6 March 2010

পার্বত্য অঞ্চলের গহিন জঙ্গলে জঙ্গিদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ

উম্মুল ওয়ারা সুইটি

জঙ্গি সংগঠনগুলো এবার তাদের গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য বেছে নিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের গহিন অরণ্য ও বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকাকে। দেশের বিভিন্ন স্থানে র‌্যাব-পুলিশের কড়া নজরদারি এড়াতেই তারা এ কৌশল নিয়েছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জঙ্গিরা ফের বড় ধরনের হামলার জন্য গেরিলা প্রশিক্ষণ জোরদার করেছে। ওই সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় ১৫টির বেশি জঙ্গি সংগঠনের ২৫টিরও বেশি অস্থায়ী প্রশিক্ষণ ক্যাম্প রয়েছে। এসব ক্যাম্প পরিচালনার পাশাপাশি জঙ্গি সংগঠনগুলো সেখানে অভিনব কায়দায় সদস্য সংগ্রহ করছে।

সম্প্রতি পার্বত্য এলাকার বিভিন্ন উপজেলা এবং কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া ঘুরে জানা গেছে, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (হুজি), হরকত-ই-তৈয়বা, হরকাতুল মুজাহিদ, হিজবুত তাওহীদ, মিয়ানমারের ন্যাশনাল ইউনাইটেড ফ্রন্ট অব আরাকান, আরাকান রোহিঙ্গা ইনটেলিজেন্স ফোর্স, ইফতেদাতুল আল মুসলিমিন, রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন, আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন, ইসলামী তুলবা মুভমেন্টসহ ১৫টি জঙ্গি সংগঠন দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় গেরিলা প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।

বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি জেলা, কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া এবং চট্টগ্রামের সাতকানিয়া এলাকায় জঙ্গি তৎপরতা সম্পর্কে গত সপ্তাহে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা আলাদা প্রতিবেদন জমা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। দেশের জঙ্গি তৎপরতার ওপর গত এক বছরে এ নিয়ে তিন দফা প্রতিবেদন দিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্র জানায়, যুদ্ধাপরাধের বিচারকাজ শুরু হলে জঙ্গি হামলার পাশাপাশি স্বাধীনতাবিরোধীরা দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি কিংবা দেশকে অশান্ত করতে অপতৎপরতা চালাতে পারে_এ আশঙ্কায় সরকারও সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু গতকাল রবিবার রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শুরু হলে স্বাধীনতাবিরোধী পক্ষ নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করতে পারে, এটা আমরা আশঙ্কা করছি। বিচারকাজকে বাধাগ্রস্ত করতে এরা জঙ্গি তৎপরতাসহ বিভিন্ন গোপন ষড়যন্ত্র করতে পারে_এ আশঙ্কা সরকারের রয়েছে। সেই হিসেবে ব্যবস্থা নিতে ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সীমান্ত এলাকাগুলোতে সতর্কাবস্থা নেওয়া হবে। জঙ্গি নির্মূলে সরকার বদ্ধপরিকর।'

কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত তিন মাসে বান্দরবানে সন্দেহভাজন বাংলাদেশি জঙ্গি ও রোহিঙ্গা মিলিয়ে দেড় শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মাটিরাঙার একটি ক্যাম্প থেকে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, 'গত কয়েক মাসে এখানে সন্ত্রাসী ও জঙ্গি তৎপরতার আলামত দেখা যাচ্ছে। গত ১৬ সেপ্টেম্বর ঘুনধুমের ধলা পাহাড়ে একটি জঙ্গি গেরিলা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে জিহাদি বইপুস্তক পাওয়া গেছে। কিন্তু কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। এখনো আমরা এ বিষয়ে বেশ সতর্ক। কোনো ধরনের তথ্য পেলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে অভিযান চালাই।'

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের তুমব্রু যোগাইন্যা থেকে থানচি পর্যন্ত ২৭১ কিলোমিটারের মধ্যে ১৭২ কিলোমিটার অরক্ষিত ওই এলাকার গহিন পাহাড়ি জঙ্গলেই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পগুলো গড়ে উঠেছে। এদের নেটওয়ার্ক শক্তিশালী হওয়ায় অনেক সময় অভিযানের আগেই তাদের কাছে খবর পেঁৗছে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তারা সে স্থান ত্যাগ করে। এ কারণে বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে প্রশিক্ষণের স্থান নির্দিষ্ট করা গেলেও প্রশিক্ষক বা নেতাদের ধরা যায় না।

নাইক্ষ্যংছড়ি, টেকনাফ, উখিয়া, ঘুনধুম, তুমব্রু ঘুরে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে জঙ্গি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প রয়েছে। সাত-আট মাস ধরে এসব ক্যাম্পে চলছে গেরিলা প্রশিক্ষণ।

নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের আবুল হাসান বলেন, '১৯৮৫ সালে প্রথম নাইক্ষ্যংছড়িতে জঙ্গি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের কথা জানাজানি হয়। উপজেলার গহিন পাহাড়ি এলাকা ঘুনধুম ইউনিয়নের তমব্রুতে দুটি জঙ্গি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে উঠেছিল। ২০০৫ ও ২০০৬ সালে বিডিআর ও পুলিশের অভিযানে নাইক্ষ্যংছড়িতে সাত-আটটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের হদিস পাওয়া যায় এবং সেসব ক্যাম্প থেকে বিভিন্ন প্রকারের আধুনিক অস্ত্র ধরা পড়ে। মাঝখানে কিছুদিন চুপচাপ থাকলেও কয়েক মাস ধরে আবারও তৎপরতা দেখা যাচ্ছে।'

নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়ন বাজারে এক চায়ের দোকানে একটি রাবার বাগানের সুপারভাইজার জসিম ও আরিফসহ উপস্থিত সবাই প্রায় একবাক্যে বলেন, সেখানে মূল সমস্যা জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ। তাঁরা বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে এলাকায় নতুন নতুন লোকের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। তারা কোথায় যাচ্ছে, কোন এলাকা থেকে এসেছে কেউ জানে না। শোনা যাচ্ছে বাইশারী, আলীক্ষ্যং, পানছড়ি, দোছড়ি, তমব্রু ও ঘুনধুমের দুর্গম পাহাড়ি জঙ্গলে গেরিলা প্রশিক্ষণ চলছে।'

কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং ইউনিয়নের এক তরুণ জানান, এখানকার জঙ্গিরা প্রথমে ইসলামী নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে দেশ গড়ার জন্য জিহাদে অংশ নেওয়ায় উদ্বুদ্ধ করতে খুব গোপনে পরিবারের প্রধান ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে। তরুণ ও কিশোর রয়েছে এমন দরিদ্র পরিবারকে টার্গেট করে আর্থিক সহযোগিতা দেয়। দলে গেলে পুরো পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সংগঠনগুলো এখন স্থানীয়ভাবেই সদস্য সংগ্রহ করছে।

টেকনাফ বন্দরে আসা বান্দরবানের লামা ও আলীকদম উপজেলার বাসিন্দা হারুন, ইব্রাহিম শর্মাসহ বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, এসব এলাকা থেকে কয়েক দফায় অস্ত্রসহ মিয়ানমারের আরাকানি জঙ্গি এবং বাংলাদেশি বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা ধরা পড়েছে।

টেকনাফের কুতুপালং ক্যাম্পের একজন ভলান্টিয়ার (মাঝি) নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'এখানে চার-পাঁচটি গ্রুপ কাজ করে। আরাকানি জঙ্গি সংগঠন এবং বাংলাদেশের কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে এখানকার গ্রুপগুলোর যোগাযোগ রয়েছে।' প্রতিনিয়ত মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে আসা রোহিঙ্গারা কোনো কাজকর্ম না পেয়ে এসব জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বলেও তিনি জানান।

উখিয়ার কুতুপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোল্লা ফজলে রাবি্ব জানান, কুতুপালং ক্যাম্পের জঙ্গি কানেকশনের কথা সবাই জানে। স্থানীয় বাসিন্দারা বেশ আতঙ্কে রয়েছে। গত মাসেও অস্ত্রসহ ধরা পড়েছে কয়েকজন।


খবরের লিংক

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন