়, ২০০৮ সালের ২০ মার্চ যুক্তরাজ্যের তত্কালীন অ্যাটর্নি জেনারেল বিভাগের যুগ্ম প্রধান স্টুয়ার্ট ব্ল্যাকলে বাংলাদেশের তত্কালীন স্বরাষ্ট্রসচিব আবদুল করিমের কাছে চিঠি লিখে মামলায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে না বলে প্রতিশ্রুতি চান। এরপর ৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঢাকায় যুক্তরাজ্য দূতাবাসকে চিঠি দিয়ে জানায়, কমনওয়েলথ স্কিম ও ভিয়েনা কনভেনশনের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদে অবৈধ মাদক পাচার রোধে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা করা এবং ওই সহযোগিতায় কোনো শর্ত আরোপ না করার কথা উল্লেখ আছে। ওই চিঠির পরও যুক্তরাজ্য এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে জানান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

সিআইডির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, প্রচলিত আইনে এ ধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি সুরাহা করতে তাঁরা ব্রিটিশ হাইকমিশনের সঙ্গে কথা বলার উদ্যোগ নেন। সে উদ্যোগ সফল হতে পারেনি। এ অবস্থায় মামলাটি পড়ে আছে।

এ ব্যাপারে ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনে যোগাযোগ করা হলেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

সূত্র জানায়, মাদক পাচারের দুই মামলায় বিডি ফুডের চেয়ারম্যান বদরুদ্দোজা মোমিন, কর্মচারী নাজমুল হায়দার, ব্যবস্থাপক আবু বকর সিদ্দিক ও মো. মাইনুদ্দিন, তাঁদের সহযোগী বিমানের কার্গো-শ্রমিক নয়ন ও অভিযুক্তদের আরেক কোম্পানি গ্রিন হ্যাভেনের মালিক আবুল বাশার ও তাঁর সহযোগী কাজী জাফর রেজা, দেলোয়ার হোসেন, মিজানুর রহমান ভূঁইয়া ও ইমদাদুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়। বদরুদ্দোজা ২০০৮ সালের ৮ জুন হাইকোর্ট থেকে জামিনে ছাড়া পান। এর পরই জামিন পান রেজা, মাইনুদ্দিন, নয়ন ও আবু বকর।

এঁদের মধ্যে মাইনুদ্দিন, নাজমুল হায়দার, নয়ন ও জাফর রেজা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে তাঁরা জানিয়েছেন, হেরোইন পাচারের সঙ্গে বিডি ফুডের মালিকসহ গ্রেপ্তার হওয়া সবাই জড়িত ছিলেন।

বদরুদ্দোজা মোমিনকে ২০০৬ সালের ১৪ মে রাতে গ্রেপ্তার করে কয়েক দফায় ১৭ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে সিআইডি পুলিশ। এই জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে তদন্তকারী সংস্থা সিআইডির তত্কালীন বিশেষ পুলিশ সুপার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেওয়া একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, বিডি ফুডের মালিকসহ অন্যরা হেরোইন পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে তাঁরা পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ পেয়েছেন।

সিআইডির বিশেষ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ প্রথম আলোকে বলেন, এ মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তিরা যাতে সাজা পান, সে বিষয়টি তাঁরা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন।


খবরের লিংক

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন